ট্যাক্সিচালক থেকে রেকর্ড বইয়ে আমের জামাল

আউট হয়ে ফেরার হতাশা আমের জামালের। তার আগে অবশ্য ইতিহাস লিখেছেন ব্যাটেএএফপি

‘আমার মনে হয় না, আমের জামাল তার ক্যারিয়ারে খুব বেশি সময় ৯ নম্বরে ব্যাট করবে...এই দৃঢ়সংকল্প মনোভাবই সমর্থকেরা তাদের দলের কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল’—সিডনি টেস্টে আমের জামাল যখন ইতিহাস গড়ছিলেন তখন ‘এক্স’-এ কথাগুলো লেখেন ভারতের ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে।

সিডনি টেস্টে প্রথম দিনে খেলার স্কোর এতক্ষণে মোটামুটি সবারই জানা। পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ৩১৩ রানে অলআউট হওয়ার পর বিনা উইকেটে ৬ রান নিয়ে দিনের খেলা শেষ করে অস্ট্রেলিয়া। দিনের খেলা না দেখে থাকলে পাকিস্তানের স্কোরটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। শেষ সেশনে একপর্যায়ে ২২০ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান। সেখান থেকে ২৫০ হয় কি না সেটাই সন্দেহ!

‘ব্যাটিংয়ে নামার সময়ই জানতাম অস্ট্রেলিয়া জোরাল আক্রমণ করবে। সেজন্য প্রস্তুত ছিলাম। তারা আমাদের দ্রুত অলআউট করতে চেয়েছে, সেজন্য আমি প্রায় সব বলেই চড়াও হয়েছি।’
আমের জামাল

কিন্তু একটি ব্যাপার সবাই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান মানেই রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তা—৯ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা পেসার আমের জামালের ব্যাটে ভর করেছিল দুটোই। ৪ ছক্কা ও ৯ চারে ৯৭ বলে ৮২ রান করে পাকিস্তানের শেষ ব্যাটসসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন ২৭ বছর বয়সী এই বোলার। আমের বুক চিতিয়ে পাল্টা আক্রমণ না করলে পাকিস্তানের ৩০০ পেরোনো হয় না। স্বাভাবিকভাবে লোয়ার অর্ডারে নামা কেউ এমন ইনিংস খেলে দলকে শক্ত ভিত পাইয়ে দিলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হবেই। পাকিস্তানের এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরে আমের আলোচনায় এসেছিলেন আগেই। সেটি পার্থে সিরিজের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট নেওয়ার পর। আর আজ ব্যাটকে দলের বিপদে পাল্টা লড়াইয়ের ‘তলোয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করে আমের সম্ভবত বুঝিয়ে দিলেন, তিনি থাকতেই এসেছেন।

অর্ধশতকের পর আমের জামাল
এএফপি

অভিষেক টেস্ট সিরিজে যিনি নিজ দেশের প্রথম খেলোয়াড় ন্যূনতম অর্ধশতক রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি (ইনিংসে) ৫ উইকেটও পেয়েছেন—তাঁকে পাকিস্তান আর যাই হোক হেলায় ফেলে দেবে না! হ্যাঁ আমের আজ শতকের সুবাস ছড়ানো অর্ধশতক রানের ইনিংসটি খেলে পাকিস্তানের হয়ে এই রেকর্ডই গড়েছেন। আর সেটি গড়ার পথে পেসার হিসেবে খেলেন কাভার ড্রাইভ, স্কয়ার কাট থেকে পুল-হুকের মতো চোস্ত ব্যাটসম্যানদের সব শট। সেটিও প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজলউড, মিচেল স্টার্কের মতো বাঘা বাঘা সব বোলারের বিপক্ষে। ভাবা যায়! শুধু কী তাই, নাথান লায়নকে ছক্কা মেরেছেন রিভার্স সুইপে! স্টার্ককে কাভারে ড্রাইভ করে যেভাবে ব্যাটটা ধরে রেখেছিলেন, দেখে মনে হয়েছে টপ অর্ডারের কেউ ব্যাট করছেন!

দিনের খেলা শেষে নিজের ব্যাটিং নিয়ে আমের বলেছেন, ‘ব্যাটিংয়ে নামার সময়ই জানতাম অস্ট্রেলিয়া জোরাল আক্রমণ করবে। সেজন্য প্রস্তুত ছিলাম। তারা আমাদের দ্রুত অলআউট করতে চেয়েছে, সেজন্য আমি প্রায় সব বলেই চড়াও হয়েছি।’

আরও পড়ুন

টেস্ট অভিষেকের আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুটি অর্ধশতক ছিল আমেরের। তবে ৩০ ম্যাচে ২০.০২ গড়ে ৭০১ রান তাঁর আজকের ব্যাটসম্যানশিপের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। ১০ম উইকেট জুটিতে মির হামজার সঙ্গে ৮৬ রান তোলার পথে আমেরের একার অবদান ৭৯। ব্যাটিংয়ের কৌশলগত ব্যাপারগুলোয় একটু ঘাটতি থাকলেও দৃঢ়-সংকল্প মনোভাব দিয়েও যে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, আজ তার দারুণ এক উদাহরণ হয়ে রইলেন আমের। তবে হার না মানার মানসিকতা কিন্তু তাঁর রক্তেই। সেটি বোঝা যায় আমেরের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পথে তাকালে।

১৯৯৬ পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালিতে জন্ম নেওয়া আমের ২০১৪ সালে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। কিন্তু তাঁর পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন এরপর বড় ধাক্কা খেয়েছিল। পরিবারকে ভালো রাখতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ট্যাক্সি চালাতে হয়। এর আগে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেসব দাহকালের গল্প শুনিয়েছিলেন আমের, ‘ভোর ৫টা থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ছিল আমার (ট্যাক্সি চালানোর) প্রথম শিফট। সেই কষ্ট আমাকে নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছে, এটাও বুঝিয়েছে জগতে সবকিছুরই মূল্য আছে। যখন আপনি কঠোর পরিশ্রম করে কিছু অর্জন করবেন তখন মূল্য দিতে শিখবেন।’

‘ন্যায্য কথা বললে আমের জামাল সুন্দর ব্যাটিং করেছে। আমরা সবরকম চেষ্টাই করেছি। সে সত্যিই দারুণ ব্যাট করেছে।’
মিচেল মার্শ

ট্যাক্সির হুইল ধরায় প্রায় চার বছর পেশাদার ক্রিকেটের বাইরে থাকতে হয়েছিল আমেরকে। কিন্তু ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যা কখনো শেষ হয় না—আমেরের ক্রিকেটের প্রতি মানসিকতাটা ঠিক এমনই। স্বপ্ন বিসর্জনের পথে থাকলেও মুঠো ছাড়েননি। অস্ট্রেলিয়ায় অনিয়মিতভাবেই গ্রেড ক্রিকেট খেলে অন্তত কিছুটা হলেও খেলার মধ্যে থাকার চেষ্টা করতেন। এমনই এক ম্যাচে আমের জানতে পারেন পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দল অস্ট্রেলিয়া সফরে আসবে। আমেরের মনের ভেতর নিভু নিভু করা সলতেটা আবারও জ্বলে ওঠে—দেশের হয়ে খেলতে হবে! এই স্বপ্নই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে পাকিস্তান টিভির সঙ্গে প্রথম শ্রেণি এবং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে চুক্তি করেন আমের। তখন তাঁর বয়স ২২ বছর। এই দলের হয়ে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক। আমেরের অভিষেক রাঙানোর অভ্যাসের শুরু ঠিক তখন থেকেই। মুলতানের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেকেই প্রতিপক্ষের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৯ ওভার বল করে ২৮ রানে নেন ৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ২ উইকেট। তবে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলার যে স্বপ্ন দেখে আমের দেশে ফিরেছিলেন সেটি পূরণ হয়নি। কিন্তু ২০২১-২২ মৌসুমে পাকিস্তানের নর্দার্ন দলে সুযোগ পেয়ে যান। এই নর্দার্নের হয়েও টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত অভিষেক হয়েছিল তাঁর। আহমেদ শেহজাদ, শোয়েব মালিক ও ফাহিম আশরাফদের মতো প্রতিষ্ঠিতদের আউট করে ম্যাচসেরা হওয়ার পাশাপাশি দলের জয়ও এনে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

ন্যাশনাল টি–টোয়েন্টি কাপে সাফল্য পাওয়ার পর দেশের হয়ে খেলার দরজা খুলে যায় আমেরের। ২০২২ সালে লাহোরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় অভিষেক। সে ম্যাচে আমেরের শেষ ওভারটি স্মরণীয় হয়ে আছে। জয়ের জন্য ১৫ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের, স্ট্রাইকে মঈন আলী। আমের ৪টি ‘ডট’ বল করে শেষ পর্যন্ত ৬ রানে জেতান পাকিস্তানকে। গত বছর পাকিস্তান সুপার লিগে পেশোয়ার জালমির হয়ে ৬ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। ঘণ্টায় ১৪০ কিমি গতির ওপাশে নিয়মিত বোলিংয়ের সামর্থ্য রাখা আমেরের টি–টোয়েন্টি ব্যাটিংগড় ২০.৮৭। প্রথম শ্রেণিতেও ব্যাটিংগড় ২০ এর বেশি হওয়ায় পাকিস্তানের নির্বাচকেরা সম্ভবত ভেবেছেন, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও কার্যকর হবেন। সেটাই দেখা গেল আজ।

অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন আমের
এএফপি

অস্ট্রেলিয়া সফরে নাসিম শাহর জায়গায় আমেরকে নেওয়া হয়। স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার খুব কাছাকাছি গিয়ে আমের কিন্তু পথচ্যূত হননি। ব্যাংক থেকে লিজ নিয়ে ট্যাক্সি কিনেছিলেন, সেই কষ্টকর দিনগুলো থেকে আমের সবকিছুর মূল্য দেওয়া শিখেছিলেন বলেই সম্ভবত টেস্ট আঙিনায় নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। আর সেটা একদম শুরু থেকেই—পার্থে অভিষেক টেস্টেই তো পেয়েছেন ইনিংসে ৬ উইকেট! আর সিডনিতে আজ নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলার পর কেমন লাগছে তাঁর? আমেরের মুখেই শুনুন, ‘ব্যক্তিগত কোনো মাইলস্টোনের লক্ষ্য নেই আমার। কারণ আমার মাইলস্টোন হলো দেশের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সেটা অর্জন করেছি। তাই যত বেশি সম্ভব রান করার চেষ্টা করেছি।’

অস্ট্রেলিয়ার অলরাউন্ডার মিচেল মার্শের প্রশংসা নিশ্চয়ই ভালো লাগবে আমেরের, ‘ন্যায্য কথা বললে আমের জামাল সুন্দর ব্যাটিং করেছে। আমরা সবরকম চেষ্টাই করেছি। সে সত্যিই দারুণ ব্যাট করেছে।’

আরও পড়ুন