বাবরের হাসি ও রিজওয়ানের চোট—অভিনয় না বীরত্ব

মোহাম্মদ রিজওয়ান। গতকাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরির পরছবি: এএফপি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ছবিটি নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে? হায়দরাবাদে গতকাল ম্যাচ শেষের একটি মুহূর্ত। দুহাত বাড়িয়ে আছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। ছবিটি তাঁর পেছন থেকে তোলায় মুখটা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু মুখ না দেখেই বলে দেওয়া যায়, সে মুখের রেখাচিত্রে ছিল আকর্ণবিস্তৃত হাসি ও স্বস্তি। সামনেই বাবর আজম।

আরও পড়ুন

অনুশীলনের জার্সি, শর্টস ও স্যান্ডেল পরেই মাঠে নেমে এসেছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের পর ড্রেসিংরুমে বসে থাকে কোন বোকা! আর সেই জয়ের ‘হৃৎকমল’ যিনি, ধন্যবাদটা সবার আগে তাঁরই প্রাপ্য। ৩৪৪ রান তাড়া করতে নামা পাকিস্তানের জন্য বাবর নিজে কিছু করতে পারেননি। কিন্তু অধিনায়ক এবং দলের সবচেয়ে বড় তারকার দায়িত্বটা যখন তাঁর ‘সাইডকিক’—ব্যাটসম্যানের যেমন রবিন—করে দেন, তখন রূপক অর্থে নদী ছাপিয়ে শাখা নদীকেই বড় দেখায়! কতটা বড়, বুঝে নিতে পারেন ওই ছবিটায়।

শুধু হাসিমুখ বললে ছবিতে বাবরের সেই খুশির প্রকাশের প্রতি অবিচার করা হয়। অবিকল একই রকম হয়তো না, তবে খুব কাছাকাছি একটি উদাহরণ টানা যায়। ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও সুভাষ ঘাই পরিচালিত ‘তাল’ সিনেমায় নায়িকা ঐশ্বরিয়া যখন বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে ‘তাল সে তাল মিলাও’ গানটি সমভিব্যাহারে গাইছিলেন, তখন অনতিদূরে লুকিয়ে সেই গানের অন্তর্নিহিত ভাষাটা বুঝে ফেলার পর অক্ষয় খান্নার মুখভঙ্গিটা মনে আছে? দাঁতমুখ খিঁচিয়ে অক্ষয় এমন এক অনুভূতির প্রকাশ করেছিলেন, যেটা অনির্বচনীয়।

পাকিস্তানকে জেতানোর পর রিজওয়ানকে অভিনন্দন জানাতে মাঠে ছুটে এসেছিলেন অধিনায়ক বাবর আজম। তাঁর মুখের হাসিটা দেখুন
ছবি: টুইটার

দয়া করে ভাববেন না, সিনেমায় ঐশ্বরিয়া-অক্ষয় রসায়নের ছাঁচে ফেলা হচ্ছে বাবর ও রিজওয়ানকে। দুজনে দীর্ঘদিনের সতীর্থ ও বন্ধু হওয়ায় মনের মিলটা স্বাভাবিক। বিনিসুতোর মালায় গাঁথা এমন সম্পর্কের দাবি থেকেই কেউ অবিশ্বাস্য কিছু ঘটিয়ে ফেলার পর আমরা ছুটে গিয়ে আবেগের আতিশয্যে তাঁকে বলে ফেলি, ‘ইশ্‌! কী কাজটাই না করলি!’ এবার ছবিটি একবার ভালো করে দেখে বলুন তো, লাভার স্রোতের মতো ভেসে আসা আনন্দ কোনো মনে আটকে বাবরের মুখে অনুচ্চারে কি ভাষাটা ফুটেছে? ‘ইশ্‌! কী ব্যাটিংটাই না করলি!’

আরও পড়ুন

রিজওয়ান কেমন ব্যাটিং করেছেন—১২১ বলে ৩ ছক্কা ও ৮ চারে ১৩১*—তা মোটামুটি সবারই জানা। তাই জাবর না কেটে বরং সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের টুইটটি বলা যায়, ‘রিজওয়ানের যখন পায়ে “ক্র্যাম্প” (পেশির টান) শুরু হলো, শ্রীলঙ্কার তখনই বোঝা উচিত ছিল তারা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে...।’

ক্রিকেটের পাঁড় ভক্ত হয়ে থাকলে এই টুইট পড়ে এবং গতকাল পায়ে ক্র্যাম্প নিয়েও রিজওয়ানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসটি দেখে একজনকে মনে পড়তে পারে। ১৯৮৪ সালে লর্ডস টেস্টের সেই ঘটনা জানেন তো? ওভারের হিসাবে ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ৭৮ ওভারে ৩৪২ রানের লক্ষ্যকে রীতিমতো ছেলেখেলা বানিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একাই অপরাজিত ২১৪ রান করেছিলেন সেই কিংবদন্তি। গর্ডন গ্রিনিজ! ক্রিকেটে প্রচলিত একটি কথাই হলো, উইকেটে (চোট পাওয়া) খোঁড়াতে থাকা গ্রিনিজের চেয়ে ভয়ংকর কিছু হয় না!

ক্র্যাম্পের কারণে ব্যথায় ক্রিজে একবার শুয়েও পড়েছিলেন রিজওয়ান
ছবি: এএফপি

না, এই একটি ইনিংস দিয়েই রিজওয়ানকে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির পাশে বসানোর দুঃসাহসিক চেষ্টা করা হচ্ছে না, আর সংস্করণও আলাদা। কিন্তু ক্রিকেট খেলায় সংস্করণ যা–ই হোক, ক্রিজ একই আর সেই ক্রিজে দাঁড়িয়ে একই রকম গোল বলেরই মুখোমুখি হতে হয়। ওহ হ্যাঁ, পায়ের ক্র্যাম্পও কিন্তু বোঝে না সংস্করণটা টেস্ট না ওয়ানডে! আর তাই ব্যথাটা একই থাকে এবং সেটা কত ভয়াবহ হতে পারে শুনুন ওয়াসিম আকরামের মুখে, ‘ক্র্যাম্পে (পেশির টান) বেশ ভালোই ব্যথা হয়। নিজের না হলে বুঝবেন না। ক্র্যাম্প নিয়ে খেলাটা খুবই কঠিন। শট খেলার সময় ৭০ শতাংশ মনোযোগ পায়ের ওপর থাকে।’ শোয়েব মালিক বলেছেন এক কথায়, ‘ক্র্যাম্প হলে আপনি বাকি সব ভুলে যাবেন।’

আরও পড়ুন

সাধারণত, গরমের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের শারীরিক পরিশ্রম, শরীরে পানির অভাব কিংবা শিরায় রক্তের সরবরাহ কমে গেলে পেশিতে খিঁচুনি তৈরি হয়, যে কারণে ক্র্যাম্পের জায়গায় প্রচণ্ড টান অনুভূত হয়। ক্র্যাম্প যদি পায়ে হয়, হাঁটতে গেলে মনে হবে পেশি ছিঁড়ে যাচ্ছে! পরিস্থিতি যখন এমন হয়, সেই ব্যথা সহ্য করে খেলাটা কত কঠিন, তা না বললেও চলে। গতকাল হায়দরাবাদের তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও আর্দ্রতা ৬৩ শতাংশ। রিজওয়ান এর মধ্যে প্রায় ৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিট ব্যাট করেছেন। আর কে না জানে, রিজওয়ানের চোটপ্রবণতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই।

রিজওয়ানের ৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন দৃশ্য কম নয়—পায়ে কিংবা কোমরে চোট নিয়েই কিপিং করছেন, কখনো খোঁড়াচ্ছেন এবং খোঁড়াতে খোঁড়াতেই ডাইভ দিচ্ছেন, ক্যাচ ধরছেন আর ব্যাটিংয়েও তা–ই। হয়তো ক্রিজে দাঁড়ানোর আগে শরীরী ভাষাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোথাও কোনো সমস্যা আছে, কিংবা রান নিচ্ছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে! দেখতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, বিরক্তিও অস্বাভাবিক কিছু না।

নিন্দুকেরা তো বহু আগে থেকেই বলাবলি করছেন, রিজওয়ানের এসবই ‘শো অফ’—দেখনদারি! মাঠে নেমে সবার সহমর্মিতা পেতে যেন বোঝাচ্ছেন, দেখো, দেশের জন্য এসব চোটফোট আমার কাছে কিছু না! গতকাল নিউজিল্যান্ডের ধারাভাষ্যকার সাইমন ডুল যেমন রিজওয়ানের ক্র্যাম্প নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ব্যাটিং করা দেখে বলেছেন, ‘ওকে সিনেমায় নামিয়ে দাও।’ ম্যাথু হেইডেনও রসিকতা করে খোঁচা মেরে বলেছেন, ‘সে ঠিক বুঝতে পারছে না এরপর শরীরের কোন অংশে (ক্র্যাম্প) এটা করতে হবে।’

ম্যাচের শেষ ১৫ ওভারে ক্র্যাম্পে ভুগেছেন রিজওয়ান। ফিজিও মাঠে ঢুকেছেন দুবার। ৩৬তম ওভারে একটি ওয়াইড বল খেলতে গিয়ে টানটা প্রথম টের পান। পরের ওভারে ধনঞ্জয়াকে লং অফের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে পা ধরে ক্রিজেই শুয়ে পড়েন। তখন ওই মন্তব্য করেন ডুল আর দৃশ্যটি রিজওয়ানের ক্ষেত্রে দর্শকদের কাছেও অচেনা নয়। বরাবরই এমন কিছু হলে সমর্থকেরাও পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে পড়েন। কারও দাবি, এটা দেখনদারি, আবার কারও দাবি হয়তো এমন, সে বীর, তাই ব্যথা নিয়েই দেশের জন্য খেলে।

আরও পড়ুন

কিন্তু এই যে বিভক্তি—গতকাল ম্যাচ শেষে রিজওয়ান কিন্তু নিজেও তার মীমাংসা করেননি। ডুলের চোট নিয়ে করা প্রশ্নে রসিকতার ছলে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘কখনো সত্যিই ক্র্যাম্প হয়, কখনো অভিনয় করি।’

আচ্ছা, কথাটা কি শুধুই রসিকতা? নাকি তাতে অভিমান ও শ্লেষের মিশেলও ছিল? প্রশ্নটা কেন তোলা হচ্ছে, তা বলার আগে কিছু পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখা ভালো। ওয়ানডেতে এ বছর পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ রান (১৮ ম্যাচে ৭৫.১৮ গড়ে ৮২৭) রিজওয়ানের। এবার বিশ্বকাপে শুরুটাও হয়েছে দুর্দান্ত। ২ ম্যাচে মোট ১৯৯ রান করে এরই মধ্যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। এখন বলুন তো, দেশের জন্য নিজেকে এভাবে নিংড়ে দেওয়ার পর ওই প্রশ্ন শুনতে কার ভালো লাগবে?

রিজওয়ানের এ ছবিটি পাকিস্তান ক্রিকেট মনে রাখবে অনেকদিন। গতকাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে
ছবি: এএফপি

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, রিজওয়ান চোটপ্রবণ কিংবা মনোযোগ আকর্ষণে চোটের অভিনয় করেন—যে অভিযোগই উঠুক, মাঠে আসল কাজটা হচ্ছে তো? যদি সেটা হয়, তাহলে ‘বিড়ালে’র গলায় যিনি ‘ঘণ্টা’ বাঁধছেন, তাঁর শরীর কতটা ক্ষতবিক্ষত সেসব বিষয় গৌণ হয়ে পড়ে। কারণ, ক্রিকেটে রানার নেওয়ার নিয়ম বহু আগেই উঠে গেছে। আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্র্যাম্প নিয়ে রিজওয়ান মাঠ ছেড়ে যাওয়ার পাত্রও নন। হ্যাঁ, দেশের জন্য তাঁর এই নিবেদনকে ক্রিকেটীয় চোখে একটু অদ্ভুত লাগতেই পারে। বিরক্তিও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু ৩৪৪ তাড়া করে যে খেলোয়াড় একাই ১৩১ করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন, তাঁর জন্য সবার আগে ওই প্রশ্ন নয়, টুপিখোলা অভিনন্দনই প্রাপ্য।

রিজওয়ান যে তা পাননি, সেটাও নয়। তবু ওই রসিকতার অন্তর্নিহিত অর্থ হতে পারে একটাই, তোমরা যে যা খুশি ভাবতে পারো, আমি নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে গেলে চোট কিংবা অভিনয় নয়, শুধু নামটাই মনে রাখবে, মোহাম্মদ রিজওয়ান—রিমেম্বার দ্য নেম!