‘মাছটা তাজা ছিল কি না, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতে পারি’

গতকাল ছিল শচীন টেন্ডুলকারের ৫০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ভারতীয় দৈনিক মিড ডে বিশেষ এক সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাঁর। যে সাক্ষাৎকারটি শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছোটবেলা ও বেড়ে ওঠার সময়ের কথা তো বলেছেনই টেন্ডুলকার; বলেছেন কী খেতে পছন্দ, কোন গান শোনেন, কী রান্না করতে পারেন, এমন সব বিষয় নিয়েও—

ভারতীয় কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারএএফপি

প্রশ্ন :

ছেলেবেলায় জন্মদিন বেশি রোমাঞ্চকর মনে হতো?

শচীন টেন্ডুলকার: ও রকম না। খুব বড় কোনো আয়োজন হতো না। খুব সাধারণভাবে কেক কাটা, কোনো বড় পার্টি হতো না। অল্প কজন বন্ধুবান্ধব আসত। যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করলাম, আয়োজন আরও কমে গেল। আমি আসলে ছেলেবেলার জন্মদিন খুব একটা মিস করি না। কারণ, স্কুলে থাকার সময়ে ওই রকম ঘটা করে জন্মদিন পালন করাই হয়নি।

প্রশ্ন :

আপনার জন্মদিনটা পড়েছে বছরের এমন এক সময়ে, যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকে। তার মানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারারও খুব একটা সুযোগ পেতেন না...

টেন্ডুলকার: না, আমি সেটা করতে পারতাম না। আমার সেই সুযোগ ছিল না।

প্রশ্ন :

ক্রিকেট নেটে কেমন উদ্‌যাপন হতো?

টেন্ডুলকার: এই ধরুন একটা বড়া পাও (পাউরুটি), সঙ্গে কোমল পানীয় অথবা কেউ চাইলে বার্গার।

প্রশ্ন :

এত ফিট খেলোয়াড় হওয়ার পরও কোন স্ন্যাক দেখলে নিজেকে সামলাতে পারতেন না?

টেন্ডুলকার: আমি কিন্তু স্ন্যাকস খেতাম। আমার সূত্র ছিল, আপনি যা খুশি খেতে পারেন, কিন্তু যখন খুশি নয়। আমার যখন মনে হতো আমার ফিটনেস ভালো না, আমি যা খুশি খাওয়া বন্ধ করে দিতাম। সহজ ব্যাপার। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলাম। টেস্ট সিরিজ শেষ হয়েছে, ওয়ানডে সিরিজের আগে ড্রেসিংরুমে আমাদের একটা সভা হলো। বড় টুর্নামেন্টের আগে ওটা ছিল আমাদের শেষ সিরিজ। তো কীভাবে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করব? আমি একটা সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলাম এবং বললাম, আমাদের সবাইকে কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমি বলেছিলাম, জানি আমরা সবাই ফিট এবং অনুশীলনের মধ্যে আছি। কিন্তু আমরা কি আরও ফিট হতে পারি? তিন কেজি করে ওজন কমাতে পারি? ছয় সপ্তাহ সময় আছে, আমরা কি আরও বেশি পরিশ্রম করতে পারি? আইডিয়াটা ছিল, আমাদের অবচেতন মনকেও বড় কিছুর জন্য তৈরি করা। কিন্তু তারপরই আমি হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে পড়লাম। আমাকে চিকিৎসকেরা বলল, তুমি দৌড়াতে পারবে না। শুধু হালকা ব্যায়াম করতে পারবে। পরের তিন সপ্তাহ আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি এত বড় বড় বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তাই আমাকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হতো। পরের চার সপ্তাহে আমার খাদ্যতালিকায় সেদ্ধ খাবার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হয়তো সেদ্ধ মাছ বা মুরগি। এর ওপরেই কিছুটা চিলি সস ছড়িয়ে দিতাম। লেটুস পাতাকেই রুটি ভেবে খেতাম। এই করে করে আমি ৩ দশমিক ৮ কেজি ওজন কমাতে পেরেছিলাম। সুতরাং যখন দরকার হয়, আমি খাবার থেকে দূরে থাকতে পারি।

প্রশ্ন :

আপনার সবচেয়ে বিশেষ জন্মদিন তো ছিল মনে হয় ১৯৯৮ সালে, যখন শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করলেন...

টেন্ডুলকার: ওই একটা সময়েই মনে হয় আমি জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছিলাম। আমি কিছুই আয়োজন করিনি। সিবিএফএস (ক্রিকেটার্স বেনিফিট ফান্ড সিরিজ) সেটা করেছিল এবং মার্ক মাসকারেনহ্যাস (পরে টেন্ডুলকারের এজেন্ট ও বন্ধু) যোগাযোগের দায়িত্ব নিয়েছিল। ওরা মিলেই জন্মদিনের একদিন আগে আয়োজন করল। ত্রিদেশীয় সিরিজের সবগুলো দল (ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড) উপস্থিত ছিল। কারণ, সেদিনই অন্য একটা ইভেন্টও ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় (২৩ এপ্রিল) ওরা কেক আনল এবং আমি কাটলাম।

নিজের ২৫তম জন্মদিনে ভারতকে শারজা কাপের শিরোপা জেতানোর পর শেন ওয়ার্নের সঙ্গে টেন্ডুলকারের করমর্দন
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

এখন তো আপনি পুরোপুরি পারিবারিক মানুষ। ছেলেমেয়েদের জন্মদিনই কি আপনার নিজের জন্মদিনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ। তবে ওরাও এখন বড় হয়েছে, (উদ্‌যাপন করার জন্য) বন্ধুবান্ধব আছে। আমার কন্যা (সারা) তো ছয়-সাত বছর ইংল্যান্ডেই ছিল। অর্জুনেরও নানা সফর শুরু হয়েছে। সবাই যখন একসঙ্গে থাকে, সবাই মিলে উদ্‌যাপনের একটা উপলক্ষ পাওয়া যায়।

প্রশ্ন :

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে জন্মদিনের ধারণাটা পাল্টে দিয়েছে?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ, আগে তো এটা পত্রিকা ও টেলিভিশনেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন প্রত্যেক লোকের, প্রত্যেক ভক্তেরই একটা না একটা প্ল্যাটফর্ম আছে আমাকে শুভকামনা জানানোর। ভালোবাসা পেতে ভালো লাগে।

ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন খেতাব পান টেন্ডুলকার
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

জন্মদিনের এমন কোনো উপহার, যেটা অনেক বছর ধরে সংরক্ষণ করে রেখেছেন?

টেন্ডুলকার: ঠিক জন্মদিনের উপহার নয়। আমার বোন (সবিতা) একবার কাশ্মীর গিয়েছিল এবং আমার জন্য কাশ্মীরি কাঠের ব্যাট নিয়ে এসেছিল। ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম সত্যিকারের ব্যাট। আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপহার ছিল সেটা। দ্বিতীয়টা ছিল একটা সাইকেল। আমার কলোনিতে বাকি প্রায় সবারই সাইকেল ছিল। আমি মা–বাবাকে বললাম, আমাকে সাইকেল কিনে না দিলে খেলতে যাব না। ওরা খুব অবাক হয়েছিল। কারণ, আমার বয়স তখন ছয়-সাতের মতো এবং আমাকে ঘরে আটকে রাখা যেত না। আমার বাবা পরে একটা সাইকেল জোগাড় করে দিলেন। তবে এর আগ পর্যন্ত আমি কয়েক দিন খেলতে যাইনি (হাসি)।

প্রশ্ন :

তখন সম্ভবত বুঝতেন না, তাঁদের জন্য কতটা কঠিন ছিল আপনাকে সাইকেল এনে দেওয়া...

টেন্ডুলকার: একদম। এমন কোনো জিনিস ছিল না যে আমি চেয়েছি, কিন্তু আমার বাবা আমাকে এনে দেননি। কিন্তু আমি তখন বুঝতাম না, এর জন্য আমার মা–বাবাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে। তাঁদের যে এত টাকা ছিল না, এটা বুঝতাম না। আমার বাবা কোনো না কোনো উপায়ে যা চেয়েছি, আমাকে তা এনে দিতেনই। আমি আসলে খুবই খুবই ভাগ্যবান ছিলাম। আপনি যখন বড় হবেন, শুধু তখনই এসব বুঝতে পারবেন। ওই সাইকেলটাও অবশ্য আমার জন্মদিনের উপহার ছিল না।

এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে একজন তাঁর পার্স কেড়ে নিয়ে বাসে করে পালিয়ে যাচ্ছিল। ভেবেছিল, আমার মা ওর পিছু ছুটবেন না। কিন্তু মা পুরো পথ ওর পিছু ছুটে শেষ পর্যন্ত পার্স উদ্ধার করেছিলেন। এ নিয়ে তখন পত্রিকায় খবরও হয়েছিল—সাহসী নারী চোর ধরলেন।
মায়ের সাহস প্রসঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার

প্রশ্ন :

বাবার কাছ থেকে আপনি কোন গুণটা পেয়েছেন?

টেন্ডুলকার: তাঁর চরিত্র। তিনি খুবই ধীরস্থির ও সমাধানমুখী মানুষ ছিলেন। দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও পুনেতে থাকা জ্ঞাতিভাইরাও তাঁর পরামর্শ চেয়ে ফোন দিতেন। কিছু কিছু ব্যাপারে তাঁর উপস্থিতিরও দরকার হতো এবং তিনি দাদার (মুম্বাই শহরের একটা এলাকা) থেকে বাসে করে পুনে চলে যেতেন, ওদের সঙ্গে দেখা করে, সময় কাটিয়ে আবার ফিরে আসতেন।

তিনি অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এবং আত্মীয়স্বজনকেও আপন মানুষের মতোই মনে করতেন। আমি তখন বেশ ছোট ছিলাম এবং এসব কিছুই বুঝতাম না। শুধু দেখতাম, তিনি এখানে–সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছেন। যখন মায়ের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলেছি, এই গল্পগুলো শুনেছি। মানুষকে সাহায্য করার এক অসাধারণ প্রবৃত্তি ছিল তাঁর, হোক সে আমাদের সাহিত্য সহবাস কলোনির মালি কিংবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আমরা পাঁচতলায় থাকতাম এবং ওই বিল্ডিংয়ে কোনো লিফট ছিল না। পোস্টম্যান চিঠি দিতে এলে আমার বাবা সব সময় তাঁকে ডেকে ড্রয়িংরুমে বসাতেন, ফ্যান চালিয়ে দিতেন, পানি দিতেন। চা-কফি কিছু নেবেন কি না জিজ্ঞেস করতেন। আমরা বাবার এ কাজগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছি। তিনি যেমন ছিলেন, এর ৫০ ভাগও যদি আমরা হতে পারি, আমরা অসাধারণ মানুষ হব।

প্রশ্ন :

আর মায়ের কাছ থেকে?

টেন্ডুলকার: সাহস। আমার মা মানসিকভাবে অনেক অনেক শক্ত ও পরিশ্রমী। তিনি সান্তাক্রুজে এলআইসিতে (লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন) কাজ করতেন। এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে একজন তাঁর পার্স কেড়ে নিয়ে বাসে করে পালিয়ে যাচ্ছিল। ভেবেছিল, আমার মা ওর পিছু ছুটবেন না। কিন্তু মা পুরো পথ ওর পিছু ছুটে শেষ পর্যন্ত পার্স উদ্ধার করেছিলেন। এ নিয়ে তখন পত্রিকায় খবরও হয়েছিল—সাহসী নারী চোর ধরলেন।

তাঁর অনেক শারীরিক সমস্যা ছিল। পিঠে ও হাঁটুতে ব্যথা ছিল। তবে তিনি এগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলার একটা জীবনযাপন পদ্ধতি বের করেছিলেন। এসব নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিল না, সব সময় হাসিমুখে থাকতেন।

টেন্ডুলকারের ব্যাট দেখছেন তাঁর বাবা–মা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন :

খেলাধুলার জগতের বাইরে এমন কেউ কি আছেন, যাঁর কাছ থেকে আপনি প্রেরণা নেন?

টেন্ডুলকার: মাদার তেরেসা। আমি সব সময়ই ভাবতাম, জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসে আমি এটা (দাতব্য কাজ) করতে চাই। তিনি যা করেছেন, আমি যদি এর সামান্যও করতে পারতাম, ক্ষুদ্র কিছুও, দুর্দান্ত কাজ হতো। আমি বিস্মিত হই, তিনি এত কিছু কীভাবে করেছেন। ও রকম হতে গেলে ভিন্নভাবে ভাবতে জানতে হয়।

প্রশ্ন :

দ্বিতীয় ইনিংসের জন্য কোনো রোডম্যাপ ঠিক করেছেন?

টেন্ডুলকার: আমাদের ফাউন্ডেশন (শচীন টেন্ডুলকার ফাউন্ডেশন) শিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমরা তিনটা বিষয়ের ওপর জোর দিই—শিক্ষা, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য। দেশজুড়ে কাজ হয়। লক্ষ্য হচ্ছে, আরও অবদান রাখা। এখন পর্যন্ত এ কাজে আমার কোনো অংশীদার নেই। তবে আরও সময় গেলে আমরা ভেবে দেখব, কীভাবে এটাকে আরও বড় করা যায় এবং আরও মানুষের জীবনে অবদান রাখা যায়। এই কাজটা আমাকে সন্তুষ্টি দেয়।

টেন্ডুলকারের ৫০তম জন্মদিনে উপলক্ষে মুম্বাইয়ের একটি বহুতল ভবনে টেন্ডুলকারের ছবি আঁকা হয়েছে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

আপনি কি নেলসন ম্যান্ডেলার গুণমুগ্ধ ছিলেন?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ, শতভাগ। তবে আমি মাদার তেরেসার কথা কেন বললাম, ছোটবেলায়ও আমি যখন ক্রিকেট খেলতাম, তাঁকে নিয়ে অনেক কিছু টেলিভিশনে দেখেছি, যেটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। যে নারী এই দেশে জন্ম নেননি, এখানে এলেন এবং অনেকের জীবন বদলে দিলেন। কয়জন মানুষ এটা পারে!

১৯৯৭ সালে ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা হয় টেন্ডুলকারের
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

ঘরে ও কাজের সময় আপনি কি মজা করতে পছন্দ করেন?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ। আমি সিরিয়াস হয়ে থাকতে পছন্দ করি না। চেনা কাউকে পেলে আমি সব সময় তার সঙ্গে কিছু না কিছু করার কথা ভাবতে থাকি। কাজের সময় তো কাজ করতেই হয়। কিন্তু অন্য সময় জীবনটাকেও উপভোগ করতে হবে। আমি এটাই বিশ্বাস করি। যাদের আমি চিনি না, তাদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে কিছুটা সময় লাগে আমার। হুট করে বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারি না। কিন্তু আমি মজা করতে পছন্দ করি। সব সময় সিরিয়াস হয়ে থাকতে পারি না।

টেন্ডুলকার যখন মাছশিকারি
ছবি: টেন্ডুলকারের ফেসবুক

প্রশ্ন :

ড্রেসিংরুমটাও এ রকমই পছন্দ ছিল আপনার?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ, আমরা একের পর এক রসিকতা করে যেতাম এবং দুষ্টুমির উপায় খুঁজতাম। এ রকমই হওয়া উচিত। তবে কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতাম। সবাই জানত। সতীর্থদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এমনই ছিল। দলের সবচেয়ে সিনিয়র হওয়ায় আমি ওদের বড় ভাইয়ের মতো ছিলাম। ওরাও আমার সঙ্গে খুনসুটি করত। আমি মজা পেতাম, কারণ এতে করে আমার নিজেকে তরুণ মনে হতো।

প্রশ্ন :

যখন তরুণ ছিলেন, তখন কেমন ছিল ড্রেসিংরুম?

টেন্ডুলকার: আমার প্রথম সফরে (পাকিস্তান, ১৯৮৯) সলিল (অ্যাংকোলা) ছিল আমার রুমমেট। সঞ্জয় মাঞ্জরেকারও ছিল। ওরা ঠিক আমার বয়সী ছিল না। তবে ওদের সঙ্গেই আমি সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলাম। (কৃষ্ণমাচারি) শ্রীকান্তও আমাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সাহায্য করেছেন। আমার দ্বিতীয় সফর, নিউজিল্যান্ডে, যেখানে আমি সঞ্জয় ও (দিলীপ) ভেংসরকারের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। তাঁর (ভেংসরকারের) নিউজিল্যান্ডে অনেক বন্ধু ছিল। এ জন্য আমরা ওঁর সঙ্গে বের হতাম। ভেংকটপতি রাজু, নরেন্দ্র হিরওয়ানি ও প্রাভিন আমরের সঙ্গও আমি অনেক পেয়েছি। তারপর বিনোদ (কাম্বলি) দলে এল। অজয় (জাদেজা) ও (নবজ্যোত সিং) সিধুও আমাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে।

স্ত্রী অঞ্জলির সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন :

প্র্যাঙ্ক করতে পছন্দ করতেন আপনি?

টেন্ডুলকার: অনূর্ধ্ব-১৫ দলের সফর থেকেই। আমার সব সময়ই কিছু না কিছু করার কথা মাথায় ঘুরত। ওটাই আমাদের সফরগুলোকে আরও আনন্দময় করে তুলত। সন্ধ্যাগুলো খুব মজার ছিল। মাঠে ভালো সময়, খারাপ সময় তো থাকতই। আপনি কীভাবে সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নেবেন? আনন্দের মধ্যে থাকলে পরের সকালটার জন্য তৈরি হওয়াটা সহজ হতো।

প্রশ্ন :

সেরা প্র্যাঙ্কটা কার সঙ্গে করেছিলেন?

টেন্ডুলকার: সৌরভের (গাঙ্গুলী) সঙ্গে। আপনি কোনটার কথা জানেন, বলুন তো?

সৌরভ গাঙ্গুলীকে বেশ কয়েকবার বোকা বানিয়েছেন টেন্ডুলকার
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

ইন্দোরে, আপনি আর বিনোদ কাম্বলি মিলে ওর (সৌরভের) রুম পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। ওর সব জিনিসপত্র পানিতে ভাসছিল...

টেন্ডুলকার: আরও একটা ছিল। দলের সবাই যেটাতে জড়িত ছিল। আমরা কেরালায় ছিলাম। অনুশীলন শেষ হয়েছে। ড্রেসিংরুমে ফিরে সাপোর্ট স্টাফদের সবাইকে বললাম বের হয়ে যেতে। জন (রাইট) ছিল আমাদের কোচ। আমরা বললাম, শুধু খেলোয়াড়েরা উপস্থিত থাকতে পারবে। সাপোর্ট স্টাফদের বলা হলো, খুবই সিরিয়াস কিছু ব্যাপার আছে, যা শুধু দলের খেলোয়াড়েরা আলোচনা করবে। আমরা একসঙ্গে বসলাম এবং আলোচনা শুরু হলো, ‘দাদা, তুমি পত্রিকায় কী বলেছ? কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, ওরা বলেছে, তুমি আমাদের নামে বাজে কথা বলেছ। এটা তো ঠিক নয়। তুমি অধিনায়ক, মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সুবিধা একমাত্র তোমারই আছে। কিন্তু এর মানে এই না যে তুমি গিয়ে যা খুশি তা-ই বলবে।’ দাদা বলেছিল, ‘ঈশ্বরের দোহাই, আমি কিছু বলিনি।’ তখন আমরা তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আজ ১ এপ্রিল। কিছু নকল সংবাদপত্র প্রিন্ট করে আনার আইডিয়াটা দারুণ ছিল।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

আপনাকে করা সেরা প্র্যাঙ্ক কোনটা?

টেন্ডুলকার: নিউজিল্যান্ডে যখন আমরা ২০০৯ সালের সিরিজটা জিতলাম, ওই সফরের ঘটনা। হরভজন সিংয়ের রুমের বাইরে একটা হট বাথটাব ছিল। হোটেলের একটা পাশে ছিল উন্মুক্ত ব্যালকনি। এর ফলে সবাই গিয়ে সেই বাথটাবে বসতে পারত। সবাই গিয়েছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমার ইচ্ছা করছে না। কিন্তু দলের বাকি সবাই আমাকে বাথটাবে নামাবেই। আমার হাতে ছিল একটা ক্লাব স্যান্ডউইচ। এরপরই যা হলো, সবাই মিলে আমাকে চ্যাংদোলা করে টাবে ফেলে দিল এবং আমি দেখলাম, স্যান্ডউইচটা পানিতে ভাসছে। আসলে আমি বুঝতেই পারিনি, ওরা এমন কিছু করবে। জহির (খান), যুবি (যুবরাজ সিং), হরভজন সিং ও আশিস (নেহরা) মিলে কাজটা করেছিল।

ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ জয় টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন :

আপনি তো ঘুরতে পছন্দ করেন। মনে আছে, আপনি বলেছিলেন, অবসরের পর প্রথম বড়দিনে আপনি লন্ডন গিয়েছিলেন, কারণ হোয়াইট ক্রিসমাস (বরফ পড়ার সময় বড়দিন) দেখতে চেয়েছিলেন। যেটা আগে আপনার দেখা হয়নি। ইচ্ছে–তালিকায় এ রকম আর কিছু ছিল?

টেন্ডুলকার: আমরা আইসল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। আগ্নেয়গিরি থেকে যেকোনো সময় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা সবাই বলত। পুরো ইউরোপ তিন-চার দিন বন্ধ ছিল এবং পরের বছরেই সেটা হলো।

প্রশ্ন :

মুম্বাইয়ের রাস্তায় গাড়ি চালানো এখনো পছন্দ আপনার?

টেন্ডুলকার: হ্যাঁ, আমি গাড়ি চালাতে পছন্দ করি। যদি পার্কিং থাকে, ৯০ ভাগ সময় আমিই গাড়ি চালাই।

প্রশ্ন :

ভারত ও ভারতের বাইরে গাড়ি চালানোর জন্য আপনার প্রিয় শহর কোনটা?

টেন্ডুলকার: আমি তাদোবায় (নাগপুরে টাইগার রিজার্ভ) গাড়ি চালিয়েছি, লন্ডনে কিছুটা চালিয়েছি। আমি যদিও বাঁহাতি ড্রাইভিংয়ে স্বচ্ছন্দ নই। পুরো মনোযোগ দরকার হয়, একটা ভুলেই সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আমি সেই সুযোগ নিতেই চাই না।

প্রশ্ন :

আপনার ওপর বলিউডের প্রভাব কতটুকু?

টেন্ডুলকার: আমি সিনেমা দেখি। শুধু বলিউডেরই নয়। যখন বাসায় অবসর থাকি, আমি ওয়েব সিরিজ বা অন্য কিছুও দেখি। 

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

বেড়ে ওঠার সময় সিনেমা কি আপনার জীবনের অংশ হয়ে ছিল?

টেন্ডুলকার: যখন খেলতাম, খুব বেশি দেখা হতো না। সময় পেতাম না। ১২ বছর বয়সে যখন ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হলো, এর আগেই যা দেখেছি। আচরেকার স্যার দম ফেলার সময় দিতেন না। আমি হয় মাঠে থাকতাম, নয় স্কুলে না ঘুমে। খুব ক্লান্ত থাকতাম।

কোচ রমাকান্ত আচরেকারের সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার
এএফপি

প্রশ্ন :

অমিতাভ বচ্চনের কোন সিনেমাটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

টেন্ডুলকার: অবশ্যই শোলে। এক লাইনের সংলাপগুলো দুর্দান্ত ছিল।

প্রশ্ন :

প্রিয় শাহরুখ খানের সিনেমা?

টেন্ডুলকার: শাহরুখ ও আমার ক্যারিয়ার প্রায় একই সময়ে শুরু। ফলে ওর নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে আমি দেখতাম। দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে সিনেমার গানগুলো আমি অঞ্জলির (টেন্ডুলকারের স্ত্রী) বাড়ি বা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে যেতে যেতে শুনতাম। 

প্রশ্ন :

কার গান ভালো লাগে?

টেন্ডুলকার: পাঁচজন—লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি ও মুকেশ। আমার বাড়িতে গান বাজত সব সময়, আলোচনা হতো। আমি সত্তর দশকের গানগুলো শুনে বড় হয়েছি। তারপর মাইকেল জ্যাকসন, ইগলস, জিপসি কিংস, বব মার্লে, ইউ২, ডায়ার স্ট্রেটস, পিঙ্ক ফ্লয়েডে গেলাম। তারপর গত কয়েক দশকে কোল্ড প্লে। আমি আর অঞ্জলি প্রতি গ্রীষ্মেই কনসার্টে যাই। গত গ্রীষ্মে গিয়েছিলাম এলটন জন ও ইগলসের কনসার্টে।

প্রশ্ন :

আপনার ছেলেমেয়েদের প্রিয় গান কি আপনি শোনেন?

টেন্ডুলকার: কিছু শোনা হয়। সৌভাগ্যক্রমে ওদের পছন্দ ভালো। ওরাও আমার পছন্দের গান শোনে।

বিখ্যাত সংগীত পরিচালক এ আর রহমানের সঙ্গে টেন্ডুলকার

প্রশ্ন :

আমরা রান্নাঘরে আপনার কিছু ভিডিও দেখেছি। আপনি সবচেয়ে ভালো কী রান্না করেন?

টেন্ডুলকার: আমি বারবিকিউ করতে পারি। আমি চিংড়ি রান্না করি, বেগুন ভর্তা, মাছের তরকারি পারি। মাছটা তাজা ছিল কি না, আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতে পারি। ড্রেসিংরুমে এ রকম অনেকবার হয়েছে। আমি মাছের গন্ধ শুঁকেই সবাইকে বলে দিতাম, খেয়ো না।

রান্নাটাও ভালেই পারেন টেন্ডুলকার
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন :

আপনার প্রিয় খাবার?

টেন্ডুলকার: ঘরে রান্না করা খাবার আমার কাছে বিশেষ কিছু, তবে জাপানি খাবারও আমার পছন্দ।