আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি দলের জয়–হারে বড় ভূমিকা থাকে অধিনায়কের। তাঁদের একেকটি সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে দিতে পারে ম্যাচের গতিপথ। ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছু অধিনায়ক আছেন, যাঁদের নেতৃত্বে দল ম্যাচ জিতেছে, যাঁরা শুধু ট্রফি নয়, গড়ে তুলেছেন একেকটি যুগও। ম্যাচ জয়ের পরিসংখ্যানে ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ১০ অধিনায়কদের নিয়ে এই আয়োজন।
২০৬ ম্যাচে ১০৭ জয়
নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম সফল অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন নেতৃত্ব দিয়েছেন টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—সব ফরম্যাটেই। তাঁর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড ২০২১ সালে প্রথম ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে, যা ছিল দেশটির ইতিহাসের প্রথম আইসিসি শিরোপা।
অধিনায়ক হিসেবে উইলিয়ামসন ট্রফি জিততে পারতেন ওয়ানডে আর টি–টোয়েন্টির বিশ্বকাপেও। তাঁর নেতৃত্বে ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছে নিউজিল্যান্ড।
১৬৩ ম্যাচে ১০৮ জয়
অ্যালান বোর্ডারের পর নেতৃত্বের ভার নিয়ে স্টিভ ওয়াহ অস্ট্রেলিয়াকে এমন এক দলে পরিণত করেন, যাদের ভয় পেত পুরো ক্রিকেট–বিশ্ব। তাঁর নেতৃত্ব ২০০০ দশকের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান আধিপত্যের ভিত্তি গড়ে দেয়।
টেস্ট ও ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ওয়াহ। তাঁর নেতৃত্বে ৫৭ টেস্টের ৪১টিতে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া, জয়ের হার ৭১.৯২%, যা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা রেকর্ড। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে তাঁর দল টানা ১৬ টেস্ট জিতেছিল।
ওয়ানডেতে স্টিভ ওয়াহ নেতৃত্ব দিয়েছেন ১০৬ ম্যাচে, জিতেছেন ৬৭টি। তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে শিরোপা জেতানো, যা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে ‘স্বর্ণালি যুগের’ সূচনা করে।
১৯৮ ম্যাচে ১১৮ জয়
ইংল্যান্ডের ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী অধিনায়ক বিবেচনা করা হয় এউইন মরগানকে। আয়ারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটারের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড ৫০ ওভারের ক্রিকেটে আক্রমণাত্মক, আধুনিক এবং সাহসী ক্রিকেট খেলা শুরু করে।
ইংল্যান্ড ২০১৯ সালে জেতে বিশ্বকাপ, যা ক্রিকেটের জন্মভূমি দেশের জন্য প্রথম। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১৯৮টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন মরগান, জিতেছেন ৫৯.৫৯% ম্যাচে। তিনি অবশ্য টেস্টে কখনো অধিনায়কত্ব করেননি। ১৯৮ ম্যাচের ১২৬টিই ওয়ানডেতে, ৭২টি টি–টোয়েন্টিতে।
১৯১ ম্যাচে ১২৬ জয়
১৯৯০ দশকে নির্বাসন থেকে ফেরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠায় যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে তাতে সামনের মুখ। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁর অধিনায়কত্বে ১২৬টি ম্যাচ (৬৫.৯৬%) জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
ক্রোনিয়ের হাত ধরে প্রোটিয়ারা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বিশ্বমানের দল হয়ে উঠলেও তাঁর নিজের সমাপ্তিটা করুণ। ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম, এরপর মারা যান বিমান দুর্ঘটনায়। তবে শেষটায় দাগ লেগে গেলেও নেতৃত্বগুণের কারণে ক্রোনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে অনন্য এক নাম হয়েই টিকে আছে।
৩০৩ ম্যাচে ১২৮ জয়
তীক্ষ্ণ কৌশলগত চিন্তাভাবনার জন্য পরিচিত ছিলেন স্টিফেন ফ্লেমিং। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি অধিনায়ক ছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তাঁর নেতৃত্বে ৩০৩ ম্যাচের ১২৮টিতে জিতেছে নিউজিল্যান্ড।
জয়ের শতাংশ (৪২.২৪%) যদিও খুব বেশি নয়, তবে তাঁর নেতৃত্বেই নিউজিল্যান্ড একটি শক্তিশালী, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দলে পরিণত হয়। ফ্লেমিংয়ের অধিনায়কত্বে নিউজিল্যান্ড ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে।
২১৩ ম্যাচে ১৩৫ জয়
ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলিকে নিয়ে যত আলোচনা হয়, অধিনায়ক কোহলিকে নিয়ে আলোচনা তুলনায় কমই হয়। অথচ ভারতের অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ টেস্ট জিতেছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ায় (২০১৮–১৯) টেস্ট সিরিজ জিতেছে ভারত।
অধিনায়কত্বের সময়ে ব্যাটিংয়েও কোহলি ছিলেন সেরা ছন্দে। অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৭টি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড তাঁর, তিন সংস্করণ মিলিয়ে নেতৃত্বে থাকাবস্থায় করেছেন ৪১টি সেঞ্চুরি।
২৭১ ম্যাচে ১৩৯ জয়
বিশ্ব ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ান আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপনের কৃতিত্ব অ্যালান বোর্ডারের। অস্ট্রেলিয়ার ৬ বিশ্বকাপ শিরোপার প্রথমটি এসেছিল ১৯৮৭ সালে, তখন অধিনায়ক ছিলেন বোর্ডার।
ওয়ানডেতে তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ১০৭টি ম্যাচ (জয়ের হার ৬০.১%), আর টেস্টে ৯৩ ম্যাচে জয় ৩২টি। বোর্ডারের নেতৃত্বে ১৯৮৯ অ্যাশেজ জয়কে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বিশেষভাবে দেখা হয়। সেটি ছিল ১৯৭৫ সালের পর অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জয়।
২৮৬ ম্যাচে ১৬৩ জয়
আইসিসি ট্রফি জিততে না পারলেও গ্রায়েম স্মিথ ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক। ২০০৩ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হন, যদিও তখন পর্যন্ত খেলেছেন মাত্র ৮টি টেস্ট।
স্মিথ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১০৩ টেস্টে নেতৃত্ব দেন, জেতেন ৫৩টি, যা এখনো পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয়ের রেকর্ড। ওয়ানডেতেও ১৫০ ম্যাচের ৯২টিতে জিতেছেন স্মিথ (জয়ের হার ৬১.৩৩%)।
৩৩২ ম্যাচে ১৭৮ জয়
তাঁকে বলা হয় ‘ক্যাপ্টেন কুল’। টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের বর্তমান জনপ্রিয়তার পেছনে ২০০৭ বিশ্বকাপের ভারতের জয়কে অন্যতম কারণ মনে করেন অনেকে। সেই বিশ্বকাপ জয়ে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
পরে তাঁর নেতৃত্বে ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপও জেতে ভারত। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে ভারতের জয় আসে তাঁরই ছক্কায়, যা বিশ্বকাপের অন্যতম আইকনিক মুহূর্ত হয়ে আছে।
ভারতকে টেস্টে ৬০ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ২৭টি, আর ওয়ানডেতে ২০০ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ১১০টি (জয়ের হার ৫৫%)। ২০১৩ সালে জিতেছেন আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ধোনিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একমাত্র অধিনায়ক, যিনি আইসিসির তিনটি সংস্করণের ট্রফি জিতেছেন।
৩২৪ ম্যাচে ২২০ জয়
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়কদের একজন রিকি পন্টিং, ম্যাচ জয়ের দিক থেকে শীর্ষতম। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৩ ও ২০০৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে অস্ট্রেলিয়া, ২০০৬ ও ২০০৯ সালে জেতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও।
তাঁর সময়ে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল না। তবে এই সংস্করণেও অধিনায়ক পন্টিংয়ের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ৭৭ টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে ৪৮টিতেই জিতেছিলেন তিনি, জয়ের হার ৬২.৩৩।
ওয়ানডেতে তাঁর অধিনায়কত্বে টানা ২৬ ম্যাচ জয়ের রেকর্ডও গড়ে অস্ট্রেলিয়া। সব মিলিয়ে ৩২৪ ম্যাচের ২২০টি জিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতা অধিনায়কের কীর্তিটা এখন তাঁর। অদূর ভবিষ্যতে কেউ তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কারণ, বর্তমান অধিনায়কদের কারও ন্যূনতম ১০০ জয়ও নেই।