দলে তো ফিরলেন, সেই সৌম্য কি ফিরবেন

আরেকবার সুযোগ পেলেন সৌম্য সরকার। এবার আর সুযোগটা তিনি হেলায় হারাতে চান নাছবি: প্রথম আলো

ফোন করে অভিনন্দন জানাতেই বিস্মিত প্রশ্ন, ‘কেন, অভিনন্দন কেন?’

কী আশ্চর্য, এটা কোনো প্রশ্ন হলো! বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি দুই দলেই ফিরেছেন, অভিনন্দন জানানোর কারণটা সৌম্য সরকারের না জানার কোনো কারণই নেই। আশ্চর্য হতে তখনো বাকি ছিল। নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে আর টি–টোয়েন্টি সিরিজের জন্য দল ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, অথচ সৌম্য নাকি তখনো তা জানেনই না!

বিস্ময়টা প্রকাশ করা হলো। সৌম্য বললেন, ‘বিশ্বাস করেন, আমি আসলেই জানতাম না। আপনার কাছ থেকেই জানলাম। আসলে একটা কাজে বাইরে ছিলাম তো।’ ঘরে থাকা আর বাইরে থাকায় আবার জাতীয় দলে ফেরার খবর পেতে কী পার্থক্য হয়, তা অবশ্য ঠিক বোধগম্য হলো না।

তা এখন তো জানলেন। প্রতিক্রিয়া কী? সব ক্রিকেটারের চাওয়াটাই শোনা গেল সৌম্যর মুখে, ‘আর যেন দল থেকে না বেরোই।’ এই চাওয়াটাই স্বাভাবিক, আবার এই চাওয়াটা অনেক বড়ও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক প্রায় নয় বছর আগে। তারপরও সৌম্য সরকারের ক্যারিয়ার রেকর্ডে ১৬ টেস্ট, ৬৩ ওয়ানডে আর ৭২টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ দেখাচ্ছে তো দল থেকে বারবার বেরিয়ে যাওয়ার কারণেই।

সৌম্য সরকারের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স খুব একটা মনে রাখার মতো নয়
ছবি: প্রথম আলো

এবারও তাঁর ফেরাটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। মাঝখানে কোথায় এমন কী করেছেন যে, আবার জাতীয় দলে ফিরবেন। সেই ফেরায় যে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বড় ভূমিকা আছে, তা অনুমান করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সৌম্যর শুরুটা দেখেছেন। দেখেছেন নিজের দিনে কী অবলীলায় যেকোনো বোলিংকেই উড়িয়ে দিতে পারেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।

এসব তো পরের কথা। সৌম্যর বাংলাদেশ দলে আসাতেও তো বড় ভূমিকা ছিল হাথুরুসিংহের। মিরপুরে সম্ভবত প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচেই সৌম্যকে দেখে তাঁর মনে ধরেছিল। ব্যাটিংয়ের চেয়েও স্লিপে নেওয়া একটা ক্যাচই নাকি সৌম্যর ব্যাপারে কৌতূহলী করে তুলেছিল হাথুরুকে। দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশে এসে মত বদলেছে কি না জানি না, তবে প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশে তাঁর দেখা সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার হিসেবে সৌম্য সরকারের নামই বলে এসেছেন সব সময়।

যখন মনে রাখার মতো কিছু করেছেন, তা তো ঠিকই মনে থেকেছে। এমনকি এত দিন পরও। ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রতিভার ঝলক দেখানোর পর তা পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়ার সেই দিনগুলে। পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭। কদিন পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে অপরাজিত ৮৮ ও ৯০। এর সবই ওয়ানডেতে। টেস্টেও তো সৌম্য–স্পেশাল আছে। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯ রানের ইনিংসে বড় বড় ছক্কাগুলো এখনো চোখে ভাসে।

নিজের দিনে যেকোনো বোলিংকে উড়িয়ে দিতে পারেন ঠিকই, কিন্তু সেই ‘নিজের দিন’ কালেভদ্রে আসত বলেই না এতবার বাংলাদেশ দলে আসা–যাওয়ার খেলা। মাঝখানে কী করেছেন, এই প্রশ্নে অবশ্য সৌম্য দাবি করলেন, খুব একটা খারাপ করেননি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্র্যাকটিস ম্যাচে ৪৮ রান করেছেন, ইমার্জিং টিমস্ এশিয়া কাপেও রান করেছেন একাধিক ইনিংসে, আরও কোথায় কোথায় যেন। ‘আসলে কী জানেন, আমি প্রিমিয়ার লিগে ভালো করি নাই। সবাই এই প্রিমিয়ার লিগের কথাই বেশি মনে রেখেছে’–সৌম্যর এই দাবি হয়তো ঠিক। তবে প্রিমিয়ার লিগে ভালো না করার স্মৃতি তো অন্য সব ম্যাচে বড় বড় স্কোরে আড়ালে ঠেলে দিতে পারতেন। সেটি তো করতে পারেননি। সৌম্যর মতো ব্যাটসম্যান ৪০–৪৫ রান করলে সেটি কারও কেন মনে থাকবে! সৌম্য কথাটা মেনে নিলেন, ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। আমার আরও বড় স্কোর করা উচিত ছিল।’

এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চান না। আবার যখন সুযোগ পেয়েছেন, তা আর হেলায় হারাতে রাজি নন। ফেরাটা নিউজিল্যান্ড সফরেই হওয়াটা কি ভালো হলো? নিউজিল্যান্ডে তো অনেক মধুর স্মৃতি আছে তাঁর। নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বাউন্সি উইকেটে খেলতে পছন্দ করার কথাও আগে অনেকবারই বলেছেন। বাড়তি চাপ না নিতে চাওয়ার কারণেই হয়তো এদিন আর এই প্রসঙ্গে আর ঢুকতেই চাইলেন না। ’নিউজিল্যান্ড হোক আর যেখানেই হোক, আমি শুধু খেলতে চাই। ক্রিকেট খেলতে চাই’ বলে শুরুতেই থামিয়ে দিলেন এই আলোচনা।

ফেরা–ফেরা বলছি, তবে এই কিছুদিন আগেই অবশ্য আসল ফেরাটা হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ দলে ফিরেছিলেন প্রায় আড়াই বছর পর। নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় দল, বাংলাদেশেরও শীর্ষ ক্রিকেটারদের অনেকে ছিলেন না বলে সেই সিরিজটা প্রায়ই ভুলে যাই। সৌম্যর সঙ্গে কথা বলার সময়ও যেমন মনে ছিল না। আমার প্রশ্নটা শুনে তাই সৌম্য একটু অবাকই হলেন। কী সেই প্রশ্ন? সৌম্য, লাস্ট ওয়ানডে কবে কোথায় খেলেছিলেন, মনে আছে? সৌম্য অবাক হয়ে বললেন, ‘নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই তো! বিশ্বকাপের আগের ওয়ানডে সিরিজে।’ ও, তাই তো! তা সেই ম্যাচে কত করেছিলেন? ‘শূন্য করেছিলাম’—সৌম্যর কণ্ঠ শুনে একটু বিব্রত মুখটা অনুমান করে নিলাম।

একটা সময় ছিল, সৌম্য সরকার ব্যাটিংয়ে নামা মানে বড় বড় সব ছক্কা!
ছবি: এএফপি

এটা আমার মনে থাকা উচিত ছিল। অথবা সৌম্যকে ফোন করার আগেই দেখে নেওয়া। আমিও তাই কিছুটা বিব্রত। সেই বিব্রত ভাবটা কেটে গেল পরের প্রশ্নে সৌম্যর উত্তরে। সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি ম্যাচটা কবে কোথায় খেলেছিলেন, এটা বলতে পারলেন। সৌম্যর সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি ম্যাচ গত বছর নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সেই ম্যাচে কত রান করেছিলেন? সৌম্যর নিজেরই তা মনে নেই, ’ভুলে গেছি। একদমই মনে করতে পারছি না।’

পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচে সৌম্য করেছিলেন ২০ রান। তাঁর নিজেরই যেখানে সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি ম্যাচে নিজের স্কোর মনে নেই, সর্বশেষ ওয়ানডেতে শূন্য রানে আউট হওয়া আমি ভুলে যেতেই পারি। ওই ম্যাচের কি কোনো গুরুত্ব ছিল নাকি যে মনে থাকবে!

যখন মনে রাখার মতো কিছু করেছেন, তা তো ঠিকই মনে থেকেছে। এমনকি এত দিন পরও। ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রতিভার ঝলক দেখানোর পর তা পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়ার সেই দিনগুলো। পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭। কদিন পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে অপরাজিত ৮৮ ও ৯০। এর সবই ওয়ানডেতে। টেস্টেও তো সৌম্য–স্পেশাল আছে। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯ রানের ইনিংসে বড় বড় ছক্কাগুলো এখনো চোখে ভাসে।

সৌম্য কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন সেই সব স্মৃতি? সেই সৌম্য কি ফিরবেন, ২০১৫ বিশ্বকাপে যাঁর শুধুই একটা শট নিয়ে বিশাল এক লেখা লিখে ফেলেছিলেন উইজডেন অস্ট্রেলিয়ার সম্পাদক ক্রিস্টিয়ান রায়ান!