হাসি–ঠাট্টা–খোঁচা খেতে খেতেই ‘ক্রাইসিস ম্যান’ রাহুল
ফেসবুকে লোকেশ রাহুলের নামে একটা পেজ আছে। নাম ‘কেএল রাহুল একাডেমি অব নাম বড়ে(বড়) দর্শন ছোটে (ছোট)’। অনুসারীর সংখ্যা ১৯ হাজার। এ পেজে রাহুলকে নিয়ে নিয়মিত ট্রল করা হয়। তাঁকে বানানো হয় মিমের উপকরণ। এমনকি গতকাল সেঞ্চুরিয়নে রাহুলের দুর্দান্ত শতকের পরও তাঁকে নিয়ে ট্রল করে পোস্ট করা হয়েছে সেখানে। এশিয়া কাপে চোট থেকে ফেরার পর রাহুল দুর্দান্ত খেলছেন। তবু তিনি ট্রলের উপকরণ!
অথচ ভারতের ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোরের চোখে রাহুল ‘ক্রাইসিস ম্যান’। সেটা অনেকের চোখেই। যুক্তি? এই যে দলের প্রয়োজনে সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে উইকেটকিপিং করছেন। অথচ এর আগে খেলা ৪৭টি টেস্টে একবারও উইকেটকিপিং করেননি। দলের প্রয়োজনে কখনো ওপেন করেন, কখনো ব্যাট করেন মিডল অর্ডারে। টেস্টে ওপেনার হয়েও চলতি টেস্টে মিডল অর্ডারে ব্যাট করছেন। টেস্টে এর আগে তিনি ৭৫ ইনিংসে ব্যাট করেছেন ওপেনিংয়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হওয়া নিয়ে রাহুল গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা চাপ। আজকে সেঞ্চুরি করেছি, তাই মানুষ অনেক প্রশংসা করবে। তিন-চার মাস আগে সবাই আমাকে গালাগালি দিয়েছে। এটা খেলার অংশ, তবে বলতে পারব না এটা আপনাকে প্রভাবিত করে না, প্রভাবিত করে। বুঝতে পেরে যত দ্রুত আপনি এসব থেকে দূরে থাকবেন, তত আপনার খেলার জন্য ভালো, আপনার মানসিকতা ভালো থাকবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন যে কাউকে তারকা হতে সহায়তা করছে, আবার চাপও তৈরি করছে। সেটা শুধু ক্রিকেটারদের জন্য নয়, যেকোনো মানুষের জন্যই। আর দিন শেষে ক্রিকেটারও সবার আগে মানুষই। রাহুল স্বীকার করেছেন, তিনি এসব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করেছেন চোটের কারণে মাঠের বাইরে থাকার সময়ে, ‘কোথায় শেষ করতে হবে, সেটা যদি আপনি কিছুটা হলেও জানেন, আপনি পারফর্ম করতে পারবেন অথবা আপনার চিন্তাভাবনা ভালো থাকবে।’
রাহুল এরপর বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন, ‘যা বলা হয়েছে, যেসব সমালোচনা হচ্ছে, তা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার মতো কেউ এতটা মহান হতে পারে না। এটা প্রত্যেক মানুষকে প্রভাবিত করেই। কেউ যদি বলে এটা তাকে প্রভাবিত করে না, আমি নিশ্চিত, সে মিথ্যা বলছে। তবে সব মানুষকেই নিজের উপায় বের করে নিতে হয়। আমি যেটা করেছি, যখন চোটে ছিলাম, খেলা থেকে দীর্ঘদিন বাইরে ছিলাম, নিজেকে নিয়ে কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি আগের সেই মানুষটা হওয়ার, কীভাবে এসবে প্রভাবিত হয়ে আমি নিজেকে পরিবর্তন করব না, সেটা নিয়ে কাজ করেছি। এত কিছু ঘটলে নিজের প্রতি ও নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতি সত্য থাকা কঠিন। এটা সবচেয়ে কঠিন বিষয়।’
দলে বাড়তি ভূমিকা রাখা ছাড়া রাহুল ব্যাট হাতেও কিন্তু সংকট সামলানোর কাজটা করছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে রাহুল যখন ক্রিজে আসেন, ভারতের রান তখন ৪ উইকেট ৯২। এরপর দলীয় ১০৭ রানে বিরাট কোহলি আউট হলে ভারত তখন বেশ বিপদে। সেখান থেকে রাহুল শার্দূল ঠাকুর, যশপ্রীত বুমরা, মোহাম্মদ সিরাজদের সঙ্গে ছোট ছোট জুটি গড়ে দলের রান ২৪৫-এ নিয়ে যান। নিজে করেন ক্যারিয়ারের অষ্টম শতক, যেটি দেশের বাইরে তাঁর সপ্তম শতক। এর আগেও সেঞ্চুরিয়নে শতক করেছিলেন রাহুল।
একমাত্র সফরকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে সুপারস্পোর্ট পার্কে একটির বেশি শতকের কীর্তি এখন রাহুলের। আর এশিয়ার বাইরে এটি তাঁর ষষ্ঠ শতক। গত ১৩ বছরে ভারতীয়দের মধ্যে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি ১৩টি শতক কোহলির। এই টেস্টে রাহুল ১০৫ বলে বাউন্ডারি মেরেছেন ১২টি। ওপেনার হিসেবে আইপিএলে ১৪ বলেও অর্ধশতক আছে রাহুলের। আবার কঠিন কন্ডিশনে ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম বাউন্ডারি পেতে ১০৮ বলও অপেক্ষা করেছেন তিনি। যা ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুলের বৈচিত্র্য তুলে ধরে।
ভারতের বর্তমান এই ‘ক্রাইসিস ম্যান’কে নিয়ে যেহেতু এখনো ট্রল হয়, তাই একবার ভাবুন তো, ফর্মের কারণে যখন তিনি দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, তখন কী হয়েছিল! সেটা কিন্তু খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। চলতি বছরের শুরুর দিকের কথা। ছন্দে না থাকায় টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। অন্য সংস্করণেও জায়গা ছিল নড়বড়ে। পারফর্ম করতে না পারলে ক্রিকেটাররা বাদ পড়বেন, অনেক বিশ্লেষকেরা সমালোচনা করবেন—এসবই স্বাভাবিক। তবে রাহুলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি চলে যায় বাড়াবাড়ির পর্যায়ে। তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্রতারক বলেছিলেন অনেকে।
রাহুলের দোষ ছিল, খেলার ধরন দৃষ্টিনন্দন হলেও তিনি রান করতে পারেন না। এমনকি কেউ তাঁকে ভারতের ক্রিকেটের ‘অর্জুন কাপুরও’ নামও দিয়েছেন। অর্জুন কাপুর বলিউডের একজন তারকা। বক্স অফিসে যার সিনেমা খুব একটা ভালো যায় না।
অনেক সমালোচনা ও ট্রলের মধ্যেই চোটে পড়েন রাহুল। চোট থেকে ফিরে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে শতক করেন। ভারত বিশ্বকাপে ৭৫ গড়ে রান করেন ৪৫২। ট্রল, মিমের উপকরণ থেকে দুর্দান্ত এই রাহুল। ফিরে এসে রাহুল কিন্তু সেই সময়কে ভোলেননি।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে রাহুল যা বলেছেন, সেটা অনেক ক্রিকেটারেরই উপকারে আসতে পারে। নিজের সংকট কাটিয়ে কীভাবে দলকেও সংকটকালীন মুহূর্ত থেকে টেনে তুললেন, সে সম্পর্কে রাহুলের ব্যাখ্যা, ‘অবশ্যই এটা কঠিন। আপনার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে, ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য আছে, চরিত্র আছে। যখন আপনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন, এসব চ্যালেঞ্জেরই মুখে পড়বেন। একজন মানুষ হিসেবে, একজন ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।’