‘সাদা’ ক্রিকেটে আলোকস্বল্পতার ‘কালো ছায়া’

করাচি টেস্টে বারবারই আলোক–পরিস্থিতি দেখতে হয়েছে আম্পায়ারদেররয়টার্স

শুধু হাত ধরে অনুনয় করাই যেন বাকি রেখেছেন উসমান খাজা।

প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি মাত্র ৫ রান দূরে। কয়েকটি বল খেলার সুযোগ পেলেই হয়তো ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা তুলে নিতে পারতেন। তার আগে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স যাতে ইনিংস ঘোষণা না করেন, সেই অনুরোধ করেছিলেন খাজা। চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে মুখে হাসি রেখেই বললেন, ‘আমি ওকে ডিনার অফার করেছি। বলেছি তোমার বাচ্চা-কাচ্চার দেখভাল করব। আগামী বছর তোমার যা যা দরকার, সবই করে দেব। তবু আমাকে সুযোগ দাও।’

কামিন্স খাজাকে সুযোগ দেননি। চতুর্থ দিনের অর্ধেক শেষ হতে চলেছে। ম্যাচে বাকি মাত্র দেড় দিন। একটা ফলের দিকে যেতে হলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ব্যাটিংয়ে নামাতে হবে। নিজেরা এক ওভার ব্যাটিং করলে সেটিও হয়তো ফলের পথে বাধা হতে পারে! দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে তাই দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত তোলা ৪ উইকেটে ৪৭৫ রানেই ইনিংস ঘোষণা করে দেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। দলগত স্বার্থে জলাঞ্জলি হলো খাজার প্রথম ডাবলের স্বপ্ন!

আরও পড়ুন

সিডনি টেস্টে হাতছোঁয়া দূরত্বে থাকতে খাজার স্বপ্নভঙ্গ কিংবা কামিন্সের ‘নির্মম সিদ্ধান্তে’র মূলে ‘খলনায়ক’ আবহাওয়া। আলোকস্বল্পতা ও বৃষ্টির কারণে প্রথম দুই দিনে খেলা হয়নি ৪৯ ওভার, তৃতীয় দিনে তো বল মাঠেই গড়ায়নি। এরপর চতুর্থ দিনও বৃষ্টির কারণে খেলা শুরু করতে করতে বেলা আড়াইটা বেজেছে। বাকি দিনে খেলা হলো ৫৮ ওভার। এ সময় ৬ উইকেটে ১৪৯ রান তুলে চতুর্থ দিন শেষ করেছে প্রোটিয়ারা। চতুর্থ দিন শেষেও যখন দুই দলের প্রথম ইনিংসই শেষ হয়নি, শেষ দিনে সিডনি টেস্ট কি আর ফল দেখবে?

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দিচ্ছে নেতিবাচক ইঙ্গিত। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হওয়া শেষ ৭ টেস্টের ছয়টিতেই হানা দিয়েছিল বৃষ্টি। এর মধ্যে চারটিরই ফল ছিল ড্র। অতিনাটকীয় কিছু না ঘটলে সিডনি টেস্টেও সম্ভবত ড্র অপেক্ষা করছে।

আরও পড়ুন

শুধু তাসমান সাগরপাড়ের সিডনিতেই নয়, আবহাওয়ার ‘কালো ছায়া’ পড়েছে আরব সাগরপাড়ের করাচিতেও। শুক্রবার পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড টেস্টের পঞ্চম দিনের শেষ মুহূর্তের রোমাঞ্চে ‘জল’ ঢেলে দিয়েছিল প্রতিকূল আবহাওয়া। দিনের খেলা যখন ৩ ওভার বাকি, পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫ রান, নিউজিল্যান্ডের দরকার ছিল ১ উইকেট। চতুর্থ দিন পর্যন্ত নিরুত্তাপ থাকা টেস্ট শেষ মুহূর্তে জন্ম দেয় উত্তাপ ও উত্তেজনার।

কিন্তু আলোকস্বল্পতার কারণে শেষ ৩ ওভার খেলা চালানো যায়নি। দুই দলের সঙ্গে কথা বলে ম্যাচ শেষের ঘোষণা দেন আম্পায়াররা। এর আগে একই ভেন্যুতে দুই দলের আগের টেস্ট ম্যাচটিও পঞ্চম দিনের শেষ বেলায় একই কারণে বন্ধ হয়ে যায়। সেই ম্যাচে ১৩৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করা নিউজিল্যান্ড ১ উইকেটে ৬১ রান তুলেছিল।

৩ ওভার বাকি থাকতে আলোকস্বল্পতায় শেষ হয় পাকিস্তান–নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্ট
এএফপি

এই যে আবহাওয়ার কারণে রোমাঞ্চকর ম্যাচে ফল না হওয়া, খাজার মতো মাইলফলকের কাছে গিয়েও আক্ষেপ নিয়ে ফেরা—এসব দেখে যারপরনাই বিরক্ত ক্রিকেট দর্শকেরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অস্বস্তিকর অনুভূতির জানান দিচ্ছেন তাঁরা। বিরক্ত ক্রিকেটাররাও। দর্শকদের বিরক্তি একটা পর্যায়ে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি অনাগ্রহই বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা তাঁদের।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার স্কট স্টাইরিস যেমন টুইট করে সে শঙ্কাই প্রকাশ করলেন, ‘যেকোনো দলই জিততে পারে, এমন সময়ে ৩ ওভার বাকি থাকতে খেলা শেষ! টেস্ট ক্রিকেট কেন বিপদে, এটা তার প্রদর্শনী।’ স্টাইরিসের মন্তব্যকে রিটুইট করে আরেক কিউই ক্রিকেটার জিমি নিশাম লিখেছেন, ‘আপনি চারটি দিন নিরর্থক বসে থাকলেন পঞ্চম দিনে এমন উত্তেজনাময় সমাপ্তি দেখার জন্য। তারপর এই ফালতু ঘটনা। খেলাটার মধ্যে কী উল্টোপাল্টা ব্যাপার!’

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহও মনে করেন, ঠিকমতো খেলা ছাড়াই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়াটা ক্রিকেটের জন্য ক্ষতিকর, ‘টেস্ট ক্রিকেটকে বুঝতে হবে, আশপাশে প্রচুর টুর্নামেন্ট হচ্ছে এখন। আলোকস্বল্পতার কারণে খেলোয়াড়েরা যখন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন আলো না জ্বালানোর কোনো মানে হয় না।’

স্টিভের ভাই মার্ক ওয়াহও আলোকস্বল্পতার কারণ দেখিয়ে খেলা বন্ধের বিপক্ষে, ‘আমি হলে নিয়মটা পাল্টে ফেলতাম। লাইট আছে মানে খেলা চলবে। অতি সাধারণ ব্যাপার।’

কিন্তু এই সাধারণ ব্যাপার কি ক্রিকেট নীতিনির্ধারকেরা শুনছেন? অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিএ) অবশ্য কম আলোয় খেলা যায়, এমন বল তৈরির ঘোষণা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু অনুমোদন আর কার্যকরের দায়িত্ব যাদের, সেই আইসিসি কি বিষয়টি নিয়ে ভাবছে? যত দিন না ভাববে, তার আগপর্যন্ত দলীয় স্বার্থে খাজার মতো কেউ বড় মাইলফলকই শুধু মিস করবেন না, পাকিস্তান বা নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোও জয় থেকে বঞ্চিত হবে। ম্যাচের পর ম্যাচ ড্র হয়ে সাদা ক্রিকেটে ঘন হবে আলোকস্বল্পতার ‘কালো ছায়া’।