দৃশ্যপট দুই:

একই ম্যাচের ১১তম ওভারে আবার বোলিংয়ে এলেন মোস্তাফিজ। ক্রিজে সেই হৃদয়। তখন তিনি ৩৪ রানে অপরাজিত। মোস্তাফিজ সর্বশেষ ওভারের ছক্কাটা হয়তো ভুলতে পারছিলেন না। তাই ফুল লেংথে কাটার করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন। ব্যাক অব দ্য লেংথে থেকে বল করে কম রানে একটা ওভার শেষ করে যাওয়াই হয়তো মোস্তাফিজের মাথায় ঘুরছিল।

ওদিকে হৃদয় তাঁর পাওয়ার পজিশনে, মাথা একদম স্থির। ওপেন স্টান্স আর হাই ব্যাকলিফটে ব্যাটটা উঁচিয়ে রাখা একদম অফ স্টাম্প বরাবর। মোস্তাফিজের সে ওভারের চতুর্থ বলটি ব্যাক অব দ্য লেংথ থেকে লাফিয়ে উঠল। অফ স্টাম্পের বাইরে জায়গা না থাকায় হৃদয়কে কিছুটা চমকেও দিল। তবু হৃদয় বাউন্ডারি খুঁজে নিলেন অদ্ভুত দক্ষতায়। পয়েন্ট ও থার্ড ম্যানের মাঝে কীভাবে যে জায়গা খুঁজে নিলেন, সেটা হৃদয়ই ভালো বলতে পারবেন! যে শটটি তিনি খেলেছেন, ক্রিকেটীয় ভাষায় সেটার কোনো নাম আছে কি না, সেটাও গবেষণার ব্যাপার।

মোস্তাফিজ কিছুক্ষণ হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন কোমরে হাত দিয়ে। সে যেন এক পরাজিত সৈনিকের প্রতিচ্ছবি। উইকেট কিপার লিটন দাসও কিছুক্ষণ মাথা নাড়লেন অবিশ্বাসে। মোস্তাফিজ পরের বলটাও করলেন প্রায় একই লাইনে। একটু ফুল লেংথে। এবার কিপার ও থার্ড ম্যানের মাঝে যে জায়গা, সেটাকে খুঁজে বের করেছেন শল্যবিদের মতো করে। আরও একটি চার।

বদলে যাওয়ার গল্প:

তিনটি শটই ২২–এর তরুণ হৃদয়ের বদলে যাওয়ার গল্প বলে। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। সে দলের মিডল অর্ডারের ভরসা বলা হতো তাঁকে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যানও মনে করা হতো। সে জন্য বিসিবির প্রতিটি প্রোগ্রামে ছিল হৃদয়ের নাম। কিন্তু বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের পর মাঠের পারফরম্যান্সে গর্ব করার মতো কিছুই ছিল না। টি-টোয়েন্টির জন্য তাঁকে খুব উপযুক্তও মনে করা হচ্ছিল না। এক বছর আগেও হৃদয়ের স্টান্স এতটা ওপেন ছিল না, ব্যাকলিফট এতটা উঁচু ছিল না। শট খেলার সময় মাথার অবস্থানও এতটা স্থির ছিল না।

স্পিন ভালো খেলার সুনাম ছিল হৃদয়ের। কিন্তু কুড়ি ওভারের বিস্ফোরক ব্যাটিংটা তাঁকে দিয়ে হচ্ছিল না। গত বিপিএলে ১০ ইনিংস খেলে ১৭ গড় ও ৯৭.৮৪ স্ট্রাইক রেটে ১৩৬ রান করেছিলেন হৃদয়। এরপর টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন, বাড়িয়েছেন শট খেলার সামর্থ্য। বড় শট খেলার সময় ভারসাম্য যেন ঠিক থাকে, সেটি নিয়ে কাজ করেছেন। আর সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে মাঠের পারফরম্যান্সে। এবারের বিপিএলে মাত্র তিন ইনিংস খেলেছেন, তাতেই ৬৬ গড়ে ও ১৬৬ স্ট্রাইক রেটে ১৯৫ রান করে ফেলেছেন!

সঙ্গে যোগ হয়েছে সিলেট স্ট্রাইকার্স দলের যা খুশি তা করার স্বাধীনতা। দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা কাল শোনালেন সেই গল্প, ‘হৃদয়কে আমরা ওর মতো ছেড়ে দিয়েছি। আগের ম্যাচটা (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস) দেখুন, উইকেটে গিয়ে প্রথম বলে ছক্কা মেরেছে। আমি ওকে পুরো ব্যাক করেছি। ওই শটে যদি আউট হতো, আমরা ওকে কিছুই বলতাম না। এভাবে পাশে থাকা প্রয়োজন। আমাদের দল থেকে, বিশেষ করে আমি যতক্ষণ আছি, ওই সুযোগটা দিয়েছি যে ও যেন যেভাবে চায়, সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে।’

কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, আঙুলের চোটে পড়ে দুই সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হচ্ছে দারুণ ফর্মে থাকা হৃদয়কে। গতকাল ঢাকা ডমিনেটরসের বিপক্ষে সিলেটের ম্যাচের সময় বাউন্ডারি লাইনে বল থামাতে গিয়ে আঙুলে চোট পান তিনি। সিলেট স্ট্রাইকার্স জানিয়েছে, হৃদয়ের হাতে ৮টি সেলাই লেগেছে।

প্রতারণা থেকে যে হৃদয়ের শুরু:

হৃদয় বগুড়ার ছেলে। অনুমিতভাবে বগুড়ার মুশফিকুর রহিম তাঁর প্রিয় ক্রিকেটার। এবারের বিপিএলে তিন নম্বরে ব্যাট করলেও মুশফিকের মতো হৃদয়ও সাধারণত চার নম্বরে ব্যাট করে থাকেন। টপ অর্ডারে ফাটল ধরলে সেটিকে জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে ভীষণ গর্ববোধ দুজনের। হৃদয়কে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের ‘হৃদয়’ বলা হতো সে কারণেই।

কিন্তু হৃদয়ের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছে প্রতারণার শিকার হয়ে। ক্রিকেট শিখতে তিনি বিকেএসপিতে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চেষ্টা করেও সেটি হয়নি। এরপর এলাকার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় এসে দক্ষিণ বনশ্রীর একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হন হৃদয়। একাডেমিতে ভর্তি হতে যে টাকা দরকার, সেটা জোগাড় করে দিয়েছেন হৃদয়ের মা। বাবাকে না জানিয়ে গ্রামের জমি বন্ধক রেখে হৃদয়কে টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ভুয়া একাডেমিতে ভর্তি হয়ে সে টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন।

হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছাটা মরে যায়নি। খুব দ্রুতই তিনি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের আলোচনায় চলে এসেছেন। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের সেরা অর্জন বিশ্বকাপও জিতেছেন। ছোট্ট ক্যারিয়ারে হৃদয়ের দর্শন একটাই, ‘আপনি যখন ব্যর্থ হবেন, সে ব্যর্থতা থেকেই তো সাফল্যের পথ খুঁজবেন। আমি ব্যর্থ হয়েছি, তারপর চেষ্টা করেছি, কীভাবে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। কী কী জিনিসগুলো আমাকে উন্নতি করতে হবে এবং ওইভাবেই চেষ্টা করছি।’