পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমে মারামারি, রাজনীতি এবং রক্ত দিয়ে লেখা প্রেমপত্র

লম্বা দৌড় শেষে ব্যাটসম্যানের দিকে তেড়েফুঁড়ে বল ছুড়ে মারা—এই ছিল মাঠের শোয়েব আখতারের চেনা চেহারা। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণিল চরিত্রগুলোর একটি পাকিস্তানের এই ফাস্ট বোলার। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে দলে অভিষেক, খেলেছেন ২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস নামে পরিচিত এই ফাস্ট বোলার অবসরের কয়েক মাসই পরই প্রকাশ করেন ‘কন্ট্রোভার্সালি ইয়োরস’ নামের আত্মজীবনী। বইয়ের ‘দ্য ড্রেসিংরুম’ অংশে শোয়েব তুলে ধরেছেন পাকিস্তান দলের ভেতরের নানা মজার ঘটনা, রাজনীতির ঘটনা। আছে পাকিস্তান দলে ধর্মচর্চা, এমনকি নিজের স্বার্থপরতার কথাও। আর পুরোটা জুড়েই আছে দিলখোলা শোয়েবের ছাপ, যে শোয়েব উইকেটশিকারের পর দু হাত ছড়িয়ে দিতেন।

কী লিখেছেন শোয়েব আখতার

পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমে প্রথমবার পা রাখতেই আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। পুরো পরিবেশটাই ছিল বিষাক্ত। প্রায় সব সিনিয়র খেলোয়াড় হয় শুধু আমার ও অন্য জুনিয়রদের সঙ্গে চিৎকার–চেঁচামেচি করছে, আর না হয় বসে বসে টিম ম্যানেজমেন্টকে গালি দিচ্ছে, আর বলছে কীভাবে তাদের সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে।

আমার ভাবনা ছিল সোজা—বোর্ড আমাকে বেছে নিয়েছে। মাজিদ খান (পিসিবির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী) আমার ওপর এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি বলেছিলেন, আমাকে খেলানো না হলে তিনি অর্ধেক সিনিয়র খেলোয়াড় দল থেকে বের করে দেবেন। যে কারণে বোর্ড নিয়ে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। বরং আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়ায় বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞই ছিলাম।

কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, এই নেতিবাচকতা দলেরই স্বাভাবিক চেহারা। তখন নিজেকে মানসিকভাবে আলাদা করে নিলাম। শুরুতে দেশের হয়ে খেলতে পেরে এতটাই আনন্দে ছিলাম যে কোনো কিছুই স্পৃহাকে নষ্ট করতে পারত না। পরে বুঝলাম, এই দূরত্ব রাখাটা দরকার ছিল।

আমার মতো শহীদ আফ্রিদি, আজহার মেহমুদ, সাকলাইন মুশতাক, শহীদ নাজির, আব্দুর রাজ্জাক, সেলিম এলাহীরাও ড্রেসিংরুমের রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখত। আমরা একসঙ্গে থাকতাম, বন্ধুও হয়ে উঠলাম বাকি জীবনের জন্য। আমরা তখন এত বেশি একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি যে আমাদের পরিবারও হয়তো আমাদের এতটা চিনত না।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে।
ফাইল ছবি: এএফপি

সেই সময়গুলো ছিল দারুণ। আমি প্রায়ই ওদের সঙ্গে মজা করতাম—বিশেষ করে নেট প্র্যাকটিসের সময়। কেউ হয়তো বল ধরতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি পেছন থেকে ট্রাউজার টেনে নামিয়ে দিতাম।

আফ্রিদি ঘুমাতে ভালোবাসত। ড্রেসিংরুমে একটা কোনা খুঁজে নিয়েছিল সে, যাতে কারও চোখে না পড়ে, বিশেষ করে অধিনায়কের। একদিন আমি খুব ক্লান্ত, একটু ঘুম দরকার। কিন্তু আফ্রিদিকে জাগানো বা সরানো তো সোজা নয়। আমি গিয়ে আফ্রিদির গা ধরে ঝাঁকি দিলাম, বললাম ‘ওয়াসিম ভাই তোমাকে খুঁজছে।’

সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, আমি গিয়ে তার জায়গায় শুয়ে পড়লাম!

ম্যাসাজ নেওয়া ছিল আরেকটা যুদ্ধ। কেউ কেউ সব সময় ম্যাসাজ নিত, বাকিরা বসে বসে অপেক্ষা করত। আমি ভাবলাম, এভাবে তো চলবে না! একদিন আমি ইচিং পাউডার এনে ম্যাসাজ অয়েলে মিশিয়ে দিলাম। তারপর কী হাসির কাণ্ড—ওরা খুব দ্রুতই ম্যাসাজ ছেড়ে দিল। আমি অবশ্য ধরা পড়ে গিয়েছিলাম, তখন বকা খেতে হয়েছে।

জাভেদ মিয়াঁদাদ একদিন হঠাৎ ঝড়ের মতো ড্রেসিংরুমে ঢুকে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘তোমরা ম্যাচ ফিক্সিং করেছ।’ আমরা তো অবাক। বললাম, ‘জাভেদ ভাই, আমরা তো ম্যাচ জিতেছি!
শোয়েব আখতার

আমাদের সবার সমুদ্রে সাঁতার ভালো লাগত। সাঁতার কাটতে গিয়ে আমি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম, তারপর হঠাৎ ডুব দিয়ে কারও পা টেনে ধরতাম। ওরা ভাবত, হাঙর এসে গেছে! ওদের চিৎকার শুনে আমি হেসে কুটি কুটি হতাম। ওরাও অবশ্য সুযোগ পেলে আমাকে ছাড়েনি।

একবার সবাই মিলে ঠিক করলাম, আমরা সূর্যস্নান করব। আল্লাহ আমাদের এমনিতেই সুন্দর তামাটে রং দিয়েছেন। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম কাপড় খুলে সেন্ট লুসিয়ার সৈকতে ন্যাংটা হয়ে ঘুরব, সাঁতার কাটব, ঘুমাব।

দুই দিন পরই অবস্থা খারাপ। পিঠে বিশাল বিশাল ফোসকা, ঘুম মানেই যন্ত্রণা! আমি তখন রাতভর বসে থাকতাম, কার কখন ঘুম আসে আর ওর হাতে গরম পানি দিয়ে জাগিয়ে দেব।

আর এখন? এখন রোদে বের হলে সানব্লক লাগাই—দেখতে যত বাজেই লাগুক!

মাঠে সতীর্থদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে মজা করতেন শোয়েব আখতার। ২০১১ সালের ছবি।
ফাইল ছবি: এএফপি

একবার এক ভয়ংকর মজার ঘটনা ঘটেছিল সাকলাইন মুশতাক আর জাভেদ মিয়াঁদাদের মধ্যে। সাকলাইন তখন দারুণ খেলছিল, কিন্তু কোথায় যেন শুনল তাকে পরের ম্যাচে বাদ দেওয়া হবে। অস্থির হয়ে কোচ মিয়াঁদাদকে ফোন করল—কেন এমনটা হতে যাচ্ছে? কিন্তু তেমন কোনো জবাব পেল না।

পরদিন সকালে দেখি, সাকলাইন মুখ কালো করে এক কোণে বসে আছে, আর চোখ বড় করে মিয়াঁদাদকে যেন গিলে খাচ্ছে। মিয়াঁদাদ দেখি খুব শান্ত, সচরাচর যা দেখা যায় না। আমরা বুঝে গেলাম, আজ কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই সাকলাইন লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমাকে কেন বাদ দেবে? কারণ বলো!’ ব্যাটটা হাতে তুলে নিয়ে মিয়াঁদাদের দিকে ছুটেও গেল। মিয়াঁদাদ জান বাঁচাতে দিলেন এক দৌড়। সোজা চলে গেলেন বোর্ড চেয়ারম্যানের অফিসের দিকে, পেছনে ব্যাট হাতে ক্ষুব্ধ সাকলাইন! আমরা সবাই হাসতে হাসতে দুজনের পেছনে দৌড়াতে লাগলাম।

প্রথমে মিয়াঁদাদ ঢুকলেন, একে একে আমরাও ঢুকে পড়লাম চেয়ারম্যানের কক্ষে। সাকলাইনের হাতে ব্যাট, মিয়াঁদাদকে কিছু একটা ‘শিক্ষা’ দেবে। মিয়াঁদাদের তখন এমনিতেই বিধ্বস্ত অবস্থা, খেলোয়াড় তেড়ে এসেছে কোচ মারার জন্য! এ দিকে আমাদের হাসি দেখে তাঁর মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।

নামাজের সময় হলেই ড্রেসিংরুম ফাঁকা হয়ে যেত! কেউ হঠাৎ বাথরুমে ঢুকে যেত, কেউ আবার মনে করত তার কোনো কাজের তাড়া আছে।
শোয়েব আখতার

ঠিক তখনই এলেন ক্রিকেটের দুই ভদ্রলোক ইনজামাম উল হক আর সাঈদ আনোয়ার। তাঁরা এসে সাকলায়েনকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন, মিয়াঁদাদকে মাফ করে দাও। তাঁরা হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিতে শুরু করলেন, ‘ভাই, এই হাদিসে বলা হয়েছে, ক্ষমা করে দাও।’

এক পাশ থেকে ক্ষুব্ধ মিয়াঁদাদ বললেন, ‘আমার পক্ষে কোনো হাদিস নাই? আমি তো মার খাচ্ছি!’

ওরা খুব সিরিয়াসভাবেই বললেন, হ্যাঁ আছে! বলা হয়েছে আপনি বড়, তাই আপনাকেই ক্ষমা করতে হবে।’ আমরা সবাই আবার হাসতে শুরু করলাম।

আরেকটা ব্যাপার ছিল একসঙ্গে নামাজ পড়া—দলের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু নামাজের সময় হলেই ড্রেসিংরুম ফাঁকা হয়ে যেত! কেউ হঠাৎ বাথরুমে ঢুকে যেত, কেউ আবার মনে করত তার কোনো কাজের তাড়া আছে। আমার নিজের হাঁটু দিন শেষে একেবারে লক হয়ে যেত, তাই সিজদায় যাওয়া খুব কষ্টকর ছিল—আমিও ‘নিখোঁজ’ হওয়া দলে ছিলাম।

কিন্তু ইনজামাম ছিলেন নামাজ অন্তঃপ্রাণ। তিনি রুমে রুমে ঘুরে সবাইকে খুঁজে বের করতেন! কেউ কেউ তো সরাসরি ক্লাব থেকে এসে ফজরের নামাজে শরিক হতো।

দলের সবাইকে নামাজের জন্য তাড়া দিতেন ইনজামাম উল হক, বলেছেন শোয়েব।
ফাইল ছবি: এএফপি

আরও একটা মজার ঘটনা মিয়াঁদাদকে নিয়ে। একদিন হঠাৎ ঝড়ের মতো ড্রেসিংরুমে ঢুকে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘তোমরা ম্যাচ ফিক্সিং করেছ।’ আমরা তো অবাক।

বললাম, ‘জাভেদ ভাই, আমরা তো ম্যাচ জিতেছি! তিনি থামতে নারাজ। কিছু খেলোয়াড়দের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘না না, তোমরা ফিক্সিং করেছ।’ পুরো ব্যাপারটা এতটাই হাস্যকর ছিল যে আমরা হাসতে হাসতে মাটিতেই পড়ে গেছি।

এই ঘটনা ঘটেছিল শারজায়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে। আমি নিজেও খুব ভালো করেছিলাম। আমরা টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম, কিন্তু মিয়াঁদাদ এখনো বিশ্বাস করেন যে আমরা ফিক্সিং করেছি!

সত্যি কথা বলতে কি, যখন দল ভালো খেলত, জিতত, তখন ড্রেসিংরুমটাই ছিল সবচেয়ে মজার জায়গা। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সময় আমরা এত আনন্দে থাকতাম যে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ত না। সিনিয়ররা হাসিখুশি থাকত, আমাদের দুষ্টুমি সহ্য করত—একজন আরেকজনকে পানি ছুড়ে মারা, ঠাট্টা-তামাশা, হাসাহাসি।

ম্যাচের পরেও আমরা একসঙ্গে থাকতে চাইতাম। ক্লাবে যেতাম, বাইরে ডিনার করতাম। সত্যি বলতে কি, আমাদের দলে সবচেয়ে রসিক লোকেরা ছিল—ওয়াসিম আকরাম , ওয়াকার ইউনিস , মইন খান—সবাই দারুণ হাস্যরসের মানুষ।

রাত দুইটায় মুশতাক গিয়ে দাঁড়াল রুম ২০১-এর দরজায়, ধাক্কা মারছে আর বলছে, ‘ভাই, দরজা খোল, আমি চলে এসেছি।’ ভেতর থেকে হঠাৎ এক বিশাল গর্জন—‘তুই কে রে, এই সময় দরজায় ধাক্কা মারতেছিস?’
শোয়েব আখতার

একবার সেন্ট ভিনসেন্টে, ক্যারিবিয়ানে, আমরা তিনজন—ওয়াসিম, মইন আর আমি বাজি ধরলাম, দুই দ্বীপের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার সাঁতরে পার হব।

সাঁতার শুরু করলাম, কিন্তু মাঝপথেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে হলো দ্বীপটা যেন আর আসেই না! তখন ভয়ের মধ্যে একে অপরকে উৎসাহ দিয়ে বলতে শুরু করলাম, ‘ব্যাপার না, শাবাশ, আর একটু!’

এরপর কীভাবে যেন পৌঁছালাম! তীরে উঠে বালুতে লুটিয়ে পড়লাম, শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ভাবতে বসলাম, এখন ফিরব কীভাবে? তারপর যখন একটু শক্তি ফিরে পেলাম, আমরা হাত নাড়তে শুরু করলাম। সৈকতে লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলাম, ‘প্লিজ, আমাদের সাহায্য কর।’

পরে অনেকেই আমাদের বলত, সেদিন দূর থেকে আমাদের চিৎকার, লাফ–ঝাঁপ দেখে তারা খুবই মজা পেয়েছিল!

আরেকবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে, আমি জেট স্কিতে উঠেছিলাম, পেছনে ওয়াসিম ভাই বসা। হঠাৎ ঢেউয়ে ঝাঁক খেয়ে ওনার সানগ্লাস পানিতে পড়ে গেল। উনি বললেন, ‘লাফিয়ে পড়ে তুলে আনো!’

আমি বললাম, ‘ওয়াসিম ভাই, মাথা ঠিক আছে? এটা গভীর সমুদ্র!’

শেষমেশ, তাঁর জেদের সামনে হেরে গিয়ে লাফিয়ে পড়লাম পানিতে, উনিও পড়লেন। অনেক খুঁজেও সানগ্লাস পাইনি। তারপর যখন ফিরলাম জেট স্কির দিকে, দেখি ওটা তো অনেক দূরে ভেসে গেছে!

তারপর ছিল মুশতাক আহমেদ। কার্ড খেলতে খুব পছন্দ করত সে। এক রাতে সে মইনকে ফোন দিল, বলল যে সে ব্ল্যাকজ্যাক খেলতে গিয়ে সব টাকা হারিয়ে ফেলেছে। এখন আরেকবার খেলে সব ফিরে পেতে চায়, তাই কিছু টাকা ধার চায়।

মইন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রাত তো দুইটা বাজে, আর আজই দিনে আমাদের ম্যাচ আছে। এই সময়ে কার্ড খেলছ কেন?’

কিন্তু মুশতাক অনুনয় করে যেতে লাগল, টাকা চাইতেই থাকল। শেষে মইন বলল, ‘আচ্ছা, ওপরে দ্বিতীয় তলায় রুম ২০১-এ চলে আয়।’

তো রাত দুইটায় মুশতাক গিয়ে দাঁড়াল রুম ২০১-এর দরজায়, ধাক্কা মারছে আর বলছে, ‘ভাই, দরজা খোল, আমি চলে এসেছি।’

ভেতর থেকে হঠাৎ এক বিশাল গর্জন—‘তুই কে রে, এই সময় দরজায় ধাক্কা মারতেছিস?’

মুশতাক গলা চড়িয়ে বলল, ‘মইন, অভিনয় করো না—দরজা খোল।’

পরে মুশতাক বলেছিল, দরজা খুলেছিল এক দানবের মতো লোক। ক্ষমা চাইতে চাইতে সে দৌড়ে পালিয়েছে।

মুশতাক আহমেদ এখন বাংলাদেশ দলের স্পিন বোলিং কোচ (ডানে)।
শামসুল হক

ইয়াসির হামিদ বা আমাদের আদরের ‘বাদশা’, সবার মাঝে সবচেয়ে হাস্যকর চরিত্র ছিল। ওর শর্ট-টার্ম মেমোরি একেবারেই ছিল না, যার কারণে ও নিজে তো বিপদে পড়তই, আমাদেরও ফাঁসিয়ে দিত।

একবার আমরা সবাই এক সমুদ্ররিসোর্টে ছিলাম, একটু বিশ্রামে। তখন বাদশা আর কামরান আকমল জেট-স্কি করতে গেল। আকমল বলল, সে একটু সাঁতার কাটবে। বাদশাকে বলে গেল—‘তুই কাছেই থাকিস, আমি পরে উঠব।’

বাদশা নাকি আজও বলে, তার কোনো খারাপ নিয়ত ছিল না। কিন্তু কীভাবে যেন আকমলের কথা ভুলে উল্টো দিকে চলে গেল।

ভাগ্য ভালো, কাছাকাছি কেউ ছিল, যারা একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া আকমলকে তুলে আনে—মাঝসমুদ্রে সে জীবন বাঁচাতে হাত নাড়িয়েছিল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে, আমাকে বাঁচাও।’

পরে আকমল কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ওই বাদশা, তুই আমার সঙ্গে এমন করলি কেন?’ বাদশা বলে, ‘ভাই রে, আমি তো তোকে ভুলেই গেছিলাম। দুঃখিত!’

আরেকবার, বেঙ্গালুরুতে এক টেস্ট ম্যারে মধ্যে বাদশা হঠাৎই ব্যাটিং থেকে সরে গেল। বোলার ছিল ইশান্ত শর্মা। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? বাদশা শান্তভাবে বলল, ‘আমার গার্ড পরা হয়নি।’

ম্যাচ বন্ধ রেখে বাদশাকে ঠিকভাবে গার্ড পরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

ইয়াসির হামিদকে ডাকা হতো বাদশা নামে।
ফাইল ছবি: এএফপি

প্রতিটা সফরেই আমাদের দলের কমপক্ষে পাঁচ-ছয়টি আশিকের হৃদয়ে প্রেমের ঝড় বয়ে যেত। তারা ভালোবাসায় এতটাই ডুবে যেত যে, বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিত, চিরদিন একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিত। এই সব রোমিওরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে প্রেমের চিঠি পড়ত, আবার পরের সফরেই নতুন কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে যেত!

সিডনিতে একবার কি দেখলাম—ড্রেসিং রুমের ভেতরে আটজন ছেলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর বাইরে ষোলোটি মেয়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই হৃদয়ভাঙার নাটকটা এয়ারপোর্টেও চলত!

এক খেলোয়াড় তো এমন একটা চিঠি পেল, যা এক মেয়ে তার রক্ত দিয়ে লিখেছিল। সে তখন এক বেয়ারার রক্ত নিয়ে পাল্টা চিঠি লিখল! আমি বললাম, ‘এটা কেমন কাজ রে ভাই, অন্তত একটা মুরগির রক্ত ব্যবহার করতি।’

আমারও পেছনে পাঁচ–ছয়জন ‘স্টকার’ (উত্ত্যক্তকারী) লেগে গিয়েছিল। আমি তাদের আফ্রিদি বা সাকলাইনের দিকে চালান করে দিতাম। একবার এক মহিলা আমাকে হোটেলের করিডরে কোণঠাসা করে ফেলল। আমি কৌশলে ওকে বোঝালাম আফ্রিদিই তার সত্যিকারের মানুষ, আর ওর রুম নাম্বারও দিয়ে দিলাম!

আমি দৌড়ে পালানোর সময় শুনতে পেলাম সে চিৎকার করছে, ‘আফ্রিদি-ইইইইই!’ এরপর কয়েক দিন আমি আফ্রিদির সামনে পড়া এড়িয়ে চলতাম।

আমরা ছিলাম হইচইপূর্ণ একটা দল, ফলে ড্রেসিংরুমে মাঝেমধ্যে ইনজুরিও হতো। কেউ জিতে গিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরত, তাতেই পেশি কিংবা হাড়ে টান খেত।

ইনজির অধিনায়কত্বের সময়ে সবাই বুঝে গেল আমি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ, আর আমিই জানি কোথায় গেলে মজা হয়। তখন থেকেই ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড—সব সফরের ঘোরাঘুরির দায়িত্ব পড়ে গেল আমার ওপর। বাইরে গেলে দল যেন ড্রেসিংরুমের চাপ ঝেড়ে ফেলতে পারত। কেউ ফিশিং করত, কেউ সাঁতার কাটত, কেউ শুধুই দুষ্টুমি করতাম।

২০০৭ সালে আফ্রিদি অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বাদ দিয়ে শোয়েব মালিককে অধিনায়ক বানানো হলো। পরামর্শটা ছিল ওয়াসিম আকরামের।

আগেও বলেছি, ওয়াসিম, ওয়াকার, ইনজি, মইন—তাদের সবার হাস্যরস ছিল চমৎকার। ওরা ভালো মুডে থাকলে ড্রেসিংরুম হাসিতে ফেটে পড়ত। তবে যখন দল খারাপ করত, তখন ওটাই হয়ে উঠত ভয়ংকর জায়গা। তখন সবাই রেগে যেত। কেউ কাউকে মারত, নিরাপত্তারক্ষীকে মারত, পুলিশকে পর্যন্ত ছাড়ত না।

আমাদের সিনিয়ররাই যখন রেগে যেত, তখন আমরাও তাদের মতো হয়ে যেতাম। কোচ বা পিসিবি কেউ মাথা ঘামাত না। আর অধিনায়কেরাও খুব একটা গুরুত্ব দিত না। ওরা বেশি ভাবত নিজের ক্যাপ্টেন্সি ধরে রাখার কথা, দল গঠনের কথা না। দল খারাপ করলে অধিনায়ক বদলানো ছিল রুটিন ব্যাপার।

সরকার নিজের পছন্দের লোককে বোর্ডের চেয়ারম্যান বানায়, আর সে বোর্ডের হয়ে পছন্দের অধিনায়ক বানায়। এমন অধিনায়ক, যে বোর্ডের কথা মেনে চলবে। যার ফলে অনেক সময় অযোগ্য লোকও অধিনায়ক হয়ে যেত।

যেমন ২০০৭ সালে আফ্রিদি অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বাদ দিয়ে শোয়েব মালিককে অধিনায়ক বানানো হলো। পরামর্শটা ছিল ওয়াসিম আকরামের।

তারা এমন একজনকে চেয়েছিল, যাকে দিয়ে সিনিয়রদের বাদ দেওয়া যাবে। তারা রাজ্জাককে টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ দিল, অথচ ওর খেলা এই ফরম্যাটের জন্য একদম পারফেক্ট ছিল। আফ্রিদিও দল ছাড়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল ম্যানেজার তালাত আলীর সঙ্গে ঝগড়ার কারণে।

আমি সাধারণত এসব ঝামেলায় থাকি না, কিন্তু এবার বুদ্ধিমানের মতো আফ্রিদির পাশে দাঁড়ালাম—ওর দলে থাকা নিশ্চিত করলাম।

ইশ, আমরা যদি আগেই এক হয়ে প্রতিবাদ করতাম! পাঁচজন—মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনিস খান, আফ্রিদি, রজ্জাক আর আমি—সবাই মিলে প্রতিবাদ করে দল ছেড়ে দিলে ভালো হতো। এখন আফসোস হয়, ওই সময় আমরা ঐক্য দেখাতে পারিনি।

শোয়েব মালিক ঠিকই আমাদের একে একে দল থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যত দিন না সে নিজেই বাদ পড়ে। সে ছিল বোর্ডের পুতুল। তার সময় একের পর এক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দল কীভাবে উন্নতি করবে?

শোয়েব মালিককে অধিনায়ক করা হয়েছিল সিনিয়র বাদ দেওয়ার জন্য—এমনটাই দাবি শোয়েব আখতারের।
ফাইল ছবি: এএফপি

দল গড়ে ওঠে ড্রেসিংরুমে, আর এর সাফল্য নির্ভর করে অধিনায়কের যোগ্যতা ও যত্নশীলতার ওপর। আমাদের সেই পিতার মতো একজন অধিনায়ক বা কোচ লাগত—যাকে আমরা কখনো পেলাম না।

পাকিস্তান দলে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই এসেছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবার থেকে, যাদের শিক্ষাজীবনের সুযোগ ছিল না। তাই আমাদের কাছে ক্রিকেটই যেন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সেখান থেকেই আমরা ইংরেজি বলা, গাড়ি চালানো, আচার-আচরণ সব শিখি। ফলে আমরা অনেকটাই সহজ-সরল ও প্রভাবিত হওয়ার মতো থাকি, এবং আমাদের একজন শক্তিশালী ও সদিচ্ছাসম্পন্ন মেন্টরের দরকার হয়, যে আমাদের রক্ষা করবে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করবে।

আমার দৃষ্টিতে, এমন একজন মানুষ ছিলেন ইমরান খান—আমাদের সেরা অধিনায়ক। তিনি অসাধারণ এক বোলার এবং অলরাউন্ডার ছিলেন, যিনি ওয়াসিম ও ওয়াকারের মতো কিংবদন্তি প্রতিভাদের গড়ে তুলেছেন। নিঃস্বার্থ, পরিশ্রমী ও নেতৃত্বগুণে ভরপুর ইমরান আমাদের জন্য একটা উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি একটি নির্ভীক ও বিজয়ী দল গঠন করেছিলেন।

কিন্তু যখন আমি পাকিস্তান দলে যোগ দিই, তখন দলের মধ্যে কোনো দলীয় চেতনার অস্তিত্বই ছিল না। কারণটা বোঝার জন্য কোনো রকেট সায়েন্স লাগে না। দলে ছিল রাজনীতি, পেছনে ছুরি মারা, হিংসা—সবাই যেন বাঁচার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, অনেক সময় এই বিশৃঙ্খলার উৎস ছিল বা অন্তত উৎসাহদাতা ছিলেন অধিনায়ক নিজেই। অবাক লাগে, ইমরান খানের মতো একজন আদর্শ মেন্টরের অধীনে খেলা সত্ত্বেও তাঁর পরবর্তী অনেক অধিনায়কই ছিলেন উদাসীন।

পিসিবি এবং তাদের ম্যানেজারদের অধিনায়কদের প্রতি আচরণ দেখলে বুঝি, এই দায়িত্ব কতটা চাপে ভরা। এ চাপ সামলাতে পারে কেবল একজন দৃঢ়, মানসিকভাবে দৃঢ়চেতা মানুষ। ওয়াসিম সেই যোগ্যতা রাখতেন, ইমরানের উত্তরসূরি হতে পারতেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন।

পাকিস্তান দলে শোয়েব আখতারের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন ওয়াসিম আকরাম। ছবিটি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে।
ফাইল ছবি: এএফপি

একসময় ইনজামাম দলকে একত্রিত রাখতে পেরেছিলেন। যদিও আমাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না, তবু সেটা দলের কাজে বাধা দেয়নি—একসময় আমরা তাঁর অধীনে ভালো খেলছিলাম। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল, যা ড্রেসিংরুমের পরিবেশ পাল্টে দিল।

আমার বিশ্বাস, নামাজ প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। প্রত্যেক মুসলমান জানে নামাজ না পড়লে তাকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু বড় মানুষদের—যারা নিজেদের মতো বুঝে চলে—বাচ্চাদের মতো জোর করে নামাজ বা জিকিরে বাধ্য করা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়।

সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন কেউ ভাবতে শুরু করে যে সে সঠিক পথে এসেছে, তাই সবাইকেও তার মতোই হতে হবে। আমার মতে, এটা অহংকারের একটা রূপ। যদি আপনি নিজে নিজেকে সংশোধন করতে পারেন, তাহলে অন্যরাও পারে। কারও ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিলে আল্লাহর দয়ার জায়গাটা হারিয়ে যায়।

কিন্তু কেউ কেউ ভাবত এটাই দলকে এগিয়ে নেওয়ার পথ। রোজা, নামাজ, তাবলিগ—সব যেন দলীয় বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে পরিণত হলো। কেউ কেউ নিজের রুমে একা নামাজ পড়তে চাইলেও বাধা পেত। হুমকি দেওয়া হতো—দলীয় নামাজে না এলে দল থেকে বাদ দেওয়া হবে।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যারা দলীয়ভাবে নামাজ পড়ত, তাদের অন্তত ১০ জন পড়ত দল থেকে বাদ পড়ে যাবার ভয়ে। এমনও বলা হতো, ‘যদি দলীয় নামাজ পড়ো, তাহলে দলে সুযোগ পাবে, ভালো চোখে দেখা হবে’—এটা তো অদ্ভুত!

ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে কখন ও কীভাবে নামাজ পড়তে হয়। ইসলাম তো পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতার ওপর দাঁড়িয়ে! অথচ দল যখন একসঙ্গে নামাজে বসত, বাথরুমের মেঝে ভিজে যেত, টিস্যু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকত—ঘেন্না ধরার মতো অবস্থা। ইসলাম তো পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কথাই বলে।

আমি একা দৌড়ে দল জেতাচ্ছি, এতেই তো যথেষ্ট। চাপমুক্ত, স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম, এটা ছিল ভীষণ স্বার্থপরতা। পাকিস্তান ক্রিকেটে আমাকে দরকার ছিল, কিন্তু আমি হতাশ করেছি।
শোয়েব আখতার

আমরা বিমানেও নামাজ পড়তে শুরু করলাম। যদিও এটা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভ্রমণকালে নামাজের ছাড় আছে। একবার তো এমন অবস্থা হলো, পানি ছড়িয়ে পড়ল বিমানে বসার মাঝপথে। সবাই অভিযোগ জানাল, তখন আমাদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হলো। এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল—পুরো দল একসঙ্গে উঠে পড়ে দৌড়াদৌড়ি করত, একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে নামাজ পড়ত। অথচ বসে বা দাঁড়িয়েও নামাজ পড়া যায়, কিন্তু অন্যদের বিষয়ও মাথায় রাখতে হয়। ইসলাম তো অন্যদের প্রতি যত্নবান হতে বলে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নামাজ একজন মুসলমানের অলংকার। এটা হৃদয়ের পবিত্রতা নিয়ে গর্বের সঙ্গে পড়া উচিত। তবে আপনি আল্লাহর আর যেসব দায়িত্ব পালন করা উচিত, তা এড়িয়ে যেতে পারেন না। একজন ক্রিকেটারের মূল দায়িত্ব ক্রিকেট খেলা। যদি মনে হয় ক্রিকেটের গুরুত্ব কম, তাহলে সেটা ছেড়ে দিন—বেরিয়ে পড়ুন, ইসলাম প্রচার করুন, সেটাই হয়তো আপনার বেশি উপকারে আসবে।

আমার চোখে এটা ছিল একধরনের ভণ্ডামি। এই মানুষগুলো মিথ্যা বলে, অন্যায় করে, আবার নামাজ পড়ে। আমি তো বিশ্বাস করি, নামাজ মানুষকে অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা সবাই নামাজ পড়ে, তারপর আবার সেই পুরোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে যাই। এই নামাজে আল্লাহর কী উপকার হলো?

আমি কখনো কারও কাছে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করার চেষ্টা করিনি। আমি নিজের রুমে বা মসজিদে নামাজ পড়তাম। আমার কাছে সেটাই সঠিক পদ্ধতি। আমি কখনো ভাবিনি যে কাউকে দেখিয়ে দিতে হবে আমি নামাজ পড়ছি। তাই আমি জনপ্রিয়ও ছিলাম না। হয়তো অনেকে ভাবছে, এসবের সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্ক কী?

আমিও এমনটাই ভাবতাম। তারা যখন আমাকে জবাবদিহি করাতে আসত, আমি বলতাম, আমি মুসলমান, আমি জানি কী করা উচিত। কিন্তু তোমরা তো নামাজ পড়ে তারপর আবার একে অপরকে গালাগালি দাও! নামাজ পড়লে তো শত্রুকেও ক্ষমা করতে হয়। অথচ আমরা একসঙ্গে নামাজ পড়ি, তারপরই শুনি নতুন কোনো কেলেঙ্কারির খবর! এতে নামাজের মর্যাদাই নষ্ট হয়।

শোয়েবকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল পিসিবি, তিনি পালিয়েছিলেন। খেলতে চেয়েছিলেন শুধুই বোলার হিসেবে। ছবিটি ২০১১ সালের।
ফাইল ছবি: এএফপি

২০০৩–০৪ সালের দিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়া (তৌকির জিয়া, পিসিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান) চাইতেন আমি অধিনায়ক হই। তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন আমির সোহেল।

আমি তখন দারুণ পারফর্ম করছিলাম। আর অধিনায়ক হওয়ার মতো সেভাবে কেউ ছিলও না। রশিদ লতিফ নিষিদ্ধ ছিলেন, ইনজামাম ফিরছিলেন। তাঁরা ইউনিসকে চাননি, আফ্রিদিকে মনে করতেন এখনো প্রস্তুত না। তখন আমি কী করলাম?

পালিয়ে গেলাম ইংল্যান্ডে। অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিলাম না। এটা আমার বড় ভুল ছিল। এটা দল এবং আমার জন্য ভালো হতো। আমি আরও দায়িত্ববান হতে শিখতাম, দলের জন্য লড়তাম।

কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, এটা আমার কাজ না। আমি একা দৌড়ে দল জেতাচ্ছি, এতেই তো যথেষ্ট। চাপমুক্ত, স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম, এটা ছিল ভীষণ স্বার্থপরতা। পাকিস্তান ক্রিকেটে আমাকে দরকার ছিল, কিন্তু আমি হতাশ করেছি।

অথচ আমরা ছিলাম দারুণ প্রতিভাবান একটা দল—ওয়াসিম, ওয়াকার, আফ্রিদি, সাকলাইন, রজ্জাক, আজহার, এলাহী আর আমি। আমাদের প্রত্যেকে একা ম্যাচ জিতিয়ে দিতাম। কিন্তু বড় টুর্নামেন্ট জিততে দরকার ছিল শক্ত নেতৃত্ব, যা আমাদের ছিল না।

আমি খুশি হয়েছিলাম, যখন ইউনিস খান অধিনায়ক হয় (২০০৯ সালের জানুয়ারিতে)। কারণ, সে দারুণ টিম প্লেয়ার। কিন্তু সে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যথেষ্ট দৃঢ় ছিল না। তার মাধ্যমে আমরা একজন ভালো মানুষ, ভালো খেলোয়াড় ও ভালো অধিনায়ক পেলাম, যার নেতৃত্বে আমরা (২০০৯ সালে) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও জিতলাম।

ব্যাপারটা খুব সরলই ছিল। কিন্তু পিসিবি কি সেটা আমলে নিল? ওর কী দশা হলো দেখুন। চেয়ারম্যান তাকে পছন্দ করত না, তাই বাদ পড়ল। তদন্তে পড়ল, দলে জায়গা হারাল। পরে ২০১০ সালে, যখন আমরা অস্ট্রেলিয়াকে হারালাম, বলা হলো, ‘আমরা তো জিতেছি, তার দরকার কী!’

এটা খুব দুঃখজনক। অভিজ্ঞতা আর প্রতিভা বাইরে বসে থাকল, আর ইউনিসকে ক্ষমা চাইতে হলো কোনো কারণ ছাড়াই। শুধু বোর্ড সদস্যদের অহং তুষ্ট করার জন্য। এভাবে তো দল গড়া যায় না। দরকার অভিজ্ঞতা ও নতুন প্রতিভার সম্মিলন।

কয়েক বছর আগে খেয়াল করলাম, দলের জুনিয়ররা আমার আশপাশে থাকতে পছন্দ করে। কারণ আমি তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতাম। আমি ছিলাম তাদের বড় ভাইয়ের মতো। তাদের বুঝিয়ে দিতাম—তোমরাও তারকা হতে পারো। কেউ কেউ আমার কথা শোনেনি, সেটা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু আমার মনে হতো, আমি যদি তাদের বিপদ সম্পর্কে আগেভাগে সাবধান না করি, তাহলে আমি দায়িত্বহীন হব।

তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। আমি তাদের বোঝানোর জন্য নিজের উদাহরণ দিতাম—‘দেখো, আমি এটা করেছিলাম, কী বিপদে পড়েছিলাম’।

এদের অনেকেই খুব গরিব, অশিক্ষিত পরিবার থেকে এসেছিল। সফরে আমার সঙ্গে লেগে থাকত। আমি তাদের আত্মবিশ্বাস দিতাম, উৎসাহ দিতাম বাইরে যেতে। কারণ, এর মাধ্যমেই তারা জানবে, অন্য সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশতে শিখবে। ‘যখন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন, সে-ও আপনাকে ভালোবাসবে।’

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সিনিয়র খেলোয়াড়েরাই ছিল সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ, যাদের আমি খুব ভালো করে চিনি। রশিদ লতিফ ও মঈন খানের মতো কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সবাই এমন কাজে জড়িত ছিল, যা ক্রিকেটের জন্য মোটেই সহায়ক ছিল না। অথচ তাদের বেশির ভাগই কেবল জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে গেছে।

সত্যি বলতে, আমি একজন খেলোয়াড়কেও দেখাতে পারি না, যিনি সত্যিকার অর্থে দলকে গুছিয়ে রেখেছেন। ‘এই লোকটাই পাকিস্তান ক্রিকেটকে সামলেছে’—এমন কিছু বলার মতো কেউ ছিল না। পাকিস্তান ক্রিকেট যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, তার জন্য পাকিস্তান দল নিজেরাই দায়ী।

শোয়েবের আক্ষেপ, ইমরান খানের পর পাকিস্তান একজন অধিনায়ক পায়নি।
ফাইল ছবি: এএফপি

সব সময় আমাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে যেত। দল থেকে কাউকে বাদ দেওয়ার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র চলত, তরুণ খেলোয়াড়দের বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না—এই ছিল আমাদের দলের অবস্থা। সুতরাং শুধু বোর্ড নয়, দল নিজেই নিজের পতনের জন্য দায়ী।

খেলোয়াড়েরা প্রায়ই নিজেদের সমস্যাগুলো সংবাদমাধ্যমের কাছে নিয়ে যেত। কেউ কেউ করত টাকাপয়সার জন্য, কেউ করত জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। এর ফলে ড্রেসিংরুমের সম্পর্কগুলো একদম ভেঙে পড়েছিল।

রশিদ লতিফ, আমির সোহেল, ওয়াসিম আকরাম—তাদের সবাইকে নিজেদের দলের মধ্যে খারাপ সম্পর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মঈন খান সহ–অধিনায়কের পদ ছেড়ে দেন। তাঁকে ড্রেসিংরুম তো দূরের কথা, মাঠেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটা ক্যারিয়ারের এভাবে শেষ হওয়া—কী ভয়ংকর ব্যাপার!

আমি এগুলো লিখছি কেবল কষ্টের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নয়, বরং এ জন্য যে আমি জানি আমরা চাইলে আরও অনেক ভালো করতে পারতাম। আমাদের সেই প্রতিভা ছিল। কিন্তু ইমরান খান ছাড়া আমি আর কোনো খেলোয়াড়কে পাইনি যিনি নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে খেলাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা আমার ব্যক্তিগত মত এবং আমি এই অবস্থানে অটল।

আমরা যখন নিজেদের ধ্বংস করছিলাম, আর সেই সময় মিডিয়া যেন দায়িত্ব নিয়েই আরও সমস্যা তৈরি করতে লাগল। আমি বলছি না তারা চোখ বুজে থাকুক, কিন্তু অন্তত সঠিক তথ্য যাচাই করে তারপর প্রতিবেদন করুক। দুঃখজনকভাবে, তারা নিজেরাই পাকিস্তানের ক্রিকেট-ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে নষ্ট করেছে।

যেহেতু অধিনায়কদের দৃঢ় নেতৃত্বের অভাব ছিল, তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতেও পারতেন না। যেমন ম্যাচ ফিক্সিং স্ক্যান্ডাল—যেটা যেন থামতেই চায় না। আমি চাই মিডিয়া অন্তত এটাকে ‘স্ক্যান্ডাল’ বলেই উড়িয়ে না দেয়। বিষয়টা অনেক বেশি গুরুতর।

আমাদের ড্রেসিংরুম বা টিম মিটিং থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো খবর বেরিয়ে যায় এবং সেটাকে রংচঙে করে গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়। আমার মতে, আমাদের মিডিয়া পাকিস্তান ক্রিকেটের সম্মান নষ্ট করতে বড় ভূমিকা রেখেছে এবং তারা এখনো শেখেনি যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মিডিয়া নিজেদের দেশের ইমেজ রক্ষায় সচেতন থাকে।

আপনার দেশটাই আসল, ভাই! খেলা একটা জাতীয় বিষয়, আর যখন খেলোয়াড়েরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যায়, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, অপমান করে নয়।

পাঠকের জন্য তথ্য

শোয়েব আখতারের বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এর কিছু বক্তব্য নিয়ে ভিন্নমত এসেছে। যেমন ওয়াসিম আকরামের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের রাজনীতির কারণে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার পিছিয়ে গেছে বলে যে অভিযোগ, এ নিয়ে জবাব দিয়েছিলেন আকরাম। বলেছিলেন, শোয়েব অসাধারণ প্রতিভা ছিল, কিন্তু শৃঙ্খলার অভাব ছিল। বল টেম্পারিং, নিষিদ্ধ ড্রাগ গ্রহণসহ বিভিন্ন কারণে শোয়েবের নিষিদ্ধ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, ‘যে খেলোয়াড়দের শোয়েব এখন দোষ দিচ্ছে, তাঁরাই তাঁকে সমর্থন করেছিলেন, যখন সে বারবার নিষিদ্ধ হচ্ছিল।’ মজার বিষয় হচ্ছে, ২০১৭ সালে ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে ‘জিও খেলো পাকিস্তান’ নামের একটি অনুষ্ঠানও উপস্থাপন করেছেন শোয়েব। ১৯৯৭ থেকে ২০১১—১৪ বছরের ক্যারিয়ারে তিন সংস্করণে মোট ২২৪ ম্যাচ খেলেছেন শোয়েব, নিয়েছেন ৪৪৪ উইকেট। তবে উইকেট ছাড়িয়েও সবচেয়ে বিখ্যাত ২০০৩ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিক নাইটকে করা একটি ডেলিভারি, স্পিডমিটারে যার গতি উঠেছিল ঘণ্টায় ১৬১.৩ কিলোমিটার, যা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি গতির ডেলিভারি। বর্তমানে ইউটিউব, টক শো এবং ধারাভাষ্যে ব্যস্ত সময় কাটান শোয়েব। ‘বিতর্কিত আমি’ বইয়ের মতো সেখানেও অকপট, সোজাসাপ্টা শোয়েবেরই দেখা মেলে, যেমনটা ছিলেন বোলিংয়ে।