সাকিব–তামিম, নাকি তামিম–ফারুকি

যেকোনো খেলারই একটা মজা হলো খেলাটা মাঠে গড়ানোর আগপর্যন্ত আপনি সেটাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাম দিতে পারেন। যেই না খেলা শুরু হলো, তখন থেকেই ওই নামের সঙ্গে খেলাটার কোনো মিল তৈরি না হলেও কিছু বলার নেই। খেলা তো খেলাই।

বিশেষ করে ক্রিকেট খেলা, যেটাকে নাকি পরিচিত করা হয় অনিশ্চয়তার আরেক পরিচয়ে। আগে থেকে যেভাবে ভাবা হবে তার সঙ্গে খেলার পরতে পরতে যত অমিলের দেখা মিলতে থাকবে, ততই না রোমাঞ্চ!

মিরপুরে কাল বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে মুখোমুখি হবে রংপুর রাইডার্স ও ফরচুন বরিশাল। এই ম্যাচটাকেও শুধুই দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার না বলে পরিচিত করা যেতে পারে আরও অনেক নামে। অন্তত তিনটি নাম তো এই লেখাতেই বলে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

এবারের বিপিএলে যেটা বেশি শোনা যাচ্ছে, সেটার কথাই আগে বলা যাক। রংপুর–বরিশাল মুখোমুখি হওয়া মানেই হলো সাকিব বনাম তামিম লড়াই—এই বিপিএলে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা তো পেয়েছে এটাই। কিন্তু সাকিব–তামিম লড়াই সত্যি সত্যি মাঠে কতটা হচ্ছে?

মিরপুরে দুই দলের প্রথম সাক্ষাতে তামিমের বরিশাল জিতেছিল ৫ উইকেটে। আবার চট্টগ্রামে গিয়ে দ্বিতীয় সাক্ষাতে রংপুর ম্যাচের ৩ বল বাকি থাকতে জিতেছে ১ উইকেটে। কাজেই সাকিব–তামিম হার–জিতে সমান সমান। তামিম যেহেতু বোলিং করেন না, তাঁর পক্ষে সাকিবকে আউট করা কঠিন, যে সুবিধাটা আছে সাকিবের। চট্টগ্রামের ম্যাচে তামিমের উইকেটটা তিনি নিয়েছেনও। নিয়ে কনুই ঝাঁকি দিয়ে যে উদ্‌যাপনটা করেছেন, নিজে বোলিং না করলেও এবং সাকিবের আউটে কোনো ভূমিকা না থাকলেও সাকিব আউট হওয়ার পর ঠিক সেভাবেই উদ্‌যাপন করেছেন বরিশাল অধিনায়ক তামিম। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন একটা ঝড়ই বয়ে গেছে।

তামিমকে আউট করেছিলেন সাকিব। চট্টগ্রাম অনুষ্ঠিত ম্যাচে
প্রথম আলো

এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। সেখানে সব সময় ঝড়ই বয়ে যায়। গত কিছুদিনের প্রেক্ষাপটে সাকিব–তামিম এ ধরনের ঝড়ের বড় উপকরণ মাত্র। আগামীকালের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচটা নিশ্চিতভাবে সে রকম আরেক ঝড়ের উপলক্ষ হয়ে আসতে যাচ্ছে। কারণ, বিপিএলের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচ এটি। সাকিব–তামিম ফাইনালে মুখোমুখি হতে পারছেন না, এটা নিশ্চিত। আজ যে জিতবে, সেই ফাইনাল খেলবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের সঙ্গে। হেরে যাওয়া দল বাড়ি যাবে বিদায়ের বিউগল শুনতে শুনতে। কাজেই আজ যে জিতবে, সাকিব–তামিম কথিত দ্বৈরথে সেই তো ‘চ্যাম্পিয়ন’!
এমন হাইভোল্টেজ ম্যাচের আগে আজ মিরপুরে ঐচ্ছিক অনুশীলন করতে এসে দুই দলের কোচকেই সম্ভাব্য সাকিব–তামিম লড়াই নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যদিও দুজনই সেসব আগুনে প্রশ্নে ঘি না ঢেলে পানি ঢেলেছেন।

আরও পড়ুন

রংপুরের কোচ সোহেল ইসলাম কিংবা বরিশালের কোচ মিজানুর রহমান কারও চোখেই এই ম্যাচ আলাদাভাবে সাকিব–তামিম দ্বৈরথ নয়। তাঁদের কাছে খেলাটাই বড়, চোখ তাঁদের ফলাফলের দিকেই থাকবে এবং দুই কোচের কারও কাছে এই ম্যাচ সাকিব–তামিম মোড়কে বন্দী কোনো বোমাও নয়। সোহেল ও মিজানুরের কথায় এটাও পরিষ্কার—সাকিব বা তামিমের মধ্যেও এ রকম ম্যাচের আগে বাড়তি উত্তেজনার ছিটেফোঁটা তাঁরা দেখেন না।

মজার ব্যাপার হলো, সাকিব–তামিম লড়াইয়ের আগুনে ফুঁ দিতে দিতে সবাই ভুলেই যাচ্ছেন যে রংপুর–বরিশাল মুখোমুখি হওয়া মানে আসলে একের সঙ্গে তিনের লড়াই! হ্যাঁ, নাম যদি দিতেই হয় গল্পটাকে এভাবে দেখাই ভালো। তাতে গল্পের চরিত্র বাড়ে এবং তখন কোনো না কোনো জায়গায় আগাম দেওয়া নামের সঙ্গে ম্যাচটা মিলেও যেতে পারে।

ফরচুন বরিশালে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তামিমও আছেন
ফরচুন বরিশাল

একের সঙ্গে তিনের লড়াই মানে সাকিব বনাম তামিম, মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিক ত্রয়ী। জাতীয় দলেও যেখানে ইদানীং দেশের তিন সিনিয়র তারকাকে একসঙ্গে খেলতে দেখাটা সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এবারের বিপিএলে সেটা দেখা যাচ্ছে ফরচুন বরিশালে।

দলের দেশি, বিদেশি অন্য শক্তির জায়গাগুলোর দিকে না তাকিয়ে শুধু তামিম, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক নাম তিনটি নিলেই তো বরিশালের ওজনটা বোঝা যায়। বরিশাল–রংপুর ম্যাচ মানে এই অভিজ্ঞ ত্রিমূর্তির সামনে একাকী সাকিব। তিনের সঙ্গে একের লড়াইকে যদিও সব সময় অসমই মনে হয়, কিন্তু সেই একজন সাকিব বলেই এখানে তা বলার উপায় নেই। সাকিব একাই যে তিন! বোলার, ব্যাটসম্যান ও ফিল্ডিংয়েও নির্ভরযোগ্য। বরিশালের ত্রিমূর্তি রংপুরের কয়টা সাকিবকে ঠেকাবে!

আরও পড়ুন

দেশের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এবার আগামীকালের ম্যাচটাকে একটু আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া যাক। যদি বলা হয় এই ম্যাচ আর কিচ্ছু না, এই ম্যাচ আসলে হলো তামিম বনাম ফারুকি, খুব কি ভুল বলা হবে?

মোটেই ভুল বলা হবে না। গতকাল সকালে ঢাকায় এসে সন্ধ্যায়ই রংপুর রাইডার্সের হয়ে মাঠে নেমে যাওয়া আফগান পেসার ফজলহক ফারুকি যেন বিপিএলের শেষ দৃশ্যে নতুন এক লড়াইয়ের ফুলকি ছোটাতেই এসেছেন।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে মোট ৯টি ওয়ানডে খেলেছেন বাংলাদেশ ওপেনার তামিম। ৯ ম্যাচের শেষ চারটিতেই তিনি টানা আউট হয়েছেন ফারুকির বলে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাদেশের বিপক্ষে ফারুকি এখন পর্যন্ত যে চারটি ওয়ানডে খেলেছেন, তার সব কটিতেই তামিম আউট হয়েছেন তাঁর বলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ফারুকির ৪৬টি বল খেলে তামিম রান করেছেন ২০।

ফারুকির বলে চারবার আউট হয়েছেন তামিম
প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে অবশ্য তামিমের জন্য বিব্রতকর এ রকম কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০২১ সালের মার্চে ফারুকির টি–টোয়েন্টি অভিষেকের ঠিক এক বছর আগেই যে নিজের শেষ আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ম্যাচটা খেলে ফেলেছেন তামিম!

ওয়ানডেতে ফারুকির বলে আউটগুলোর মধ্যে অবধারিতভাবেই আছে গত জুলাইয়ে চট্টগ্রামের সেই ম্যাচটিও, যেটির পর অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন তামিম। অবসরের প্রসঙ্গে আরেকটা ব্যাপারও মনে পড়ে গেল। ভারত বিশ্বকাপের আগে তামিমকে দল থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে যে আলোচনাটা তখন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতেও কিন্তু অদৃশ্যভাবে ছিলেন ফারুকি।

আরও পড়ুন

তামিমকে নাকি তখন বলা হয়েছিল বিশ্বকাপ দলে তিনি থাকলেও টিম কম্বিনেশনের কারণে প্রয়োজনে তাঁকে ব্যাটিংয়ে নামতে হতে পারে পরের দিকে। সেই ‘প্রয়োজনে’র কথা বলা হয়েছিল মূলত আফগানিস্তান ম্যাচ মাথায় রেখেই। টিম ম্যানেজমেন্ট চায়নি আবারও শুরুতেই ফারুকি জুজুতে ভুগুক বাংলাদেশ। তার মানে তো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহেও প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন ফারুকি!
আগামীকাল সন্ধ্যার রংপুর রাইডার্স–ফরচুন বরিশাল দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচটাকে কী নামে ডাকবেন, এবার সে সিদ্ধান্ত আপনিই নিন। সাকিব বনাম তামিম, একের সঙ্গে তিনের লড়াই, নাকি তামিম বনাম ফারুকি?

যে নামেই ডাকুন না কেন, এ ম্যাচের আসল পরিচয় কিন্তু ওটাই—বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার।