এশিয়া কাপ ট্রফি বিতর্ক থেকে ক্রিকেটারদের ছবি ব্যবহারে বিরোধ: উত্তপ্ত হতে পারে আইসিসির বোর্ড সভা
বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে এবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে আইসিসির ত্রৈমাসিক বোর্ড সভা। দুবাইয়ে ৭ নভেম্বর হবে বোর্ড সভা। এর আগে ৫ নভেম্বর বসবেন আইসিসির প্রধান নির্বাহীরা।
আইসিসির এবারের বোর্ড সভায় উঠতে পারে এশিয়া কাপ ট্রফি নিয়ে বিতর্ক। আলোচনা হবে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটের (ইউএসএসি) প্রশাসনিক সংকট এবং খেলোয়াড়দের নাম ও ছবি ব্যবহারের অধিকার নিয়ে আইসিসি ও ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউসিএ) বিরোধ নিয়ে। সব মিলিয়ে এ সপ্তাহে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আইসিসির ত্রৈমাসিক বৈঠক বেশ আলোচিতই হবে।
এশিয়া কাপের ট্রফি নিয়ে কী হবে
বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে নেই। তবে ক্রিকেট বিষয়ক পোর্টাল ইএসপিএনক্রিকইনফো জানিয়েছে, ৭ নভেম্বরের বোর্ড সভায় এটি আলোচনায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বৈঠকের বাইরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাতেও এটি গুরুত্ব পাবে।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) সম্পর্ক এখন তলানিতে। এশিয়া কাপে দল দুটি তিনবার মুখোমুখি হয়েছিল। টুর্নামেন্টে তিনটি ম্যাচেই পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানান ভারতের ক্রিকেটাররা। টুর্নামেন্টে ভারত–পাকিস্তানের ম্যাচগুলোতে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে হারিস রউফ, সূর্যকুমার যাদব, যশপ্রিত বুমরা ও সাহিবজাদা ফারহানও শাস্তিও পেয়েছেন।
এখন সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হলো এশিয়া কাপের ট্রফি। ভারত ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতলেও তারা ট্রফি নেয়নি। কারণ, ফাইনাল শেষে ভারতীয় দল পিসিবি চেয়ারম্যান ও এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি মহসিন নাকভির কাছ থেকে ট্রফি নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত ট্রফি ছাড়াই ভারতীয় দল উদ্যাপন করে। এখনো তারা ট্রফিটি হাতে পায়নি। ফাইনালের পর থেকে ট্রফিটি আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। জানা গেছে, এটি বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসিসির একটি অফিসে রাখা আছে। নাকভি বলেছেন, এসিসিপ্রধান হিসেবে তিনিই ট্রফি হস্তান্তর করবেন—এটি তাঁর এখতিয়ার। নাকভি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ায় তিনি বৈঠকে সরাসরি উপস্থিত থাকবেন, নাকি অনলাইনে যোগ দেবেন—তা এখনো নিশ্চিত নয়।
আইসিসি-ডব্লিউসিএ বিরোধ: খেলোয়াড়দের নাম, ছবি ও পরিচয় ব্যবহারের অধিকার নিয়ে টানাপোড়েন
আইসিসির সাম্প্রতিক কৌশলগত পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্যোগ হলো নিজস্ব মোবাইল গেম তৈরি করা। এ জন্য তারা একটি বাণিজ্যিক অংশীদার খুঁজছে। মোবাইল, কম্পিউটার ও গেম কনসোলে খেলার উপযোগী এই গেমের মাধ্যমে আইসিসি নতুন আয়ের সম্ভাবনা দেখছে।
তবে এই প্রকল্প ঘিরে নতুন একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে খেলোয়াড়দের নাম, ছবি ও পরিচয় ব্যবহারের অধিকার নিয়ে। ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউসিএ) অভিযোগ করেছে, খেলোয়াড়দের সঙ্গে যথাযথ চুক্তি না করেই আইসিসি তাদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে গেম তৈরি করছে।
সম্প্রতি ডব্লিউসিএ তাদের সঙ্গে যুক্ত ৬০০ জন খেলোয়াড়কে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আইসিসি আপনাদের নাম, ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে একটি মোবাইল গেম তৈরি করছে, অথচ খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোনো শর্ত বা চুক্তিতে পৌঁছায়নি।’ ভারত ও পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা এই সংগঠনের সদস্য নন।
গত জুলাইয়ে আইসিসির বার্ষিক সম্মেলনে কিছু সদস্য দেশ প্রস্তাব দিয়েছিল, বোর্ডগুলো যেন সরাসরি নিজেদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি ও পরিচয় ব্যবহারের চুক্তি করে। কিন্তু ডব্লিউসিএ বলেছে, এটি তাদের সঙ্গে আইসিসির আগের চুক্তির লঙ্ঘন।
সংগঠনটি অভিযোগ করেছে, আইসিসি ও কিছু সদস্য বোর্ড খেলোয়াড়দের নাম, ছবি ও পরিচয়ের অধিকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়—যা পূর্বনির্ধারিত চুক্তির বাইরে।
আইসিসির প্রধান নির্বাহীদের কমিটি (সিইসি) বুধবার বৈঠকে সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে এই বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন শুনবে—কে কীভাবে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে এসব অধিকার সুরক্ষিত করছে, তা নিয়েই মূল আলোচনা হবে।
আইসিসির মধ্যমেয়াদি কৌশল পুনর্বিন্যাস
আইসিসি ব্যবস্থাপনা সংস্থা একটি মধ্যমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর লক্ষ্য নতুন অর্থায়নের সুযোগ খুঁজে বের করা এবং খেলাটির পরিসর আরও বাড়ানো।
এর অংশ হিসেবে আইসিসি এখন ভাবছে কীভাবে ক্রিকেটকে কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকের মতো মাল্টি ডিসিপ্লিনের আসরে অন্তর্ভুক্তির সুযোগকে কাজে লাগানো যায়। এসব আয়োজনের মাধ্যমে ক্রিকেটের প্রচার ও আয়—দুটি ক্ষেত্রেই নতুন দরজা খুলতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া অন্য জনপ্রিয় খেলাগুলোর কাছ থেকেও আইসিসি শিক্ষা নিতে চায়। টেনিস, বেসবল ও ফুটবলের মতো খেলাগুলো কীভাবে নিজেদের টুর্নামেন্ট, তারকা ও বাণিজ্যিক সম্পদকে সফলভাবে ব্যবহার করছে, তা বিশ্লেষণ করে ক্রিকেটেও সেসব কৌশল প্রয়োগের চিন্তা চলছে।
ফিকেশন মডেলের ওপর একটি আপডেট পাওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে ১৯০০ সালের পর প্রথমবার অলিম্পিকসে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হবে। যদিও আইসিসি বোর্ড একটি মহাদেশীয় কোয়ালিফিকেশন পদ্ধতিতে সম্মতি দিয়েছিল, তবু পুরুষ ও নারী উভয় বিভাগেই ছয়টি করে কোয়ালিফাই করা দলগুলোকে কীভাবে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হবে, সে সম্পর্কে সিইসির একটি বৃহত্তর ধারণা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিইসি ২০২৬ সালের এশিয়ান গেমস ও আফ্রিকান গেমস, প্যান অ্যাম গেমস এবং ২০২৭ সালের ইউরোপিয়ান গেমসে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অপারেশনাল আপডেটও পাবে।
অলিম্পিকে ক্রিকেটের যোগ্যতা নির্ধারণের পথ
আইসিসির প্রধান নির্বাহীদের কমিটি (সিইসি) লস অ্যাঞ্জেলেস ২০২৮ অলিম্পিকে ক্রিকেটের যোগ্যতা নির্ধারণ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার কথা রয়েছে। ১৯০০ সালের পর প্রথমবারের মতো ক্রিকেট অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আইসিসি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
আগেই আইসিসি বোর্ড মহাদেশভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ ব্যবস্থার অনুমোদন দিয়েছে। তবু পুরুষ ও নারী উভয় বিভাগেই ছয়টি করে দলকে কীভাবে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হবে, সে সম্পর্কে সিইসি আরও বিশদ ধারণা পেতে পারে।
এ বৈঠকে আরও আলোচনা হবে ২০২৬ সালের এশিয়ান গেমস, আফ্রিকান গেমস, প্যান আমেরিকান গেমস ও ২০২৭ সালের ইউরোপীয় গেমসে ক্রিকেট অন্তর্ভুক্তির প্রস্তুতি নিয়ে। এসব আয়োজন শুধু প্রতিযোগিতার সুযোগই নয়, বরং নতুন বাজারে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
সিইসি আসন্ন চারটি বড় আইসিসি টুর্নামেন্টের যোগ্যতা নির্ধারণের প্রস্তাবিত কাঠামো পর্যালোচনা করবে—২০২৭ সালের পুরুষদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ (দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়া যৌথ আয়োজক), ২০২৮ সালের পুরুষদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ (অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড), ২০২৭ সালের নারীদের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এবং ২০২৯ সালের নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এ ছাড়া ১৯ বছরের নিচের বিশ্বকাপে ৫০ ওভারের ফরম্যাট বজায় রাখার প্রস্তাবও আলোচনায় থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
২৩ সেপ্টেম্বর আইসিসি বোর্ড সর্বসম্মতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটের (ইউএসএসি) সদস্যপদ তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সংস্থাটি আইসিসি ও ক্রিকেটের সুনাম ক্ষুণ্ন করা এবং সদস্যপদ সম্পর্কিত নিয়ম মানতে ব্যর্থ হয়েছে।
আইসিসি বোর্ডের হাতে থাকা নথি অনুযায়ী, ইউএসএসি জুলাইয়ের বার্ষিক সম্মেলনে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যার মেয়াদ ছিল ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল নতুন বোর্ড নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু ইউএসএসি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। প্রথমে তারা দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক অংশীদার আমেরিকান ক্রিকেট এন্টারপ্রাইজের (এএসই) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে, এরপর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। সংস্থাটি জানায়, এটি তাদের আর্থিক পুনর্গঠনের অংশ।
আইসিসি বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। কারণ, তারা যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক কমিটির (ইউএসওপিসি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিল, যাতে ইউএসএসি ‘ন্যাশনাল গভর্নিং বডি’ (এনজিবি) হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট দলকে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে অংশ নিতে হলে ওই স্বীকৃতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইউএসওপিসি আগেই আইসিসিকে সতর্ক করেছিল, বর্তমান ইউএসএসি নেতৃত্বকে তারা এই স্বীকৃতি দেবে না, যতক্ষণ না সংস্থার কাঠামোগত সংস্কার হয় এবং বর্তমান বোর্ড পরিবর্তন হয়ে নতুন বোর্ড গঠিত হয়।
অক্টোবরে আইসিসি ইউএসএসিকে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানায়, স্থগিতাদেশ তুলে নিতে হলে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মানতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া থেকে ‘সন্তোষজনকভাবে’বেরিয়ে আসা। আইসিসি স্পষ্ট জানায়, দেউলিয়া ঘোষণা সদস্যপদের নিয়ম বিরোধী।
যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া আইনের অধীনে ইউএসএসিকে আগামী ছয় মাসের আর্থিক পরিকল্পনা আদালতে পেশ করতে হবে। কিন্তু আইসিসির স্থগিতাদেশের ফলে তাদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ইউএসএসি এখন আইসিসির সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজছে। আইসিসি জানিয়েছে, আপাতত তারা শুধু ক্রিকেটসংক্রান্ত কার্যক্রমে সীমিতভাবে অর্থ সহায়তা দেবে, প্রশাসনিক বা অন্য কোনো খাতে নয়।
ইউএসএসি আগামী শুক্রবার আইসিসি বোর্ডে চিঠি পাঠাবে বলে জানা গেছে, যেখানে তারা জানতে চাইবে—এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। আইসিসি বোর্ড সেই দিনই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।