দৌড়ে রান নেওয়ার অভ্যাসটা বাড়ালে বাংলাদেশের ব্যাটিং এগিয়ে যাবে
খেলার মাঠে জয়ই শেষ কথা। কীভাবে জিতলেন তা কেউ দেখে না। গতকাল রাতে এক ম্যাচ হাতে রেখেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে ব্যর্থতার পর এই জয় অবশ্যই স্বস্তির ও আনন্দের। তবে দুটি ম্যাচের স্কোরবোর্ডে তাকালে ব্যাটিংয়ে দু–একটি অস্বস্তির জায়গাও ফুটে ওঠে—যেগুলো ঠিক করতে পারলে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মানটা আরও ভালো হওয়া সম্ভব।
শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই রান তাড়া করে জিতেছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে ১৫১ রান তাড়া করতে নেমে জিতেছে ৪ উইকেটে, ৮ বল হাতে রেখে। গতকাল রাতে দ্বিতীয় ম্যাচে ১৪৭ রান তাড়া করতে নেমে ৫ বল হাতে রেখে ২ উইকেটে জেতে বাংলাদেশ। নিয়মিত অধিনায়ক লিটন দাসকে ছাড়াই এই সিরিজ জয়, নুরুল হাসানের দুই ম্যাচেই খেলাটা শেষ করে আসা, ছক্কা মারার সামর্থ্য বেড়ে যাওয়া—এসবই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বিষয়। দুর্দান্ত বোলিংয়ের ব্যাপারটি তো আসবেই। এশিয়া কাপ থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলা ৮টি টি–টোয়েন্টির একটিতেও প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানেরা সেভাবে চড়াও হতে পারেননি। এই ৮ ম্যাচের মধ্যে প্রতিপক্ষ আগে ব্যাটিংয়ে নেমে সর্বোচ্চ ১৬৮ রান তুলতে পেরেছে (এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা ও ভারত)। বোলিংয়ে বাংলাদেশ যে উন্নতি করেছে সেটি এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।
ব্যাটিংয়ে কাল রাতের ম্যাচে তাকানো যাক। ১৪৭ রান তাড়া করতে নেমে ১০টি করে চার ও ছক্কা মারেন বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা। পরিসংখ্যানটি দেখতে ভালো লাগলেও একটি জায়গায় জড়তার সতর্কবার্তাও দেয়। সেটি হলো স্ট্রাইক অদলবদল করে খেলা কিংবা চার–ছক্কার পাশাপাশি সিঙ্গেলস–ডাবলস নিয়ে খেলার প্রবণতাটা কম বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। এশিয়া কাপ থেকেই একটি গুঞ্জন উঠেছে, ‘কুইক সিঙ্গেল’ মানে রান চুরি করতে ভালো দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। প্রশ্ন হলো, সেই দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার প্রবণতা কতুটুক? কাল দ্বিতীয় ম্যাচে যেমন ১৪৭ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ চার–ছক্কাতেই তুলেছে ১০০ রান। ১০ চার থেকে এসেছে ৪০ রান, ১০ ছক্কা থেকে ৬০ রান। অতিরিক্তের খাত থেকে এসেছে ২।
অর্থাৎ ‘এক্সট্রা’ ও চার–ছক্কা থেকেই ১০২ রান পেয়েছে বাংলাদেশ। যেহেতু তাড়া করতে নেমে ১৫০ রান করেছে, তাই দৌড়ে রান নেওয়ার সংখ্যাটা ৪৮। ‘ডট’ বলের সংখ্যা ৫৩। তার মানে হলো ১২০ বলের ইনিংসে বাংলাদেশ জয় পেতে খেলেছে ১১৫ বল—এর মধ্যে ৬২টি ডেলিভারিতে স্কোরিং শট খেলতে পেরেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
চারে জাকের আলী, পাঁচে শামীম হোসেন ও ছয়ে নুরুল হাসান। এদের কেউই পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান নন। মানে ম্যাচের চরিত্র বুঝে উইকেটের চারপাশে শট খেলা, স্ট্রাইক অদলবদল করে খেলে ফিল্ডারদের চাপে রাখা—এসব দক্ষতা বড় দলগুলোর মিডল অর্ডারে দেখা গেলেও বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডারে তা প্রায় নেই।
চাইলে প্রথম ম্যাচের স্কোরবোর্ডেও তাকাতে পারেন। ১৫১ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ খেলেছে ১৮.৪ ওভার—মানে ১১২ বল। তুলেছে ১৫৩ রান। সেই পথে ১২টি চার ও ৮টি ছক্কা মারা হয়। অর্থাৎ চার ও ছক্কা থেকে এসেছে (৪৮+৪৮) ৯৬ রান। অতিরিক্তের খাত থেকে এসেছে ৫ রান। চার–ছক্কা ও অতিরিক্ত মিলিয়ে মোট রান ১০১। তার মানে হলো দৌড়ে ৫২টি রান নিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। এই ইনিংসে ৪৮টি ‘ডট’ বল খেলেন তারা। অর্থাৎ ব্যাটসম্যানদের খেলা ১১২টি বলের মধ্যে ৬৪টি ডেলিভারি ছিল স্কোরিং শট।
প্রশ্ন তুলতে পারেন, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ যেহেতু জিতেছে, তাই এসব পুরোনো ‘ক্ষত’ খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলাটা অর্থহীন। শুধু এই সিরিজে তাকালে অবশ্যই ব্যাপারটি অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু যদি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, প্রায় ১০ দিন আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনালে বাংলাদেশ হেরেছিল মাত্র ১১ রানে। ১৩৫ রান তাড়া করতে নেমে ৯ উইকেটে ১২৪ রানে থেমেছিল বাংলাদেশের ইনিংস। সেই ইনিংসে ৭ ছক্কার সঙ্গে ৬টি চার মেরেছিলেন ব্যাটসম্যানরা। অর্থাৎ বাউন্ডারি থেকে এসেছিল ৬৬ রান। অতিরিক্ত থেকে ২। ১২০ বল খেলার পথে সেই ইনিংসে দৌড়ে ৫৬ রান নিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানরা। ডট দিয়েছিলেন ৬০টি ডেলিভারি।
আবারও স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক ম্যাচটা ১১ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ, দৌড়ে রান নেওয়ার অভ্যাস কিংবা এ বিষয়ে কৌশলগত দক্ষতাটা আরেকটু ভালো হলে ম্যাচটা সম্ভবত বাংলাদেশকে হারতে হতো না।
চাইলে আরেকটু গভীরে ভাবতে পারেন। গত কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জাতীয় দল অবশ্যই ব্যাটিং ব্যর্থতায় হেরেছে, তবে ডট দেওয়া ৬০টি ডেলিভারির সংখ্যা আরেকটু কমানো গেলে জয়ের পাশাপাশি ব্যাটিং ব্যর্থতাও ঢেকে ফেলা যেত। সেটি না হওয়ার কারণ সম্ভবত একটা সহজ সমীকরণে আস্থা রাখা—টি–টোয়েন্টি যেহেতু চার–ছক্কা মারার খেলা, তাই সিঙ্গেলস–ডাবলস প্রায় ভুলে বাউন্ডারি মারায় বেশি মনোযোগ দেওয়া।
বলতে পারেন, দল তো জিতেছে তাই সমস্যা নেই। হ্যাঁ, এই ম্যাচে তা হয়তো নেই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এসব ছোট ছোট বিষয় যে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে সেটার উদাহরণ তো এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনাল!
তবে এশিয়া কাপ থেকে শুরু করে কালকের ম্যাচ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে চোখ রাখলে একটি কৌশলগত সমস্যাও চোখে পড়তে পারে। বেশি পিছিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, কালকের ম্যাচে তাকান—টপ অর্ডারে তানজিদ হাসান, পারভেজ হোসেন ও সাইফ হাসান। তানজিদ ও সাইফ মোটামুটি সব দিকেই খেলতে পারেন। পারভেজের অনসাইডে খেলার প্রবণতা বেশি, তবে অফ সাইডেও ব্যাট তাঁর ভালোই চলে; কিন্তু মিডল অর্ডার? চারে জাকের আলী, পাঁচে শামীম হোসেন ও ছয়ে নুরুল হাসান। এদের কেউই পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান নন। মানে ম্যাচের চরিত্র বুঝে উইকেটের চারপাশে শট খেলা, স্ট্রাইক অদলবদল করে খেলে ফিল্ডারদের চাপে রাখা—এসব দক্ষতা বড় দলগুলোর মিডল অর্ডারে দেখা গেলেও বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডারে তা প্রায় নেই।
জাকের, শামীম ও নুরুল—তিনজনই সব সময় নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা রেখে ব্যাট করেন, যেটা ভালো ব্যাপার; কিন্তু সমস্যা হলো, সে শক্তির জায়গাটি শুধু লেগ সাইডেই সীমাবদ্ধ। অফসাইডে তাঁরা প্রায় খেলেন না বললেই চলে। যে কারণে সিঙ্গেলস–ডাবলস আসার একটি দিকও প্রায় বন্ধই থাকে। কাল নুরুলের ইনিংস যদি দেখেন—২১ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকার পথে নুরুল প্রথম ছক্কা মেরেছেন টানা চারটি বল ‘ডট’ খেলার পর। দ্বিতীয় ছক্কাটি নবীর বাজে বলে এবং শটটি ভালো ছিল।
তৃতীয় ছক্কাটি মেরেছেন চাপ কাটিয়ে উঠতে—কারণ, ওই ছক্কার আগে ৯টি ডেলিভারিতে বাংলাদেশ ৭ রান তোলার পথে হারায় ৩ উইকেট। অর্থাৎ, ডট খেলার ফাঁস কাটাতে বড় শট খেলেছেন নুরুল। সিঙ্গেলস–ডাবলস নেওয়ার প্রবণতা থাকলে কিন্তু চাপটা কম থাকত। তখন ব্যাটিংটাও আরেকটু সহজ হয়ে যেত। কিন্তু নুরুল তাঁর ২১ বলের ইনিংসে দৌড়ে নিয়েছেন ৯ রান, আর চার–ছক্কা থেকে ২২ রান। অর্থাৎ স্ট্রোক খেলার সঙ্গে ব্যাটিংয়ে সিঙ্গেলস–ডাবলস নেওয়ার যে ভারসাম্যটা লাগে মিডল অর্ডারে, সেটা তাঁর খুব একটা নেই।
যদিও বলতে পারেন, দল তো জিতেছে তাই সমস্যা নেই। হ্যাঁ, এই ম্যাচে তা হয়তো নেই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এসব ছোট ছোট বিষয় যে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে সেটার উদাহরণ তো এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনাল!
কাল ২৫ বলে ৩২ রান করা অধিনায়ক জাকেরের ইনিংসেও তাকাতে পারেন। ৯ম ওভারের শেষ বলে জাকের তাঁর দ্বিতীয় ছক্কাটি মারার আগে ওই ওভারে উঠেছিল ২ রান। অর্থাৎ চাপ কাটাতে তাঁকে বড় শট খেলতে হয়েছে। সেটিতে সমস্যা নেই। তবে ঝামেলা হলো, ১৪৭ রান তাড়া করতে নেমে চার–ছক্কায় ১০০ তোলার পরও হাঁসফাঁস করে মাত্র ২ উইকেটের জয় তুলে নেওয়া। বাংলাদেশ এই ম্যাচে অন্তত আরও ১০টি রান দৌড়ে নিতে পারলেও এত অল্প রান তাড়া করাটাও চাপ মনে হতো না।
ক্রিকেট যেহেতু রানের খেলা তাই দৌড়ে রান নেওয়ার চেয়ে স্কোরবোর্ডে অন্তত চার–ছক্কার গুরুত্ব বেশি। কিন্তু বড় দলের বিপক্ষে বড় সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে তো আর ইচ্ছেমতো চার–ছক্কা মারা সম্ভব নয়, তখন চাপটা শিথিল করে দেয় সিঙ্গেলস–ডাবলস। কিংবা বড় দলের বিপক্ষে অল্প রান তাড়া করতে নেমে দ্রুত উইকেট হারিয়ে চাপে পড়লে তো ইচ্ছেমতো চার–ছক্কা মারা যায় না। তখন স্কোরবোর্ড সচল রাখে সিঙ্গেলস–ডাবলস এবং তাতে বোলারের লাইন–লেংথও এলোমেলো করা সম্ভব।
দৌড়ে রান নেওয়ার বিষয়টি আসলে যতটা না দক্ষতা, তার চেয়ে বেশি অভ্যাসের ব্যাপার। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা চার–ছক্কা মারার অভ্যাস গড়তে গিয়ে ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়টি ভুলে গেলে সেটা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বিপদের কারণ হতে পারে।