পারলেন না স্টোকস, পারেনি ইংল্যান্ডও

১৫৫ রানের ইনিংস খেলেছেন বেন স্টোকসরয়টার্স

ইংল্যান্ডের জন্য ‘কুফা’টা কি মাইকেল ভনই লাগিয়েছেন?

দ্বিতীয় সেশনের পানি পানের বিরতি যখন চলছে, সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক বলছিলেন, ‘এ ধরনের বিরতি ব্যাটসম্যানের মনোযোগে জন্য বিপজ্জনক’। ভনের কথার পর দুই ওভারও পার হয়নি। প্যাট কামিন্স ওভার শেষ করে জশ হ্যাজলউড বোলিংয়ে আসতেই ঘটে গেল ‘দুর্ঘটনা’। শর্ট ডেলিভারিতে পুলের চেষ্টা করতে গেলেন বেন স্টোকস। বল ওপরে উঠে গিয়ে নিরাপদে অ্যালেক্স ক্যারির গ্লাভসে। তুমুল হুংকারে চলা বীরত্বপূর্ণ লড়াই থেমে গেল কী নিরীহ এক আঘাতে! যে লড়াই লর্ডসে আত্মসমর্পণের কাছাকাছি থাকা ইংল্যান্ডকে তুলে এনেছিল জয়ের কাছাকাছি। যে লড়াই জাগিয়ে তুলেছিল চার বছর আগের হেডিংলি-হিরোইজমের স্মৃতি।

দ্বিতীয় সেশনের পানি পান বিরতির পর দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটিতে বেন স্টোকসের অমন আউটে হলো না কিছুই। ১৫৫ রান করে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে অধিনায়ক আউট হওয়ার পর বাকি ৭০ রানের অঙ্ক মেলাতে পারেননি অন্যরা। ৩৭০ রান তাড়ায় ৩২৭ রানে অলআউট হয়ে ইংল্যান্ড হারল ৪৩ রানে। এজবাস্টনে ২ উইকেট ব্যবধানের পর লর্ডসে ৪৩ রানে—অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টেই জয়ের হাসি অস্ট্রেলিয়ার।

অথচ স্টোকস যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, হারের শঙ্কায় তটস্থ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডকে ৩৭১ রানের লক্ষ্য দিয়ে চতুর্থ দিনই চার উইকেট তুলে নিয়েছিল প্যাট কামিন্সের দল। পঞ্চম দিন ইংল্যান্ডের ২৫৭ রান তোলার চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ৬ উইকেট তোলার চ্যালেঞ্জই ছিল তুলনামূলক সহজ। তবে ‘কাঁটা’ হয়েছিলেন একজন স্টোকস। যিনি ফিরিয়ে আনছিলেন ২০১৯ হেডিংলি টেস্টের স্মৃতি।

এজবাস্টনের পর লর্ডসেও জয়ের হাসি অস্ট্রেলিয়ার
রয়টার্স

সে বার অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৫৮ রানের লক্ষ্যে নেমে ১৪১ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছিল ইংল্যান্ড, নবম উইকেট হারিয়েছিল ২৮৬-তে। প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে শেষ ব্যাটসম্যান জ্যাক লিচকে নিয়ে অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের গল্প লিখেন স্টোকস, তাঁর অনবদ্য অপরাজিত ১৩৫ রানে চড়ে ইংল্যান্ড পেয়ে যায় ১ উইকেটের দুর্দান্ত জয়। এবার লর্ডসে লক্ষ্য ছিল আরও বড়, ইংল্যান্ড চতুর্থ উইকেটই হারিয়ে ফেলে মাত্র ৪৫ রানে, চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলেই। সেখান থেকে প্রথমে বেন ডাকেটকে নিয়ে ১৩২ রানের জুটি।

পঞ্চম দিনের সকালে ছয় ওভারের মধ্যে ডাকেটের পাশাপাশি জনি বেয়ারস্টোও যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন, তখনো ১৭৮ রান দরকার ইংল্যান্ডের। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে স্টোকস। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি হেডিংলি-হিরোইজম লেখার সামর্থ্য আর দায়িত্ব দুটোই তখন ইংল্যান্ড অধিনায়কের একার। আগেরবার ছিলেন লিচ, এ যাত্রায় স্টুয়ার্ট ব্রড। অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের কৌশল ছিল পরিষ্কার- লেগ সাইডে চারজন রেখে একের পর এক শর্ট ডেলিভারি করা। পুঁজি যেহেতু বড়, একটু ঝুঁকি তো নেওয়াই যায়।

৯টি ছয় মারেন বেন স্টোকস
রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার এই শর্ট বল কৌশলকেই বুমেরাং করে দেন স্টোকস। একের পর পুল আর হুকে বল ওড়ান বাউন্ডারির বাইরে। এর মধ্যে দুইবার অবশ্য ক্যাচ দিয়েও বাঁচেন। ক্যামেরন গ্রিনকে টানা তিন ছয় মেরে পূর্ণ করেন ১২তম সেঞ্চুরি, এরপর হ্যাজলউড ও স্টার্কদের ওভারে জোড়া ছয় মেরে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসেন জয়ও। স্টোকসের এলোপাতাড়ি ওই সব শটে অবশ্য ক্ষোভও মিশেছিল কিছুটা। যার উদ্ভব প্রথম সেশনে বেয়ারস্টোর রানআউটে।

গ্রিনের একটি বাউন্সার ‘ডাক’ করে বল ‘ডেড’ ভেবে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বেয়ারস্টো। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক ক্যারি স্টাম্প ভেঙে দিয়ে আউটের আবেদন জানান। তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে সাহায্য চাওয়া হলে আসে আউটের সিদ্ধান্ত। যেটাকে অস্ট্রেলিয়ানদের ‘অসততা’ বলেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ইংল্যান্ড, উত্তেজনা ছড়ায় দর্শক গ্যালারিতে। ব্রড তো মাঠে এসেই ক্যারিকে খোঁচা মেরে বলেন, ‘এসবের জন্যই তোমাদেরকে সবাই চিরদিন মনে রাখবে।’

এ নিয়ে পরে মধ্যাহ্ন বিরতিতে লর্ডসের মেম্বারস এরিয়ায় অস্ট্রেলিয়ানদের ওপর হামলার অভিযোগও আসে। ম্যাচ চলার মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ধাক্কা ও গালিগালাজ করা হয়েছে জানিয়ে এমসিসির কাছে তদন্তের দাবি জানায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। বাইরের এ সব নাটকীয়তার মধ্যে মাঠে চলছিল স্টোকসের বীরত্ব-গাঁথা রচনা-পর্ব।

মাথা নিচু করে ফেললেন স্টোকস, আকাশে মাথা তুললেন হ্যাজলউড– লর্ডস টেস্টের জয়–পরাজয় লেখা হেয় গেল এখানেই
রয়টার্স

২০০১ সালে লিডসে মার্ক বুচারের ১৭৩* রানের ইনিংসের পর চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি খেলে দলকে জয়ের দিকে টেনে নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু হ্যাজলউড ওই শর্ট ডেলিভারিতেই থমকে গেল সেটা।

লর্ডস আর হেডিংলি হলো না।