সার্ফারদের স্বর্গে ভয় নেই সারসদেরও

গোল্ডকোস্টের দরজা আসলে উন্মুক্ত। সেটা সার্ফারই হোন, কিংবা সাধারণ পর্যটক অথবা ওই সারস পাখির ঝাঁক।

প্রশান্ত মহাসাগরের গোল্ডকোস্টের সার্ফার্স প্যারাডাইস বিচছবি: প্রথম আলো

ব্রিসবেনে এলে নাকি গোল্ডকোস্টে যেতে হয়। না গেলে ব্রিসবেনে আসাই বৃথা।

অস্ট্রেলিয়ার প্রায় প্রতিটি শহরে গেলেই একটা না একটা বিশেষ দ্রষ্টব্যের হাতছানি থাকে। হোবার্টে গিয়ে যেমন মাউন্ট ওয়েলিংটনে উঠেছি, যদিও মেঘের দিনে মেঘের রাজ্যে উঠে নিচে তাকিয়েও শুধু মেঘই দেখা গেছে। সিডনি গেলে ছবি তুলতে হয় সিডনি অপেরা আর হারবার ব্রিজ পেছনে রেখে। ব্রিসবেনের জন্যও গোল্ডকোস্ট তেমনই এক জায়গা।

গোল্ডকোস্ট অবশ্য ব্রিসবেনে নয়। কুইন্সল্যান্ডের রাজধানী ব্রিসবেন থেকে গাড়িতে ৪০–৪৫ মিনিট দূরত্বের পার্শ্ববর্তী শহর। তবু ব্রিসবেনের মানুষ মনে করে, গোল্ডকোস্ট তাদেরও। কারণ, ব্রিসবেনবাসীর সেখানে গিয়ে হোটেল ভাড়া করে থাকার দরকার নেই। দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায়।

গোল্ডকোস্টের সার্ফার্স প্যারাডাইস বিচ
ছবি: প্রথম আলো

সোনালি সৈকতের শহর গোল্ডকোস্টে সে রকমই এক ঝটিকা সফর হয়ে গেল গতকাল। সঙ্গী ঢাকা থেকে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে অস্ট্রেলিয়ায় আসা আরেক ক্রীড়া সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ এবং যিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন, সেই বাল্যবন্ধু রনি হাসান। ব্রিসবেনে আসব শুনে তাঁরও কথা ছিল, ‘ব্রিসবেন আসবি আর গোল্ডকোস্টে যাবি না!’

গোল্ডকোস্টে গিয়ে প্রথম যে কথাটা মনে হলো, এ শহরের মানুষদের বোধ হয় কোনো কাজকর্ম নেই। সারা দিন সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকে। গল্প–আড্ডা আর ঘোরাফেরাতেই যত ব্যস্ততা। এখানে হয়তো বাচ্চাদের স্কুলে যেতে হয় না। সমুদ্রে দাপাদাপি করা, রাস্তায় সাইকেল চালানো আর থিম পার্কে ঘুরেই ওদের সময় কাটে। এদের ঘরে বোধ হয় রান্না হয় না। আসলে কোনো ঘরও কি আদৌ আছে এদের? এত এত উঁচু ইমারতের প্রায় সবই তো বিলাসী হোটেল। এসব থাকতে আর ঘরবাড়ির দরকার কী!

বিশ্বের সব পর্যটকের শহরই কমবেশি এ রকম হলেও প্রশান্ত মহাসাগরপারের গোল্ডকোস্টের কিছু বাড়তি আবেদন আছে, যেটা পর্যটকদের বারবার টেনে আনে এ শহরে। অস্ট্রেলিয়ায় পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এটি মূলত আরামদায়ক আবহাওয়া, দীর্ঘ সৈকত, সার্ফিংয়ের জন্য সমুদ্রের রোমাঞ্চকর উঁচু ঢেউ আর আকর্ষণীয় সব থিম পার্কের সৌজন্যে।

গোল্ডকোস্টে সার্ফিংয়ের জন্য আছে অসংখ্য সৈকত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর উঁচু ঢেউয়ের সার্ফার্স প্যারাডাইজ। এক পাশে সমুদ্র, আরেক পাশে বিলাসবহুল সব হোটেল, শপিং মল আর রেস্তোরাঁ। দিন–রাত ২৪ ঘণ্টাই পর্যটকদের আনাগোনায় জমজমাট এই পরিবেশটা অবশ্য কিছুদিন আগে একরকম হারিয়েই গিয়েছিল। গোল্ডকোস্ট আবার রঙিন হবে, এটা কল্পনা করাই তখন দুঃসাধ্য ছিল।

ব্রিসবেনের পার্শ্ববর্তী শহর গোল্ডকোস্ট অস্ট্রেলিয়ায় পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম জায়গা
ছবি: প্রথম আলো

করোনার কারণে সারা পৃথিবীতেই যখন তালা লেগেছিল, তখন গোল্ডকোস্টও হয়ে পড়েছিল পর্যটকশূন্য। হোটেল–রেস্তোরাঁ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। করোনা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোল্ডকোস্টের সৈকতগুলো ফিরে পেয়েছে প্রাণ।

সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় শুধু ছুটি কাটানোর খরচটাই একটু বেড়ে গেছে। করোনার ক্ষতি পোষাতে ব্রিসবেনের সপ্তাহে ৫০০ ডলারের ঘরভাড়া যখন ৭৫০ ডলার ছুঁয়েছে, গোল্ডকোস্টের পর্যটকদেরও তখন বাড়তি ডলার গুনতে হওয়াটাই স্বাভাবিক। অস্ট্রেলিয়ারই অন্যতম ব্যয়বহুল শহর এটি।

পর্যটকদের শহর হিসেবে গোল্ডকোস্টের পরিচিতি বেশি হলেও অস্ট্রেলিয়ায় আবাসিক শহর হিসেবেও এটির বেশ জনপ্রিয়তা। সর্বশেষ হিসাবে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষের বাস ৪১৫ বর্গকিলোমিটারের এ শহরে।

আর আছে ঝাঁকে ঝাঁকে সারস পাখি। সৈকতে যান, শপিং মলের সামনে যান, রাস্তার পাশের খোলা রেস্তোরাঁয় যান—দেখা পাবেন ‘পোষা’ সারস পাখির। ‘পোষা’ বলার কারণ আপনি অনেক কাছে চলে যাওয়ার পরও তারা উড়ে যাবে না। এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে তো দেখা গেল, অতিথিদের টেবিলের ওপরই নির্ভয়ে হাঁটাহাঁটি করছে একটা সারস পাখি!

গোল্ডকোস্টের দরজা আসলে উন্মুক্ত। সেটা সার্ফারই হোন, কিংবা সাধারণ পর্যটক অথবা ওই সারস পাখির ঝাঁক। সোনালি সৈকতের শহর সবাইকেই আবাহন জানায় তার জাদুকরি অলস সৌন্দর্যে ডুবে যেতে।