যে সংকেত বুঝতে চাননি শোয়েব মালিক

পাকিস্তানি অলরাউন্ডার শোয়েব মালিকছবি: টুইটার

শুক্রবার মুলতান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকলে মোহাম্মদ ওয়াসিম কী বলতেন কে জানে!

ডানহাতি পেসার জামান খানের অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে ফেলা বলকে যেভাবে কবজির জোরে লং অফ দিয়ে ছয় মারলেন তিনি, কে বলবে এই ছয় হাঁকানো ব্যাটসম্যানের বয়স গত ফেব্রুয়ারিতে ৪০ ছাড়িয়ে গেছে! কে বলবে এই ব্যাটসম্যানের দক্ষতা মাপার জন্য ১০ মাস তাঁর জাতীয় দলের বাইরে থাকাটা কোনো মানদণ্ড নয়! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কেমন করবেন, সেই আভাস পাওয়ার জন্য বয়স কোনো সংকেত নয়!

কিন্তু সঠিক হোক বা ভুল, গত কয়েক মাস জাতীয় দলে না খেলা আর বয়স নির্দেশ করা সংখ্যাটিকেই সংকেত হিসেবে নিয়েছেন পিসিবির প্রধান নির্বাচক ওয়াসিম। অন্তত কথায়-আচরণে তেমনই ইঙ্গিত। বৃহস্পতিবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য পাকিস্তানের দল ঘোষণা করেন ওয়াসিম।

পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচক মোহাম্মদ ওয়াসিম
ছবি: টুইটার

৪০ পেরোনো মালিকের জায়গা হয়নি সেই দলে। কেন হয়নি, সেদিন এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসিম বলেছিলেন, আগেই তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন কাকে দলে রাখা হবে, কাকে রাখা হবে না। এর সঙ্গে যোগ করেছিলেন, গত কয়েক মাসে না খেলানোর মাধ্যমেই শোয়েবকে বার্তা দেওয়া হয়ে গেছে!

জাতীয় দলে না খেলিয়ে বিশ্বকাপ দলে না রাখার যে বার্তা বা সংকেত দিয়েছিলেন ওয়াসিম, সেটিই হয়তো মালিক বোঝেননি কিংবা বুঝেছেনও। কিন্তু ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে বারবার বাদ পড়েও প্রতিবার ফিরে আসতে পারার যে শক্তি, সে শক্তিতে ভর করে এ যাত্রায়ও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চরানোর আশা করেছিলেন। শুধু আশা বললে ভুল হবে, নিজেকে প্রস্তুতও রেখেছিলেন।

প্রস্তুত রেখেছিলেন বলে এখনো ন্যাশনাল টি-টোয়েন্টি কাপ খেলে চলেন। ১৪ দিনের মধ্যে ৮টি টি-টোয়েন্টি খেলে শারীরিক সামর্থ্যের প্রমাণ দেন, দুটি ফিফটিসহ তিনটি চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলে ব্যাটিং দক্ষতার জানান দেন। এর সর্বশেষটি দেখিয়েছেন শুক্রবার, বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ার ঠিক পরদিন।

মুলতান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের হয়ে নেমেছিলেন নর্দার্নের বিপক্ষে। ম্যাচ শেষে করেছেন ৬২ রানে অপরাজিত থেকে, ৬টি চার আর ২টি ছয়ের যে ইনিংসটিতে বল খরচ করেছেন ৩৯টি, স্ট্রাইক রেট ১৫৮.৯৭! সমাপ্তি টেনেছেন জামানকে উড়িয়ে মারা ওই ছয় দিয়ে!

ম্যাচে নর্দার্নের ১৬২ রান শোয়েবের দল পেরিয়েছে ১২ বল আর ৬ উইকেট হাতে রেখে। মুলতানের মাঠে পাঞ্জাবের শেষটা যেভাবে হয়েছে, ঠিক এমনটাই চায় পাকিস্তান দল। যে চাওয়া পূর্ণ হয়নি বলে এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার কাছে হারতে হয়েছে টানা দুই ম্যাচে।

এশিয়া কাপে ব্যাট হাতে ব্যর্থ ছিলেন খুশদিল শাহ
ছবি: এএফপি

খুপাকিস্তানের চাওয়া মিডল অর্ডারে এমন ব্যাটসম্যানও, যিনি দুই ওপেনার (বাবর আজম-মোহাম্মদ রিজওয়ান) নির্ভরতা থেকে দলকে মুক্ত করবেন, বিপদে উদ্ধার করবেন, মাঝপথে ইনিংস গড়বেন আর শেষের দিকে হাত চালাবেন। এশিয়া কাপে ‘অলরাউন্ড’ ঘরানার এই ব্যাটিংই পারেননি খুশদিল শাহ, ইফতিখার আহমেদরা, যে ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত শিরোপাটাও খোয়া গেছে।

এশিয়া কাপে পাকিস্তান মিডল অর্ডারের ব্যর্থতা দেখতে দেখতে আক্ষেপ জমেছে শোয়েবের। ফাইনালের পর ‘আমি যদি থাকতাম...’ আক্ষেপের সঙ্গে যোগ হয় চেপে রাখা ক্ষোভও, যা তিনি ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কূটনৈতিক ভঙ্গিমার সেই বার্তায় লিখেছিলেন, ‘কবে আমরা বন্ধুত্ব, আর পছন্দ-অপছন্দের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর তাঁর একার ক্ষোভ আর একার থাকেনি, হয়ে ওঠে পাকিস্তানের ক্রিকেট-সমাজের বিতর্কের বিষয়। বিশ্বকাপ দলে শোয়েবের সুযোগ পাওয়া উচিত বলে মতও দেন ইনজামাম উল হকের মতো সাবেক ক্রিকেটার।

কিন্তু পিসিবি নির্বাচকদের আর শোনার সময় কই? ‘শোয়েব আউট’—এমন সিদ্ধান্ত যে তারা আগেই নিয়ে রেখেছে!

২০১৯ বিশ্বকাপের পরপর রমিজ রাজা বলেছিলেন, মোহাম্মদ হাফিজ আর শোয়েব মালিকের অবসর নেওয়া উচিত। রমিজ তখনো স্রেফ ধারাভাষ্যকার, বিশ্লেষক। তবে ইমরান খানের বদান্যতায় গত বছর থেকে রমিজ এখন পিসিবির চেয়ারম্যান। সামনে কী হতে পারে, এমনটি অনুমান করেই হয়তো বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছিলেন হাফিজ। কিন্তু বোঝেননি বা বুঝলেও মানতে চাননি শোয়েব।

আরও পড়ুন

বোঝেননি অধিনায়ক বাবর আজমের কথাও। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ই বাবর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি খেলা চালিয়ে যাবেন না অবসর নেবেন?’ শোয়েব বলেছিলেন চালিয়ে যাওয়ার কথা। ছয় মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে বলা শোয়েবের কথাগুলো আবার সামনে এসেছে বিশ্বকাপের দল ঘোষণার পর। সমর্থকদের ধারণা ইঙ্গিতটা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন বাবর।

এ বছরের জুন মাসে পাকিস্তান জুনিয়র লিগের (পিজেএল) ঘোষণা দিয়েছিল পিসিবি। দলগুলোকে দেখভালের জন্য চারজন মেন্টর ঠিক করে দেন পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ। সেখানে জাভেদ মিয়াঁদাদ, শহীদ আফ্রিদি আর ড্যারেন স্যামির সঙ্গে চতুর্থ নামটি শোয়েবের। খেলা ছেড়ে দেওয়া কিংবা জাতীয় দল থেকে বহুদূরে চলে যাওয়া ক্রিকেটারদের কাতারে রাখার মধ্যে দিয়েও রাখা হয়েছিল ‘শেষের বার্তা’।

শোয়েব মালিক পাকিস্তানের জার্সিতে খেলছেন ২২ বছর ধরে
ফাইল ছবি: এএফপি

অবসরের আহ্বান জানানো রমিজের পিসিবি চেয়ারম্যান হওয়া, বাবরের জিজ্ঞাসা আর পিজেএলের মেন্টর হওয়া—সব কটিই ছিল একেকটি সংকেত, যা শোয়েব বোঝেননি, বুঝলেও মানতে চাননি।

পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি (১২৪), এশিয়ানদের মধ্যে সর্বাধিক টি-টোয়েন্টি (৪৮০) আর বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম (২২ বছর ৩৭ দিন) ক্যারিয়ারের কি তবে এখানেই যতিচিহ্ন!