সাদা চুলের রিচি বেনো আর গমগমে গলার টনি গ্রেগ—এই দুজন ছিলেন একটা প্রজন্মের কাছে ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর। নস্টালজিয়ার ফেরিওয়ালা এই কিংবদন্তিদের জন্মদিনে ফিরে দেখা সেই স্বর্ণালি ধারাভাষ্য যুগও।
ডিশ–সংযোগ তখনো শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ। দেশের মানুষের বড় একটা অংশের দুয়ারে সম্ভবত সপ্তাহান্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে যেত বিটিভি। বিবিসির টেস্ট ম্যাচ ক্ল্যাসিকস, ওয়ার্ল্ড সিরিজের বিভিন্ন অংশ প্রচার করা হতো। সপ্তাহের কোন দিনে, কখন (সম্ভবত বিকালে), এত বছর পর তা আর মনে নেই। তবে স্যুট পরা সাদা চুলের এক ভদ্রলোকের কথা মনে আছে।
তিনি আশির দশকের শেষ ভাগ ও নব্বইয়ের প্রজন্মে অনেকের শৈশবে ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। পল্লিগ্রামের গেরস্তঘরে সাদাকালো টিভিতে তাঁকে দেখে মুখ কুঁচকাতেন একটু বড়রা। তাঁরা জানতেন, বাসার বাচ্চাকাচ্চারা লোকটিকে দেখলেই বুঝে ফেলবে অনুষ্ঠানটি ক্রিকেট নিয়ে, আর তখন পড়াশোনা লাটে উঠবে!
সবার অবশ্য এমন হতো না; বিশেষ করে যে মুখগুলো একটু কচি। কি শহর, কি গ্রামে—বাড়িতে ফেরিওয়ালা দেখে উৎফুল্ল কিশোরীর মতো সেই মুখগুলোও বিস্তৃত হতো। সেই প্রজন্ম এবং আরও কয়েক প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর। সময় গড়িয়ে সবাই বড় হয়ে ওঠার পথে জানল, লোকটির নাম রিচি বেনো। তত দিনে ক্রিকেটের এই ফেরিওয়ালাকে দেখতে শুধু একটি চ্যানেলের ওপর নির্ভরতা আর নেই।
সপ্তাহান্তে সাদাকালো টিভিতে বেনোর উপস্থিতিকে মেঠো পথে ধূলি মাড়িয়ে বাড়িতে আসা ফেরিওয়ালার মতো মনে হওয়ার দিন শেষ। ঘরে ঘরে ডিশ–সংযোগ। বেনো হয়ে উঠলেন প্রায় প্রতিদিনের খোরাক। এই বিশ্বভূখণ্ডের জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বেনো প্রায় সবার কাছে ক্রিকেটের চিরকালীন কণ্ঠস্বর। এক কাঠি সরেস কেউ কেউ বলতে পারেন, এখানে তো বটেই, এখন যেখানে আছেন, সেখানেও।
অন্যলোকে কোনো ক্রিকেট ম্যাচেও বেনোর হাতে হয়তো মাইক্রোফোন। নরম ট্রেডমার্ক উচ্চারণে ‘মর্নিং, এভরিওয়ান’ বলে দিন শুরু করে মুখের আস্তিন থেকে একের পর এক বের করছেন সেই সব ট্রেডমার্ক উচ্চারণ,‘মাআরভেল্লাস’, ‘হোয়াট আ রিপার’ আর একদম সঠিক সময়ে যথোপযুক্ত শব্দচয়নের রস, ‘অ্যান্ড গ্লেন ম্যাকগ্রা ডিসমিসড ফর টু, জাস্ট নাইন্টি এইট রানস শর্ট অব হিজ সেঞ্চুরি।’
পাশ থেকেই গনগনে ব্যারিটোন কণ্ঠে কেউ বলবেন, ‘দে আর ড্যান্সিং ইন দ্য আইলস অব হেভেন (শারজা)।’ এই ভদ্রলোকও আপনার চেনা। টনি গ্রেগ। তাঁর সঙ্গেও কয়েক প্রজন্মের পরিচয় ঘরে ঘরে ডিশ পৌঁছানোর আগেই।
বেনো তত দিনে দু-এক প্রজন্মের কাছে ‘ক্রিকেট-দাদু’। অনেকেই শৈশবে নিজের দাদার তুলনায় বেশি সময় কাটিয়ে ফেলছে তাঁর সঙ্গে। অবশ্যই টিভিতে, গ্রেগ ঘরে ঘরে ধরা দিলেন তখনই, নব্বইয়ের শেষ দিকে; বিটিভিতে আইসিসি টুর্নামেন্টের বাইরেও তখন কিছু ম্যাচ সরাসরি দেখানো হতো। ১৯৯৮ সালে যেমন শারজায় কোকাকোলা কাপ। সেই টুর্নামেন্টে শচীন টেন্ডুলকারের ‘ডেজার্ট স্টর্ম’ ইনিংসে গ্রেগের ধারাভাষ্য ছিল টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়েরই শাব্দিক রূপ, ‘দ্য লিটল ম্যান হিট দ্য বিগ ফেলা ফর সিক্স! হি ইজ হাফ হিজ সাইজ!’ কিংবা ‘হি স্ম্যাশড হিম ডাউন দ্য গ্রাউন্ড, হোয়াট্টা প্লেয়ার! হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল প্লেয়ার!’
তাঁদের ভুবনেরই আরেকজন হার্শা ভোগলে বলেন, ‘টেন্ডুলকারের মরুঝড়ে বেনো কেমন করতেন? সেখানে একজন টনি গ্রেগের দরকার ছিল। ম্যাচের মাঝে খুব সুন্দর একটা সময়ে গ্রেগ কেমন করতেন? কিংবা সেই আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের ঘটনায়, যেখানে আমরা বেনোকে প্রথমবারের খুব প্যাশন নিয়ে বলতে শুনেছি। দুজন পুরোপুরি আলাদা মানুষ। একজন বিশুদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান, যিনি গ্রীষ্মটা কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডে। আরেকজন বিশ্ব পর্যটক; জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়, অধিনায়ক ইংল্যান্ডের, ভালোবাসায় পড়া শ্রীলঙ্কায় আর নাগরিক হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার।’
১৯৯৮ সালে শারজায় কোকাকোলা কাপ। সেই টুর্নামেন্টে শচীন টেন্ডুলকারের ‘ডেজার্ট স্টর্ম’ ইনিংসে গ্রেগের ধারাভাষ্য ছিল টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়েরই শাব্দিক রূপ।
আলাদা তো বটেই। বেনো ৬ ফুট ও মাঝারি গড়নের, গ্রেগ আরও ৬ ইঞ্চি বেশি লম্বা, গড়নে একদম খাঁটি ‘বিগ ম্যান’। ধারাভাষ্যে মার্ক নিকোলাসের ভাষায়, ‘ক্রিকেটস গ্রেটেস্ট সেলসম্যান।’ কেন? সেই উত্তর খুঁজে নিতে পারেন ভোগলের কথায়, ‘একটি ক্রিকেট ম্যাচে (ধারাভাষ্যে) টনি গ্রেগের চেয়ে বেশি প্রস্তুতি আর কেউ নেয়নি। সংখ্যায়, চিন্তাভাবনায়, প্রযুক্তির ব্যবহারে ও বোঝায়—সব সময় ভিন্ন কিছু খুঁজেছেন…কিন্তু টনি মানে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, যখন (ম্যাচে) সেটা হচ্ছে না, টনি উপভোগ্য করে তুলতেন, টেনে আনতেন দর্শক। সম্প্রচার আরও উপভোগ্য করে তুলতে এটা করতেন।’
যেমন ধরুন পিচ রিপোর্ট। গ্রেগ পরিবেশন করতেন আর্ট ফর্মে। তাতে দেখা গেল, শুধু পিচ রিপোর্ট করেই কেউ বিখ্যাত হতে পারে। একটু অমসৃণ পিচ নিয়ে তাঁর এক মন্তব্য তো বিখ্যাত, ‘এখানে যে উপত্যকাগুলো আছে, সেগুলো সমান করতে জিলেটের জি-টু ডাবল-এজড সুইভেল হেড রেজর লাগবে।’
গ্রেগের এই গুণকে বেনো জানতেন আরও গভীরভাবে। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর দিনে বেনোর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল ইএসপিএনক্রিকইনফো। বেনো সেখানে বলেন, ‘পিচ রিপোর্ট করে কেউ বিখ্যাত হয়েছে কি না, আমি জানি না। কিন্তু সে হয়েছে, ওই পর্যায়ে যতটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, গিয়েছে।’ কারণও শুনুন তাঁর মুখেই, ‘সে জন্য যে পরিশ্রম ও গবেষণা করেছে, আবহাওয়া ও মাটি সমন্ধে ধারণা রাখা মানুষের সঙ্গে কথা বলত। কিউরেটর, বিশেষ করে জন ম্যালে। ওয়ার্ল্ড সিরিজে তিনি প্রথম ড্রপ-ইন পিচের উদ্ভাবক। মাটি, পিচ এবং তার ওপর ফাটলের ব্যাপারে জন ম্যালের কাছে জেনেছে গ্রেগ।’
তবে বেনোর নিজের ব্যাপারটা আলাদা। ধারাভাষ্যে তিনি আরও শান্ত, সুষম ও গভীর। ভোগলের ভাষায়, ‘যদি ১০টি শব্দে (সব) বলার দরকার হয়, রিচি বেনোকে লাগবে।’ আরও ভেঙে বলা যাক। জন আরলট, হেনরি ব্লোফিল্ড থেকে এ পর্যন্ত কত অসাধারণ সব ধারাভাষ্যকারকে পেয়েছে ক্রিকেট। গল্প বলিয়ে ইয়ান চ্যাপেল, আইকনিক ‘অল হ্যাপেনিং’ বিল লরি, সুনীল গাভাস্কার ও রবি শাস্ত্রীর বিশ্লেষণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর টনি কোজিয়ার…এমন অনেক নাম বলা যায়। কিন্তু সম্ভবত তাঁরা সবাই একটি বিষয়ে একমত হবেন, যদি এক মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে ক্রিকেটের আগাপাছতলা সমন্ধে বলতে বলা হয়, তবে বেনোকেই তাঁদের চাই।
কারণ, সময়, শব্দজ্ঞান ও পরিমিতিবোধ। শুধু একটা শব্দে ম্যাচের গোটা মুহূর্তকে গেঁথে ফেলতে পারতেন। পর্দায় যা দেখা যাচ্ছে না, এর রূপক শব্দের মোড়ক খুলে জেনেছে দর্শক। গ্রেট ধারাভাষ্যকারদের যেটা অবশ্যই বুঝতে হয়, ক্যামেরা কোনো ছাড় দেয় না আর দর্শক মানে বন্ধু; বেনো ও গ্রেগ দুজনেই সেখানে একেবারে নিখুঁত। পরিপূর্ণ পেশাদার। পোশাক-আশাক থেকে কথায়, বিশ্লেষণে একেবারে ঝকঝকে।
একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচেও গ্রেগের ভারী কণ্ঠের ওঠানামায় কান ও চোখ সজাগ হয়। রক্তে নাচন ওঠে। কারণ, দর্শকদের আবেগটা খুব ভালো বুঝতেন। উপমহাদেশে তাই তুমুল জনপ্রিয়। বেনোর কাছে ছিল আরও এক মাস্টার স্ট্রোক। কখন থামতে হবে জানা। ধারাভাষ্যে সম্ভবত আর কেউ কখনো তাঁর মতো এই ‘পজ’টুকু দিতে পারবেন না। টিভি দেখার জায়গা। দৃশ্য কথা বলে। বেনো জানতেন, কখন বলতে হবে আর কখন দর্শককে সুরটা ধরিয়ে দিয়ে দৃশ্যকে বলতে দিতে হবে।
ভোগলের ভাষায়, ‘কখনো কখনো আমরা তাঁকে খেয়াল করেছি, কথা শুনেছি, কারণ তিনি (ধারাভাষ্যে) একটা প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। বেনো যা বলেননি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যা বলার ছবিই বলেছে। বেনো পরের মুহূর্তের অপেক্ষায় থেকেছেন। সেটা (মুহূর্ত) তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হয়নি, মিশে গেছেন।’
গ্রেগের কণ্ঠে প্রতিটি ডেলিভারি একেকটি রোমাঞ্চকর ইভেন্ট। বেনো প্রতিটি ডেলিভারিতে কথা না বলেও মুহূর্তকে দিয়ে বলাতেন।
একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচেও গ্রেগের ভারী কণ্ঠের ওঠানামায় কান ও চোখ সজাগ হয়। রক্তে নাচন ওঠে।
বলতে পারেন, ক্রিকেটের সময়কাল ও পরিবর্তনটা বেনোর বেশি জানা ছিল তাই। চল্লিশের দশকের ক্রিকেট দেখে বড় হওয়া কেউ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে নিজেই অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। ১৯৬৪ সালে অবসর নেওয়ার বেশ আগেই নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সাংবাদিকতা ও সম্প্রচারে। বিবিসিতে উপস্থাপকের কোর্স করেছিলেন ১৯৫২ সালে টেস্ট অভিষেকের চার বছর পরই। অবসর নেওয়ার পর বেনো সেই যে নামলেন সম্প্রচারে, প্রায় পাঁচ দশকে ক্রিকেটে কত পরিবর্তন দেখেছেন চোখের সামনে!
অনেকটাই ক্রিকেটের ত্রিকালদর্শী হওয়ায় অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধনে তাঁর কথায় ভবিষ্যতের রূপরেখাও থাকত। আর কৌশলজ্ঞানে? রবি শাস্ত্রীর ‘স্টারগেজিং: দ্য প্লেয়ার্স ইন মাই লাইফ’ বইয়ের ভাষায়, ‘ক্রিকেট বোঝার ক্ষেত্রে রিচি ছিলেন অসাধারণ। কোন খুঁটিনাটি দর্শকের নজরে আনা দরকার, কোন খেলোয়াড়ের কোন বিশেষত্ব আলাদা করে তুলে ধরা যায়—সবই তাঁর মুঠোয় ছিল। সব সময় নিখুঁত হোমওয়ার্ক করা।’
ব্র্যাডম্যান অবসর নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার দলের গৌরব টিকিয়ে রাখার দুশ্চিন্তায় সমাধান ছিলেন বেনো। তাঁর অধিনায়কত্বে অস্ট্রেলিয়া কখনো সিরিজ হারেনি। ২৮ টেস্টে মাত্র ৪ হার। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ন্যূনতম ২০০ উইকেট ও ২০০০ রান। ২৪৮ উইকেট নিয়ে অবসর নেওয়ার সময় ছিলেন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। বেনো যে ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনারও, সেই পরিচয়টা ঢাকা পড়েছে ধারাভাষ্যে।
গ্রেগেরও তাই। মাত্র পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। সত্তরের দশকের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। মিডিয়াম পেস ও প্রয়োজনে অফ স্পিনার। ব্যাটিংয়ে সেই সময়ে ৪০ গড়। কেরি প্যাকারের বিদ্রোহী ওয়ার্ল্ড সিরিজে যোগ দেওয়ায় গ্রেগের অধিনায়কত্ব যায়, শেষ হয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও। কিন্তু সেই সিরিজ আয়োজনে জুটি হলো গ্রেগ ও বেনোর। এরপর চ্যানেল নাইনের ধারাভাষ্যকক্ষে জুটি এবং ধীরে ধীরে জন্ম হলো সেই দলটির, ভোগলের ভাষায়, ‘লরি, চ্যাপেল, গ্রেগ ও বেনো; আমার মনে হয় তাঁরা সবার ওপরেই থাকবেন।’
একটু ভুল হলো। চ্যাপেল ও লরি এখনো এই সমতলেই আছেন। গ্রেগ আর বেনোই সবার ওপরে।
নিচে আজ তাঁদের জন্মদিনের দুটি কেক।