চোখে না দেখা এক ধারাভাষ্যকারের গল্প

বিশ্বের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ধারাভাষ্যকার ডিন ডু প্লেসিছবি: সংগৃহীত

মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠের প্রেসবক্সে ঢুকতেই স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে হইচই লেগে গেল। হাই-হ্যালো, এত দিন কই ছিলে, তোমাকে অনেক মিস করেছি, তোমাকে দেখে ভালো লাগছে—সবার মুখে একই কথা।

মনে হলো, হঠাৎই এক সেলিব্রিটি এসে হাজির। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে তিনি অবশ্য সেলিব্রিটিই—ডিন ডু প্লেসি। বিশ্বের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ধারাভাষ্যকার তিনি। চোখে না দেখলেও তিনিই জিম্বাবুয়ের ‘ভয়েস অব ক্রিকেট’!

দুই রেটিনায় টিউমার নিয়ে জন্ম ডু প্লেসির। চিকিৎসক বলেছিলেন, খুব গেলে দুই মাস বাঁচবেন। সেই ডু প্লেসির বয়স এখন ৪৫। তাঁর জীবনের গল্পটা বেশ করুণ হলেও ডু প্লেসি বেশ মজা করেই বলেন, ‘আমি এখন ৪৫ নটআউট এবং ভালো খেলছি। আশা করি, এমনই ভালো থাকব।’

ডু প্লেসি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। সেটি অবশ্য তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। চোখে না দেখলেও ব্যাট-বলের ঠুকঠাক শব্দ শুনে ঠিকই বলে দিতে পারেন, মাঠে কী হচ্ছে।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সেলিব্রিটির মর্যাদাই পান ডিন ডু প্লেসি
ছবি: প্রথম আলো

খেলার সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। ডু প্লেসির ভাই গ্যারি ডু প্লেসি জিম্বাবুয়েতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। বাবা ক্রিস ডু প্লেসিও ক্রিকেট–ভক্ত। সেই ১৯৯১ সাল থেকেই ক্রিকেট ডু প্লেসির নেশা। পকেটের টাকা খরচ করে রেডিও স্টেশনে ফোন দিয়ে জিম্বাবুয়ের খেলার স্কোর জানতে চাইতেন। জিম্বাবুয়ের সাবেক ক্রিকেটারদের ফোন নম্বর জোগাড় করতেন, বেলা-অবেলায় তাঁদের ফোন দিতেন।

ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়েও ডু প্লেসির যথেষ্ট জানাশোনা। তাঁকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের উইকিপিডিয়া বললে ভুল হবে না। এসবই ধারাভাষ্যকার হিসেবে ডু প্লেসিকে উপভোগ্য করে তোলে। ধারাভাষ্যের সময় স্টাম্প মাইক ডু প্লেসির সবচেয়ে বড় বন্ধু। স্টাম্প মাইকে ক্রিকেট মাঠের শব্দ শুনেই তিনি বুঝে যান, মাঠে কী হচ্ছে। প্রথম আলোকে বলছিলেন সে গল্পই, ‘আমার জন্য স্টাম্প মাইকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি শুনেই বলে দিতে পারি, কোন বোলার বল করছেন, কোন ব্যাটসম্যান খেলছেন। কী শট খেলছেন, সেটাও বুঝি শব্দ শুনে।’

ক্রিকেটের ইতিহাসই ভালোই জানেন ডু প্লেসি
ছবি: টুইটার

নিজের ধারাভাষ্যের কৌশল বোঝাতে কিছু উদাহরণ দিলেন তিনি, ‘ব্যাটিংয়ের সময় একেকজন ব্যাটসম্যান একেক রকম শব্দ করে। “ইয়েস”, “নো” একেকজন একেকভাবে বলে থাকে। যেমন মার্কাস ট্রেসকথিক কখনো “ইয়েস”, “নো” বলতেন না। তিনি বলতেন, “রান”। সেটা শুনেই বলে দেওয়া যায় যে কে খেলছেন। কেভিন পিটারসেন যখন লেগ সাইডে খেলতেন...পুল, হুক কিংবা সুইপ খেললে তিনি অন্য রকম শব্দ করতেন। যেটা কাভার ড্রাইভ করলে শোনা যেত না। বিষয়টা এমন, একজনকে দেখার পর আমরা জানি যে লোকটা দেখতে কেমন। তেমনি আমি একজনকে শোনার পর বুঝে নিই, তিনি শুনতে কেমন।’

বাংলাদেশের পেসার শাহাদাত হোসেনের কথাটা সে কারণেই এখনো মনে পড়ে ডু প্লেসির। বল ছাড়ার আগে শাহাদাতের বিকট শব্দ ডু প্লেসি এখনো ভোলেননি, ‘বাংলাদেশের পেসার শাহাদাতের কথা মনে আছে। সে বোলিংয়ের সময় অনেক শব্দ করত। শুনতে অনেকটা টেনিস প্লেয়ার মনিকা সেলেসের মতো মনে হতো।’
এ তো গেল ডু প্লেসির শ্রবণশক্তির কথা। তাঁর আরেক বড় শক্তি অভিজ্ঞতা, ‘আমি খেলাটার সঙ্গে জড়িয়ে সেই ১৯৯১ সাল থেকে, মিডিয়ায় কাজ করছি ২০০১ সাল থেকে। খেলাটা আমি ৩১ বছর ধরে শুনছি। অভিজ্ঞতার কারণেই আমি কাজটা করতে পারছি।’

ডু প্লেসির ধারাভাষ্য দেওয়ার একটি মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

নতুন ক্রিকেটারদের চেনার ক্ষেত্রে ডু প্লেসিকে সাহায্য করেন তাঁর আশপাশে থাকা সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকারেরা। কখন কত রান দরকার, কোন ব্যাটসম্যান কত রানে খেলছেন—সবার প্রিয় ‘ডিন’কে এসব তথ্য দেওয়ার লোকের অভাব নেই।
আসলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেরই একটি বিশাল অংশজুড়ে আছেন ডু প্লেসি। তাঁকে ছাড়া হারারে স্পোর্টস ক্লাবের মিডিয়া সেন্টার নাকি খাঁ খাঁ করে।

বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম দুটিতে তিনি ছিলেন না। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ডু প্লেসি মাঠে আসতেই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। চোখে না দেখতে পেলেও কান খাড়া করে তিনি সেটি উপভোগ করছিলেন। আর মুখে ঝোলানো একচিলতে হাসি যেন বলে দিচ্ছিল, চোখে না দেখলে কী হয়েছে, মাঠের আবহ উপভোগ করতে তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় যথেষ্ট।