ক্রিকেটার ও চিত্রশিল্পী—দুই ভুবনের এক সোফি ডে

একইসঙ্গে নিজেকে দুই পেশায় জড়িয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সোফি ডেইনস্টাগ্রাম

অনেক ক্রিকেটপ্রেমী খেলাটিকে শিল্পেরই আরেক রূপ হিসেবে দেখে থাকেন। সম্ভবত ব্যাপারটি অন্য যে কারও চেয়ে ভালো উপলব্ধি করতে পারেন সোফি ডে। অস্ট্রেলিয়ার ২৫ বছর বয়সী এই নারী ক্রিকেটারের আরেক পরিচয় যে চিত্রশিল্পী! যিনি ২২ গজে লড়াইয়ের পাশাপাশি রংতুলির আঁচড়ে ক্যানভাসকে জীবন্ত করে তোলেন।

অবশ্য ডেকে পেশাদার ক্রিকেটার বলার চেয়ে পেশাদার চিত্রশিল্পী বলাই ভালো। একসময় তিনি নিজেকে চারুকলার মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতেন। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছেন মাত্র চার বছর হলো আর আঁকাআঁকির কাজ করছেন সেই ছোটবেলা থেকে।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ভিক্টোরিয়া কলেজ অব দ্য আর্টসে চারুকলা বিষয়ে পড়াশোনাও করেছেন। বিভিন্ন শিল্পকলা জাদুঘর ও চিত্রশালায় প্রায়ই তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। সেগুলো চড়া দামে বিক্রিও হয়। অঙ্কনশিল্পী হিসেবে বেশ সুনাম কুড়ানো ডের ক্রিকেটার পরিচয়টা তাই আড়ালে চলে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক।

কিন্তু ক্যানভাসে দেওয়া তুলির আঁচড়ের মতো মেয়েদের সর্বশেষ বিগ ব্যাশ লিগেও নিজের ক্রিকেটীয় দক্ষতার ছাপ রেখেছেন ডে। গত ১৯ অক্টোবর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত হয়েছিল মেয়েদের বিগ ব্যাশের নবম আসর।

মেলবোর্নের একটি চিত্রশালায় সোফি ডের একক চিত্র প্রদর্শনী
ইনস্টাগ্রাম

প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন ডে। তাঁর দল মেলবোর্ন স্টার্স প্লে অফ পর্বে উঠতে না পারলেও মাত্র ১২.৪৮ গড়ে তিনি নেন ২৭ উইকেট; যা আবার টুর্নামেন্টের এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ায় তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে (২০১৬–১৭ মৌসুমে ২৮ উইকেট নিয়েছিলেন সিডনি সিক্সার্সের সারাহ আলেই)। এরপরেই ডেকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়।

জন্ম অস্ট্রেলিয়ায় হলেও শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে ডের পথচলা শুরু হয়েছে ইংল্যান্ডে। ২০১৯ সালে ইংলিশ ক্লাব বার্কশায়ারে নাম লেখান। এক মৌসুম সেখানে খেলে যোগ দেন হেনলি ক্রিকেট ক্লাবে। সেখানেই ইংল্যান্ড নারী দলের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিদার নাইট, পেসার আনিয়া শার্বসোল ও ফাস্ট বোলার লরেন বেলকে সতীর্থ হিসেবে পান। মূলত নিজ রাজ্য দল ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতেই ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিলেন ডে। কারণ, স্বীকৃত ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলে রাজ্য দলের সঙ্গে চুক্তি করা যায় না।

আরও পড়ুন

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে সম্প্রতি ডের কথা হয়েছে। সেখানেই একই সঙ্গে চিত্রকর্ম ও খেলোয়াড়ি জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন। ডে বলেছেন, ‘আমি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে উন্মুখ ছিলাম। কিন্তু তারা বলেছিল, ম্যাচ–অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আমার তখন খেলার সুযোগ ছিল না। কারণ, তত দিনে আমাদের ঘরোয়া মৌসুম শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম কী করে আরও খেলা যায়। এরপর সেখানে (ইংল্যান্ডে) গেলাম। একই দলে ইংল্যান্ডের অধিনায়ককে পেলাম। শুরুর দিনগুলোতে আমি স্নায়ুচাপে ভুগেছি। কিন্তু দলের কিছু দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। আমি নিজের জন্যই কিছু কাজ করেছি। এটাই আমাকে ব্যক্তি ও ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আমার মনে হয় এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারত না।’

চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি ক্রিকেটেও আলো ছড়াতে শুরু করেছেন ডে
ইনস্টাগ্রাম

২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় নারী টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ড ছেড়ে দেশে ফেরার পর ওই বিশ্বকাপে নেট বোলার হিসেবে সুযোগ পান ডে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নিউজিল্যান্ডের নেটে বোলিং করেছেন তিনি।

বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটিও সে সময় তাঁর ‘আসল পরিচয়’ জেনে যায়। বিখ্যাত মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) ফাইনালের পর সমাপনী অনুষ্ঠানে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়। সেদিন ছিল ৮ মার্চ। মানে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তাঁর চিত্রকর্মেও ছিল নারী দিবসের ছাপ। দিবসটির সঙ্গে মিল রেখে এর নাম দিয়েছিলেন ‘৮ই মার্চ’।

এরপর ডেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের মাসেই রাজ্য দল ভিক্টোরিয়া ও বিগ ব্যাশ ফ্র্যাঞ্চাইজি মেলবোর্ন স্টার্স তাঁকে দলে নেয়। ভিক্টোরিয়া দলে যোগ দেওয়ার পরের স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে, ‘প্রথম কয়েকটি ম্যাচে আমি সতীর্থদের জন্য পানি বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। ওই সময় আমার সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার চুক্তি হয়নি। দলের সবাই চমৎকার ব্যক্তিত্ব ছিল। মনে হয়েছিল আমি সম্ভবত দলের বিরক্তিকর সদস্য হতে চলেছি, যে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। কিন্তু সব অবদান ওদের। ওরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। ওদের কারণেই আজ এত দূর আসতে পেরেছি।’

২০২০ সালেই ভিক্টোরিয়া ও মেলবোর্ন স্টার্সের সঙ্গে চুক্তি হয় ডের। কিন্তু মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেলে ডের মাঠে নামার অপেক্ষা বাড়ে। অবশেষে ওই বছরের অক্টোবরে মেলবোর্ন স্টার্সের হয়ে বিগ ব্যাশে অভিষেক হয়।

ক্রিকেটে নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব সতীর্থদের দিয়েছেন ডে
ইনস্টাগ্রাম

চলতি বছর তিনি খেলেছেন বিগ ব্যাশে তাঁর চতুর্থ আসর। এখানে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম অধিনায়ক মেগ ল্যানিংকে। একই দলে খেলেছেন আনাবেল সাদারল্যান্ড, সোফিয়া ডাঙ্কলি, অ্যালিস ক্যাপসিদের মতো নারী ক্রিকেটের পরিচিত মুখদের সঙ্গে।

তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার পর থেকে ডের ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরও ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন জাতীয় দল অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বজুড়ে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা। তবে সবকিছুই করতে চান তাঁর চিত্রশিল্পের সত্তা ঠিক রেখে। বিবিসিকে সেটাও জানিয়ে রেখেছেন ডে, ‘আমি সব সময় আঁকাআঁকি করি। স্বেচ্ছায় ক্রিকেটে দেরিতে এসেছি। আমার ধারণা, আমি সব সময় খেলা ও চিত্রশিল্পকে নিজেকে প্রকাশের জায়গা হিসেবে খুঁজে পেয়েছি।’

অন্য কোথাও খেলতে গেলেও রংতুলি ও আর্ট পেপার সঙ্গে রাখেন ডে। দলও তাঁর ইচ্ছা পূরণে সব ধরনের সুযোগ করে দেয়। চিত্র প্রদর্শনীর সময় তাঁকে ছুটিও দেওয়া হয়। এখন ডে নিজেকে চিত্রশিল্পী–ক্রিকেটার দুই পরিচয়ই দিয়ে থাকেন। নিজ নামে তাঁর একটি ওয়েবসাইটও আছে—sophieday.com.au। সেখানে ঢুকতেই একটি লেখা চোখে পড়বে, ‘হ্যালো, আমি সোফি। ক্রিকেট ও চিত্রশিল্পের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। আর এই ওয়েবসাইট খেলোয়াড়, শিল্পী ও দর্শকদের জন্য।’

খুদে ভক্তদের সঙ্গে ডের সেলফি
ইনস্টাগ্রাম

কীভাবে ক্রিকেট আর চিত্রশিল্পের মধ্যে মিল খুঁজে পেলেন, সেটার ব্যাখ্যাটা তাঁর কাছে এ রকম, ‘ক্রিকেট মাঠে আপনাকে সবার সামনে লম্বা সময় ধরে পারফর্ম করতে হয়। ব্যর্থ হলে সমালোচিত হতে হয়। চিত্রশিল্পের বেলায়ও তাই। আপনার চিন্তাধারা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে হয়। লোকে সেটা দেখে বিচার করে। পরিপূর্ণ চিত্রশিল্পী হতে যেমন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, ভালো ক্রিকেটার হওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম।’

দুই পেশাতেই সমানতালে মনোনিবেশ করার অনুপ্রেরণা কোথায় পান? ডে জানিয়েছেন, পরিবারই তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস, ‘মা–বাবা সব সময়ই বলে থাকেন, আমি যেটা করতে ভালোবাসি, সেটাই যেন করি। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যে দারুণ দুটি ক্যারিয়ার বেছে নিতে পেরেছি।’

ডের বাবাও রংতুলি নিয়ে কাজ করেন। তিনি একজন সাইনবোর্ড লিখিয়ে। মানে, নামফলক বানিয়ে থাকেন। একসময় ক্রিকেটারও ছিলেন। মেয়ের সঙ্গে এখনো বাড়ির পাশে খেলেন। আর ডের মা থাকেন তৃতীয় আম্পায়ারের ভূমিকায়।

সোফি ডের অনুপ্রেরণার উৎস বাবা–মা
ইনস্টাগ্রাম

কেন? সেটা ডের মুখেই শুনুন, ‘বাবা আর আমার মধ্যে আঁকাআঁকি ও ক্রিকেটে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। বাবা সব সময়ই নিজেকে নটআউট দাবি করেন। সে কারণে মা তৃতীয় আম্পায়ার থাকেন। রিভিউ নেওয়ারও সুযোগ থাকে। কারণ, পুরো খেলা ভিডিও করে রাখা হয়। বাসায় ফিরে বড় স্ক্রিনে বাবাকে আউট হওয়ার প্রমাণ দেখাই। তারপরও তিনি অস্বীকার করেন। বেশ মজা হয়।’

সত্যিই তো, ডের মতো একটা পরিবার থাকলে সাহস জোগাতে, জীবনকে উপভোগ করতে আর কী লাগে! এবারের বিগ ব্যাশে যে দাপুটে বোলিং করেছেন, তাতে তাঁর অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পাওয়াটা সময়ের ব্যাপারই মনে হচ্ছে।