বেসবলের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৫০ বছরের পুরোনো ক্রিকেট ক্লাব

স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাব ক্রিকেটাররাও নেমে পড়েন পিচ ঠিক করতেছবি: টুইটার

বেসবল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় খেলা। বেব রুথ, জো ডিম্যাগিও, রিচি অ্যাশবার্ন, আর্নি ব্যাংকস, ক্রিস্টি ম্যাথুসন, গিল হজসের মতো মার্কিন কিংবদন্তিদের জন্ম দিয়েছে এই খেলা। দেশটির মেজর লিগ বেসবল (এমএলবি) ভীষণ জনপ্রিয় এবং সেখানকার বেশির ভাগ ছেলেপুলের অবসরের সঙ্গীও বেসবল। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রেই কিনা একটি ক্রিকেট ক্লাব ১৫০ বছর পেরিয়ে নট আউট!

বেসবল–পাগল যুক্তরাষ্ট্রের বলেই কিনা টুইটারে এর অনুসারীসংখ্যা মাত্র ৩৬৫। কেভিন ও’ব্রায়েন এবং রায়ান ক্যাম্পবেলের মতো দু–একজন ক্রিকেটার এবং খ্যাতিমান কজন সংবাদকর্মী ছাড়া টুইটারে উল্লেখযোগ্য কোনো অনুসারী নেই ক্লাবটির। ফেসবুকে অনুসারীসংখ্যাও মাত্র ৬১৫। যদিও গত মাসে লঙ্কান কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন ক্লাবটির ১৫০ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা জানান এবং তা ফেসবুকে প্রকাশও করে ক্লাবটি।

ওহ, ক্লাবটির নামই বলা হয়নি—স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাব (এসআইসিসি)। প্রথম টেস্ট ম্যাচ মাঠে গড়ানোর পাঁচ বছর আগেই (২২ মার্চ, ১৮৭২) জন্ম হয় এই ক্লাবের। এ বছর ক্লাবের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগামীকাল এবং পরশু উৎসব হবে নিউইয়র্কের বুকে ওয়াকার পার্কে অবস্থিত ক্লাবটিতে।

চলছে উইকেট প্রস্তুতির কাজ
ছবি: টুইটার

যুক্তরাষ্ট্রে এখনো চালু আছে, এমন ক্লাবগুলোর মধ্যে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাবই সবচেয়ে পুরোনো। ওয়ালস্ট্রিটের ব্যবসায়ী এবং ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর হাতে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী সমাজের ক্রিকেটপ্রেমের ফসল। প্রতিবছরই এখানে খেলা হয় এবং ক্রিকেটের ইতিহাসে কয়েকজন দিকপালও খেলে গেছেন এখানে। এই যেমন ধরুন, স্যার জিওফ্রে বয়কট, স্যার গারফিল্ড সোবার্স ও স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান।

ক্রিকেটে যুক্তরাষ্ট্র এগোতে না পারলেও ১৯৬৫ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পায় দেশটি। ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে বর্তমানে ১৭তম এবং টি–টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে ২৬তম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্রিকেট সেখানে তেমন প্রচলিত খেলা না হলেও ১৫০ বছর পূর্তিতে গর্বিত এসআইসিসির ৯২ বছর বয়সী সভাপতি ক্ল্যারেন্স মোডেস্টে, ‘ক্রিকেট খেলে না, এমন দেশে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এমন একটি ক্লাব নিয়ে গর্বের অনেক কিছুই আছে। এটা মোটেও সহজ নয়।’

স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে খেলে ব্র্যাডম্যানও। খুঁজে বের করতে পারবেন এখানে?
ছবি: টুইটার

দুটি বিশ্বযুদ্ধ পার করেছে ক্লাবটি। একবার ক্লাবহাউসে ভয়াবহ আগুন থেকেও রক্ষা পেয়েছে এসআইসিসি, আর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় করোনা মহামারির ধকল তো ছিলই। তিরিশের দশক থেকে ওয়াকার পার্ককে ঘরের মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা এসআইসিসির ম্যাচ থাকলে মাঠে ম্যাটিং উইকেট পাতা হয় এবং স্টাম্প পোঁতা হয় হাতুড়ি দিয়ে। মাঠে ঘাসের উচ্চতা বেশি হওয়ায় খেলোয়াড়েরা মাটি কামড়ানো শটের চেয়ে বাতাসে ভাসিয়ে খেলতেই বেশি পছন্দ করেন। ক্লাবটির ন্যূনতম প্রায় ৮০ জন সদস্যের অনেকেই এভাবে খেলে এসেছেন। লং আইল্যান্ড থেকে গাড়িতে দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে এখানে খেলতে আসা চারু চৌধুরী সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন, ‘সুন্দর কাভার ড্রাইভ করার সুযোগ নেই। বল এগোয় না।’

এসআইসিসির খেলার সঙ্গে বাংলাদেশের গলি–মহল্লার ক্রিকেটের কিছু মিল পাওয়া যায়। মাঠের চারপাশে ফুটপাত হলো বাউন্ডারি সীমানা, বল গাছের পাতায় লাগলে ছক্কা এবং উইকেটের এক প্রান্ত থেকে বল করা হয়। মাঠের আশপাশে বাড়িঘর থাকায় উড়ন্ত বল গিয়ে বাসাবাড়ির ক্ষতি করতে পারে—এই সাবধানতার জন্য এক প্রান্ত থেকে বল করা হয়।

মোডেস্টের আশা, পার্কটি যে অধিদপ্তরের অধীনে তারা ৪০ ফুট উঁচু জাল দিয়ে মাঠের চারপাশ ঘিরে দিলে দুই প্রান্ত থেকেই বল করা যাবে। ১৯৬১ সালে মোডেস্টে যখন এসআইসিসিতে যোগ দেন, তখন ক্লাবটির ৯০ শতাংশ ক্রিকেটার ছিলেন শ্বেতাঙ্গ—ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ক্রিকেটাররাও আছেন। ৩০ বছর আগে ভারতের দিল্লি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো সুনীল নায়ারের কাছে এসআইসিসিতে ক্রিকেট খেলা মানে নিজের দেশের জীবনকে স্মরণ করা, ‘এটা আমার কাছে সবকিছু। এখানে ক্রিকেট খেললেই দেশকে মনে পড়ে।’

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট মোটামুটি ভালোই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু বেসবলের জনপ্রিয়তার সামনে খেলাটি টিকতে পারেনি। বেসবলে সময় কম লাগে। ইউএসএ ক্রিকেটের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এখন ক্রিকেটারের সংখ্যা লাখ দুয়েক, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ। ইউএসএ ক্রিকেটের আশা, ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে, তখন এই টুর্নামেন্ট ঘিরে দেশটিতে খেলাটির জনপ্রিয়তা বাড়বে।

৯২ বছর বয়সী সভাপতি ক্ল্যারেন্স মোডেস্টে (ডানে)
ছবি: টুইটার

৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য বয়সভিত্তিক প্রকল্প আছে এসআইসিসির। তবে মোডেস্টের আশা, যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে ক্রিকেট চালু করলে খেলাটির জনপ্রিয়তা বাড়বে। সাপ্তাহিক ছুটিতে শুধু নিউইয়র্ক শহরেই শ খানেক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয় আর এসআইসিসি এর কেন্দ্রস্থল। ঘরোয়া লিগে খেলার পাশাপাশি সফরেও যান এসআইসিসির খেলোয়াড়েরা।

১৯৩২ সালে এসআইসিসির মাঠ ওয়াকার পার্কে অস্ট্রেলিয়া দল নিয়ে খেলে গেছেন ব্র্যাডম্যান। আন্তর্জাতিক একাদশ নিয়ে ১৯৮৮ সালে এখানে খেলেছেন সোবার্স। ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সপ্তাহে ফিলাডেলফিয়া দলের সঙ্গে খেলবে এসআইসিসি। মোডেস্টে চান নিউইয়র্কের বুকে অবস্থিতি এই ক্লাব বিশ্বব্যাপী আরও পরিচিতি পাক, ‘ক্লাবটি বিশ্বের বুকে পরিচিত এবং আমরা চাই আরও পরিচিতি পাক।’