সিরাজের মাত, বুমরার ঘাত আর তাসকিনের দুকুল রক্ষা

মোহাম্মদ সিরাজ, তাসকিন আহমেদ ও যশপ্রীত বুমরারয়টার্স/প্রথম আলো

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা অদ্ভুত জায়গা। বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই সামাজিক না। যদি সেখানে কখনো নায়ক হন, আপনাকে খলনায়ক হওয়ার অপেক্ষাতেও থাকতে হবে।

ভালোবাসা পেলে ঘৃণাও যে পাবেনই, অবধারিত। ভারতীয় পেসার যশপ্রীত বুমরার কথা ভাবুন। ভারতের ইংল্যান্ড সিরিজ শুরুর আগে অনেক ভারতীয় সমর্থকের কাছে তিনি ছিলেন সবেধন নীলমণি। সিরিজ শেষে? তিনিই নাকি প্রতারক!

সিরিজ শুরুর আগেই বুমরা জানিয়েছিলেন, তিনি ইংল্যান্ড সফরে তিনটি টেস্ট খেলবেন। নিজে নিজে তো আর সিদ্ধান্ত নেননি! টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত। তখন বুমরাকে নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়নি।

বুমরা হঠাৎ করে অনেকের চোখে খারাপ হয়ে গেলেন তাঁর সতীর্থ মোহাম্মদ সিরাজ সিরিজের পাঁচটি টেস্ট খেলায়। ‘অ্যান্ডারসন–টেন্ডুলকার ট্রফির’ সব টেস্টেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সিরিজ। আর তাঁর হাত ধরেই ওভাল টেস্ট জিতে সিরিজ ড্র করেছে ভারত।

এসবের পরই বুমরা হয়ে গেলেন চোখের বালি। সিরাজ পারলে বুমরা কেন নন!
তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় কয়েক দিন আগেই যাঁকে সর্বকালের সেরা বলে দাবি করা হলো, সেখানে বুমরার নামই এখন ট্রল ট্রেন্ডিংয়ে। পারফরম্যান্স নিয়ে কিন্তু এখনো প্রশ্ন নেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে বুমরা ৫ ইনিংস বোলিং করে নিয়েছেন ১৪ উইকেট, যা সিরিজের চতুর্থ সর্বোচ্চ।

আমি আশা করি, ভারতীয় ক্রিকেটের অভিধান থেকে “ওয়ার্ক লোড” শব্দটা চিরতরে বাদ যাবে। আমি অনেক দিন ধরেই এটা বলে আসছি।
সুনীল গাভাস্কার

প্রশ্ন বুমরার নিবেদন নিয়ে। অনেকেরই দাবি, ‘ওয়ার্ক লোড ম্যানেজমেন্ট’ বলে যে কথাটা বলা হয়, সেটা আদতে কিছুই নয়। মোক্ষম উদাহরণ তো সিরাজই। ২০১৮ সালে অভিষেকের পর থেকে যার ওয়ার্ক লোড নিয়ে কখনো কোনো কথাই হয়নি। সদ্য সমাপ্ত সিরিজে ৪৭টি স্পেলে বোলিং করেছেন সিরাজ, যেখানে প্রতিটি বলেরই গতি ঘণ্টায় ১৩১ কিলোমিটারের বেশি। সিরাজের এমন পারফরম্যান্স বুমরাকেই শুধু না, ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট’ কথাটাকেও যেন চাপে ফেলে দিয়েছে!

আর এই পালে হাওয়া দিয়েছেন কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারও। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আশা করি, ভারতীয় ক্রিকেটের অভিধান থেকে “ওয়ার্ক লোড” শব্দটা চিরতরে বাদ যাবে। আমি অনেক দিন ধরেই এটা বলে আসছি। আমার মনে হয়, আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত—এই “ওয়ার্ক লোড” আসলে যতটা মানসিক ব্যাপার, ততটা শারীরিক নয়।’

ভারতের হয়ে ৭৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সন্দীপ প্যাটেল তো গত পরশু সরাসরি বুমরাকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি ভাবছি, কীভাবে বিসিসিআই এসব মেনে নিচ্ছে। ফিজিও কি অধিনায়ক ও প্রধান কোচের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

তাহলে নির্বাচকদের কথার কী হবে? আমরা কি ধরে নেব, এখন থেকে দল নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে ফিজিও বসবে? সিদ্ধান্তও কি সে নেবে? আমি দেখেছি সুনীল গাভাস্কারকে ম্যাচের পাঁচ দিনই ব্যাট করতে, কপিল দেবকে টেস্ট ম্যাচের অধিকাংশ দিন বল করতে। এমনকি আমাদের নেটেও বল করত। তারা কখনো বিরতি চাননি, অভিযোগ করেননি, আর তাদের ক্যারিয়ার ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে।’

ভারতের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বুমরা ও সিরাজ।
এএফপি

তবে সবাই যে বুমরাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন, তা নয়। পাশেও আছেন কেউ কেউ। বুমরার পিঠের চোটের বিষয়টি সামনে এনে ভারতের সাবেক বোলিং কোচ ভারত অরুণ যেমন বলেছেন, ‘বুমরাকে নিয়ে এসব কথা শোনা সত্যিই দুঃখজনক। ওর একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, আর মানুষকে বুঝতে হবে যে অস্ত্রোপচার হয়ে গেলেই যে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে, এমনটা নয়।’

আরও পড়ুন

তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষের এসব আলোচনা বুমরার টের না পাওয়ার কথা নয়। ২০২৩ সালেও একবার চোটসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এরপর মাঠে ফিরে বলেছিলেন, কে কী বলেছেন, সেটা তাঁর কানে এসেছে। তাঁর স্ত্রীও সংবাদমাধ্যমেই কাজ করেন। এবারের উত্তাপ তাই বুমরা টের পাবেন, সেটি তাই স্বাভাবিকই।

এ বিষয়ে কাল সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে কথা হয় বাংলাদেশ পেসার তাসকিন আহমেদের সঙ্গে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন তাসকিন। বুমরা–সিরাজদের মতো খেলে যাচ্ছেন তিন সংস্করণেই। ওয়ার্ক লোড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তাসকিন কী ভাবছেন, ‘একেক মানুষ একেক রকম। সবার শরীরের অবস্থা এক নয়। কারও শরীর তিনটা টেস্ট নিতে পারে, কারও পাঁচটা। কার কেমন চোট আছে এসবের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।’

বুমরার পিঠের চোট অনেক দিনের।
এএফপি

সর্বশেষ বিপিএলের পর চোটের কারণে চার মাস পুনর্বাসনে ছিলেন তাসকিন। ফেরার পর দল তাঁকে খেলাচ্ছে বেছে বেছে। গত জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে দলে ফেরা তাসকিন শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সিরিজ মিলিয়ে খেলেছেন পাঁচটি ম্যাচ।

কেন এমন করতে হয়েছে বা করতে হয়, সেটার ব্যাখ্যা তাসকিন দিয়েছেন এভাবে, ‘একটা সময়ে এসে সবারই একটু ম্যানেজ করে খেলতে হয়। আমাকেও কিন্তু বোর্ড এখন ম্যানেজ করেই খেলায়। কারণ, সব ফাস্ট বোলারেরই কিছু ছোটখাটো সমস্যা থাকে, চাপটা বেশি হলে সেই সমস্যা বেড়ে যায়, আবার নতুন সমস্যাও আসতে পারে। এ জন্যই আসলে ম্যানেজ করতে হয়।’

আরও পড়ুন