ভারতের হিসাবও কি পাল্টে দিতে পারবেন সাইফ

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দারুণ ব্যাটিংয়ের পর সাইফ হাসানকে নিয়ে এখন সব প্রতিপক্ষকেই ভাবতে হবেএএফপি

‘সাইফ যেভাবে ব্যাট করল, আমরা আলোচনা করছিলাম, এশিয়া কাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে তার (অতীত) যোগ্যতা কোনোভাবেই টি-টোয়েন্টিতে শীর্ষ সারির ওপেনার হওয়ার মতো না। কিন্তু সে যেভাবে হাজির হলো, মনের মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। নিজেকে নিয়ে সন্দেহে ভোগেনি...আমার মনে হয় সে খুব খুব ভালো ছিল। তার পরিসংখ্যান দেখলে মনে হবে মাঝারি মানের কেউ। কিন্তু কেউ যদি এই ব্যাটিংটা দেখে তাকে যাচাই করে বলতেই হবে, সে সিরিয়াস প্রতিভা।’

এশিয়া কাপে গত শনিবার সুপার ফোরে শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। সেই ম্যাচের ভিডিও বিশ্লেষণে সাইফকে নিয়ে কথাগুলো বলেন ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষক আকাশ চোপড়া। তাঁর কথার ভেতরের বার্তাটা কি ধরতে পেরেছেন? সে জন্য ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কের কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। কারণ প্রতিপক্ষের ড্রেসিংরুমের খবর জানার সুযোগ নেই।

একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। এশিয়া কাপ শুরুর আগে বাংলাদেশ দল নিয়ে সুপার ফোরে ওঠা বাকি তিন দলের চিন্তাভাবনা কি ছিল? সেটা জানা না গেলেও দুই-একটি দলের সাবেকেরা কিন্তু ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ দল নিয়ে সবার ভাবনাটা কী। ভারতের সাবেক স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন যেমন বাংলাদেশ নিয়ে নিজের বিশ্লেষণে বলেছিলেন, ‘ব্যাটিংয়ে লিটন ছাড়া কোনো ক্লাস দেখি না।’ ভারতের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষক হার্শা ভোগলেও প্রায় একই সুরে বলেছিলেন, ‘লিটন রান পেলে বাংলাদেশ কিন্তু অন্য দল।’

দ্রুত রান তোলার ক্ষমতা আছে সাইফের
এএফপি

ভোগলে ও অশ্বিন ভুল বলেননি। লিটন রান পেলে বাংলাদেশ সত্যিই অন্য দল। তবে তাদের এই কথায় অনুচ্চারে আরেকটি বার্তাও পাওয়া যায়—বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং সম্পূর্ণভাবে লিটনের ওপর নির্ভরশীল। এবার কল্পনার রথ ছোটানো যায়। এশিয়া কাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে ভাবনাটা নিশ্চয়ই এর বাইরে নয়? লিটনের বাইরে বড়জোর তাওহিদ হৃদয় কিংবা তানজিদ হাসান হয়তো প্রতিপক্ষের ভাবনায় ছিলেন।

বাংলাদেশ সুপার ফোরে ওঠার পথে তানজিদ ও লিটন ফিফটি পেয়েছেন একটি করে ইনিংসে। সুপার ফোরে ওঠার পর তাই বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং নিয়ে প্রতিপক্ষের ভাবনায় এ দুজনের থাকার কথা। সুপার ফোরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে হৃদয় ফিফটি পাওয়ায় এখন হয়তো তাঁর নামটাও যোগ হবে। কিন্তু সুপার ফোরের বাকি তিনটি দলকেই বড় সমস্যায় ফেলেছেন সাইফ। ব্যাপার অনেকটাই এ রকম যে, সিলেবাসে ছিল ‘লিটন ও তানজিদ’—সেখানে শ্রীলঙ্কাকে আগে দিতে হয়েছে সাইফ-পরীক্ষা! তাতে অনেক হিসাব-নিকাশই উল্টে যাওয়ার কথা।

আরও পড়ুন

ভেবে দেখুন, বাংলাদেশ সুপার ফোরে ওঠার পর সবাই একটি মনস্তাত্ত্বিক অঙ্ক কষেছেন—সুপার ফোরে অভিজ্ঞতা ও শক্তির বিচারে বাংলাদেশ বাকি তিন দলের চেয়ে পিছিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে হারিয়ে ২ পয়েন্ট তুলে নেওয়ার সহজ-স্বপ্ন দেখেছে তিন দলই—শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান। অন্তত বড় টুর্নামেন্টে অভিজ্ঞতা এবং শক্তির নিরিখে এটা বলাই যায়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা হেরে যাওয়ায় এবং সেই ম্যাচে সাইফ অনেকটাই ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ এর মতো উদয় হওয়ার পর অবশ্যই বাংলাদেশের বিপক্ষে পরিকল্পনাটা পরিমার্জনা করতে হচ্ছে তিন দলকে।

যেমন ধরুন ভারত। দুবাইয়ে আজ সুপার ফোরে তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট নিশ্চয়ই দেখেছেন? হৃদয়ের ফিফটির আগে জয়ের ভিত গড়া সাইফের ৪৫ বলে ৬১ রানের ইনিংসটি দেখার পর ভারতের টিম ম্যানেজমেন্টেরও আকাশ চোপড়ার মতো বিস্মিত হওয়ার কথা।

ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানের খেলার ধাঁচ আগাপাশতলা বিশ্লেষণ করা হয়। সমস্যা হলো, সাইফকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি ছাড়া আসলে বিশ্লেষণের তেমন কিছু নেই। কারণ এই ম্যাচের আগে জাতীয় দলে সাইফের ক্যারিয়ারকে আসলে ভারতেরই এক সিনেমার নামেও নামকরণ করা যায়—‘আসা যাওয়ার মাঝে’।

এশিয়া কাপের আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে চার বছরে ৮ ম্যাচ—সেটাও দুই বছর পর পর। ২০২১ সালে অভিষেকের বছর দুই ম্যাচ। মাঝে দুই বছরের ছেদ টেনে তেইশে ফিরে তিন ম্যাচ, সেটিও আবার মূল জাতীয় দলে নয়, এশিয়াডের দলে। মূল জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন গত মাসে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সিরিজে—এশিয়া কাপের আগে এই হলো সাইফের ক্যারিয়ার।

আরও পড়ুন

এমন কেউ টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং (শ্রীলঙ্কা) লাইনআপের বিপক্ষে বাংলাদেশের রান তাড়ায় নেতৃত্ব দেবেন, সেটাও দলের সেরা ব্যাটসম্যান অন্য প্রান্তে থাকতে! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৩৪ বলের জুটিতে লিটন অন্তত ২৫ বল পর্যন্ত বাউন্ডারি মারেননি। প্রান্ত বদলে যতটা সম্ভব স্ট্রাইক দিয়েছেন সাইফ হাসানকে। রান তাড়ার ময়দানি স্ক্রিপ্টে মূল চরিত্র তখন পার্শ্ব—আর পার্শ্বচরিত্র মূল ভূমিকায়! ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট এটুকু দেখার পর যখন জেনেছে, ব্যাটিংয়ে সাইফের বর্ণপরিচয় টেস্ট-ধারাপাতে—তখন হয়তো বিস্ময়ে চোয়াল খসে পড়েছে। কীভাবে সম্ভব এই রূপান্তর!

সাইফের এই রূপান্তর আলোচনায় আসে নেদারল্যান্ডস সিরিজে গত আগস্টে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৯ বলে তাঁর বিস্ফোরক ৩৬ রানের অপরাজিত ইনিংসের পর। বিসিবির ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভিডিওবার্তায় সাইফ জানিয়েছিলেন, লেগ সাইডে শটের রেঞ্জ বাড়াচ্ছেন। পাওয়ার হিটিং কোচ জুলিয়ান উডের অধীনে শটের সম্ভারও তিনি বাড়িয়েছেন। সেই প্রমাণ তো দেখা গেল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচেই। বাঁহাতি স্পিনারকে এগিয়ে এসে ছক্কা মেরেছেন। পুল করেছেন, কাভারের ওপর দিয়ে খেলেছেন এবং নুয়ান তুষারাকে ‘ফ্লিক’ করে মারা চোখজুড়ানো ওই ছক্কাটা তো আছেই। সাইফকে নিয়ে ভারতের গেম-প্ল্যানিংয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে ওই ছক্কাটাই।

তুষারার বিপক্ষে লেগ স্টাম্প থেকে একটু সরে এসে তিন স্টাম্পের ভেতরে থেকে ব্যাট করে রান বের করেন সাইফ। সুইংয়ের জন্য তুষারা একটু ফুল লেংথে বল করায় সাইফের তুলে খেলতে সুবিধা হয়। ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট যশপ্রীত বুমরা কিংবা অর্শদীপ সিং যাকেই খেলাক—এই বিষয়টি নিশ্চয়ই মাথায় থাকবে। পাশাপাশি স্পিনার অক্ষর প্যাটেল একটু জোরের ওপর বল করায় নতুন বলে সাইফের অসুবিধা হওয়ার কথা না।

সাইফ এই লড়াইয়ে সফল হোক বা না হোক—বড় বিষয় হলো একটি ইনিংস দিয়েই প্রতিপক্ষের হিসাব পাল্টে দিয়েছেন তিনি। তাতে দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের ভালো করার সুযোগটাও কিন্তু বাড়ে।