টেপ টেনিস থেকে হারিস যেভাবে এক্সপ্রেস গতির বোলার

পাকিস্তানের পেসার হারিস রউফছবি: পিসিবি

আনপ্রেডিক্টেবল—পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে সবচেয়ে ক্লিশে কিন্তু সত্যি কথাটা বোধ হয় এটিই। জেতা ম্যাচও তারা যেমন হারতে পারে, আবার হারা ম্যাচও জিততে পারে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গতকাল রাতের ম্যাচটির কথাই ধরা যাক।

১২ বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৯ রান। তখনো হাতে আছে ৩ উইকেট। আগের ওভারে মোহাম্মদ হাসনাইনকে পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে ২৪ রান করেছেন লিয়াম ডসন। ম্যাচ তো সেখানেই শেষ! তবে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো, শেষ হয়ে হইল না শেষ! হতে দিলেন না হারিস রউফ।

১৯তম ওভারে দুই বলে ২ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের মুখ থেকে জয় কেড়ে নেন হারিস। গতি ও বাউন্সারের বিষে নীল বানিয়েছেন ইংলিশদের। ২ উইকেটসহ সেই তিনটি বল যেকোনো দলকে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ করে দিতে যথেষ্ট।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানকে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছেন হারিস
ছবি: এএফপি

হারিস দুর্ভাগা যে হ্যাটট্রিক বলটিতে উইকেট পাননি। ১৫৫ কিলোমিটার গতির বলটি স্টাম্প মিস করে যাওয়ায় বেঁচে যান রিচ টপলি। তবু শেষ রক্ষা হয়নি ইংল্যান্ডের। জেতার পথে থাকা ম্যাচটি তারা হারে ৩ রানে।

পেসারদের পুণ্যভূমি হিসেবে পাকিস্তানের পরিচিতিটা অনেক পুরোনো। ফজল মাহমুদ-সরফরাজ নওয়াজ-ইমরান খানদের পথরেখা অনুসরণ করে আবির্ভাব ঘটে ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিসের। ফাস্ট বোলিং শিল্প হয়, তবে এর সবচেয়ে বড় শিল্পী তো ওয়াসিম-ওয়াকাররাই। বলকে দিয়েই যেন কথা বলাতে শুরু করেছিলেন তাঁরা।

রিভার্স সুইংয়ের জাদুতে লম্বা সময় হতভম্ব করে রেখেছিলেন ক্রিকেটকে। এ দুজনের দাপটে লম্বা সময় অনেক সম্ভাবনাময় পেসার সামনেই আসতে পারেননি। আকিব জাভেদের মতো বোলারের ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি এ দুজনের কারণেই।

পরে অবশ্য সুইংয়ের জাদুর সঙ্গে গতির ঝড় নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল শোয়েব আখতারের। ওয়াসিম-ওয়াকার-শোয়েব—ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলিং ত্রয়ী। এর মাঝে অবশ্য আনাচকানাচে নষ্ট হয়েছে প্রচুর প্রতিভাও। তবু রুদ্ধ হয়নি পেসার তৈরির ধারা। যার ধারাবাহিকতায় পরে মোহাম্মদ আসিফ-মোহাম্মদ আমিররা এগিয়ে এসেছিলেন।

স্পট ফিক্সিংয়ের বিষ গিলে দুজন পর্দার আড়াল হলে মাঝে কিছু সময়ের বিরতি। এরপর কেবল উমর গুলই পাকিস্তানের ফাস্ট বোলিংয়ে ঐতিহ্যের ঝান্ডাটা কিছুটা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তবে মাঝের খরাটাও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শাহিন শাহ আফ্রিদি, মোহাম্মদ হাসনাইন, নাসিম শাহ ও হারিস রউফদের হাত ধরে ফাস্ট বোলিংয়ে নতুন ধারার হার্ড রক গান শুনতে শুরু করেছে পাকিস্তানের ক্রিকেট।

মাঠের বাইরে শাহিন-নাসিমদের মতো ক্যারিশমাটিক ধারার বোলারদের বিপরীতে রউফ অবশ্য খানিকটা সাদামাটাই। সংবাদমাধ্যমে কিংবা বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায়ও তাঁকে নিয়ে আলাপ কম। তবে টি–টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বোলিং লাইনে এ মুহূর্তে আন সাং হিরো যেন হারিসই।

হারিসের উদ্‌যাপন
ছবি: টুইটার

১৯৯৩ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম। পিন্ডিকে নিশ্চয়ই ক্রিকেটপ্রেমীদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। শোয়েব আখতারের কল্যাণে এই নামটি ক্রিকেটবিশ্বে বিখ্যাত হয়েছে আরও আগে। সর্বকালে সর্বোচ্চ দ্রুতগতিসম্পন্ন শোয়েবকে যে মানুষ চেনেই ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ নামে।

গতিতে তাই একই অঞ্চলের শোয়েবকে টেক্কা দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিয়েই যেন ক্রিকেটে এসেছেন হারিস। প্রতি ঘণ্টায় ১৫০-১৫৫ কিলোমিটার গতিতে বল করা যেন তাঁর হাতে মোয়া।

হারিসের অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার কথাই ছিল না। যখন তিনি ইসলামাবাদ মডেল কলেজের ছাত্র, তখন থেকে খেলাধুলা নিয়ে আগ্রহ। শুরুতে খেলতেন টেপ টেনিস বল দিয়ে। পাড়া-মহল্লার ক্রিকেটে বেশ সুনাম কুড়ান। তবে ক্রিকেট থেকে আবার ফুটবলের দিকেই ঝোঁকটা ছিল বেশি। স্কুলকে ফুটবলে শিরোপাও জিতিয়েছিলেন।

২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে হারিস তখন একটি মুঠোফোনের দোকানে কাজ করতেন, কোচ তাঁকে গুজরানওয়ালাতে লাহোর কালান্দার্সের ট্রায়ালে অংশ নিতে বলেন। শুরুতে তাঁর এই ট্রায়ালে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না।

আরও পড়ুন

পরে অবশ্য ট্রায়ালে অংশ নেন এবং কোচ আকিব জাভেদের চোখে পড়েন। আকিবই মূলত বদলে দিয়েছেন হারিসকে। সেই ট্রায়াল থেকে যান অস্ট্রেলিয়া। ২০১৮ সালে আবুধাবি টি-টোয়েন্টি ট্রফির জন্য লাহোর কালান্দার্স দলে ডাক পান হারিস। এভাবেই পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর আগমন। ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় দলের পথটা অবশ্য খুব দীর্ঘায়িত হয়নি। ২০২০ সালে জানুয়ারিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় তাঁর।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম আলোয় আসেন আরব আমিরাতে গত বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে। তার আগে অবশ্য সময়টা ভালো যাচ্ছিল না হারিসের। বাজে পারফরম্যান্সে দলে জায়গাও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তবে কোচ ও মেন্টর আকিবের মন্ত্রে ছন্দ খুঁজে নিয়ে আবার ফিরে আসেন দলে। আকিবের সাহায্য নিয়ে ইয়ার্কারগুলোকেও শাণিত করে নেন এ পেসার।

মাঝে নিজের পছন্দের বোলার ডেল স্টেইনের মতো গতিময় আউটসুইং করার চেষ্টাও চালাতে থাকেন। তবে আকিবের বাধায় সে পথ থেকে সরে আসেন। আকিব তাঁকে বলেন, স্টেইন হতে গিয়ে নিজের শক্তির জায়গা হারিয়ে ফেলেছেন হারিস।

কালান্দার্স কোচ সে সময় বলেছিলেন, ‘তোমাকে সেটাই করতে হবে, যে জন্য তোমাকে সবাই চেনে। তোমাকে চোখ রাখতে হবে পায়ের আঙুল এবং মাথায়। সময় এলে স্টেইন হতে পারবে, এখন না।’ গুরুর মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ফাইনাল খেলার অন্যতম নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন হারিস।

ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে হারিস
ছবি: টুইটার

বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে আর ভুল করেননি। ৬ ম্যাচে ৮ উইকেট নেওয়া হারিস টুর্নামেন্টে নিজের অর্ধেক ওভার করেছেন ইনিংসে শেষের দিকে (১৬-২০ ওভার)। তাঁর ইকোনমি ছিল ৬.৮।

পাশাপাশি শাহিন শাহ আফ্রিদির সঙ্গে গড়ে তোলেন বিধ্বংসী এক জুটি। যদিও শাহিনের তারকাখ্যাতিতে কিছুটা আড়ালেই থেকে যান হারিস। এই এশিয়া কাপেও শাহিনের অনুপস্থিতি বুঝতে দেননি হারিস। বিশ্বকাপের মতো এই প্রতিযোগিতাতেও ছয় ম্যাচে নিয়েছে ৮ উইকেট। আর চলমান ইংল্যান্ড সিরিজে ৪ ম্যাচেই নিয়েছেন ৬ উইকেট।

বাবর-রিজওয়ান-শাহিনদের হাত ধরে পাকিস্তানের ক্রিকেটে যে নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব তারই অন্যতম সারথি হারিস। ফাস্ট বোলিংয়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘এক্সপ্রেস গতি’র অন্যতম বিজ্ঞাপনও বটে। বয়স অবশ্য ২৮ পেরিয়ে গেছে। ফাস্ট বোলার হিসেবে বয়সটা একেবারে কম না।

আরও পড়ুন

তবে যেটুকু সময় হাতে পাবেন, তাতেই ক্রিকেট মানচিত্রে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার পূর্ণ রসদ আছে হারিসের। উন্নতির জায়গাও অবশ্য কম নয়। কদিন আগে তাঁকে লাইন–লেংথ ঠিক করতে বলেছিলেন পিসিবি সভাপতি রমিজ রাজা। ওয়ানডেতে জায়গাও এখনো থিতু করতে পারেননি। তাই যা করার দ্রুতই করতে হবে।

তবে হারিসের সুবিধা হচ্ছে, গতির সঙ্গে যে মাথাটাও ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারেন। এখন শুরুতে বলা পাকিস্তান ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার ফাঁদটা এড়ানোটাই হবে হারিসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।