১৩ বছরে কোথায় ম্যাথুস, আর কোথায় ফাওয়াদ!

গল টেস্টে এক ফ্রেমে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ও ফাওয়াদ আলমছবি: এএফপি

গল টেস্টের প্রথম দিনে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে তাঁর ক্যারিয়ারের শততম টেস্টের স্মারক টুপি পরিয়ে দেন শ্রীলঙ্কারই কিংবদন্তি চামিন্দা ভাস। সন্তানসহ মাঠে হাস্যোজ্জ্বল ম্যাথুসকে এখন শুধু গর্বিত একজন বাবাই নন, দেশের হয়ে শততম টেস্ট খেলায় গর্বিত এক ক্রিকেটারও। অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারেরও তো এই অর্জন নেই।

আবারও অনেকে এমন অর্জনের সামর্থ্য ধারণ করেও পারেননি। তেমন একজন ক্রিকেটার কিন্তু গলের মাঠেই আছেন। ম্যাথুস এবং তাঁকে পাশাপাশি রেখে একটি দৃশ্য কল্পনা করে নেওয়া যায়—পাশাপাশি দুটি গাছ। একটি সময়ের সঙ্গে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তরতরিয়ে বেড়েছে, যত্ন নেওয়ায় বিকশিত হয়েছে। আরেকটি যেন বনসাই। খর্বাকৃতি করে রেখে তাঁকে বাড়তে দেওয়া হয়নি।

বুঝিয়ে বলতে হবে? গল টেস্টে চোখ থাকলে এতক্ষণে ধরে ফেলার কথা সেই ক্রিকেটারটি কে। ফাওয়াদ আলম। ফাওয়াদের টেস্ট অভিষেক ১২ জুলাই, ২০০৯। এই গলেই সেটি ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ। গলেই সিরিজের প্রথম টেস্টে অভিষেক ঘটে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের। দীর্ঘ ১৩ বছর পর দুজনের টেস্ট ক্যারিয়ারে একটু তাকানো যাক।

গলে চলমান (তৃতীয় দিন) টেস্টটি ৩৫ বছর বয়সী ম্যাথুসের ক্যারিয়ারে ১০০তম টেস্ট। আর ৩৬ বছর বয়সী ফাওয়াদ খেলছেন তাঁর ১৯তম টেস্ট। ক্রিকেটের কুলীন সংস্করণে প্রায় একই সময়ে অভিযাত্রা শুরু করে কে বটবৃক্ষের আদল পেয়েছেন, আর কে বনসাইয়ের মতো ক্যারিয়ারটা বাঁচিয়ে রেখেছেন, তা বোঝা গেল?

চামিন্দা ভাসের কাছ থেকে শততম টেস্টের টুপিটি পান ম্যাথুস
ছবি: এএফপি

সংখ্যাগুলোর মধ্যে তুলনাটা অবিশ্বাস্য। টেস্টে ম্যাথুসের রানসংখ্যা ৭ হাজারের কাছাকাছি (৬৯১৮)। ৪৫.২১ ব্যাটিং গড়ে শতক আছে ১৩টি আর ৩৮ অর্ধশতক। পেস অলরাউন্ডার হয়েও টেস্টে খুব বেশি বল করেননি ম্যাথুস। উইকেটসংখ্যা তাই ৩৩। আর ফাওয়াদ নিজের ১৯তম টেস্টে এসে (কাল) ১০০০ রানের মাইলফলকের দেখা পান। ৪১.০৮ গড়ে শতক ৫টি, অর্ধশতক ২টি। ২টি উইকেটও আছে এই বাঁহাতি স্পিনারের। জানিয়ে রাখা ভালো, অভিষেক টেস্টেই ১৬৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন পাকিস্তানের খ্যাতিমান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার তারিক আলমের সন্তান ফাওয়াদ।

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ফাওয়াদের ক্যারিয়ারের এই হাল কেন? সে গল্পও সম্ভবত প্রায় সবারই জানা।

অভিষেক টেস্টে শতকের পর সেই সিরিজে পরের দুটি টেস্টেও খেলেন ফাওয়াদ। দুই টেস্টে চার ইনিংস মিলিয়ে কোনোবারই ৩০ রানের বেশি করতে পারেননি। এরপরই বাদ পড়েন ফাওয়াদ। পাকিস্তান ক্রিকেটে বাদ পড়াটা কখনোই কোনো সমস্যা ছিল না। প্রতি সিরিজেই খেলোয়াড় অদলবদল হয় এবং বাদ পড়া ক্রিকেটাররা ফিরেও আসেন। কিন্তু ফাওয়াদের বিষয়টি থেকে গেছে ফ্রানৎস কাফকার রহস্যগল্পের মতো।

বাদ পড়ার পর পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রানের পর রান করে বর্তমান এবং সে সময়ের (২০০৯ থেকে ২০২০) পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় নিয়েও জাতীয় দলে ফিরতে ফাওয়াদের সময় লেগেছিল ১১ বছর! ১৩ আগস্ট, ২০২০—সাউদাম্পটনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে এই সংস্করণে জাতীয় দলে ফেরেন ফাওয়াদ।

পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে ভালো করতে পারেননি ফাওয়াদ
ছবি: এএফপি

মাঝে এই ১১ বছরের শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। এখানেই পিছিয়ে পড়েন ফাওয়াদ। ম্যাথুস এখন বড় মাপের অলরাউন্ডার। চোটের উপদ্রব না থাকলে আরও বড় হতে পারতেন। ফাওয়াদ অতটা বড় মাপের না হলেও ফিরে আসার পর কিন্তু নিজেকে চিনিয়েছেন নতুন করে।

পাকিস্তান ক্রিকেটে ফাওয়াদের চেয়ে বেশি সময় বিরতির পর জাতীয় দলে ফেরার নজির আছে—বাঁহাতি বোলার ইউনিস আহমেদ। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টটি খেলে ১৯৬৯ সালের ২ নভেম্বর মাঠ ছাড়ার পর জাতীয় দলে ফিরেছিলেন ১৭ বছর ১১১ দিন পর। ফাওয়াদ গুণেমানে তাঁর চেয়ে ভালো ক্রিকেটার। আর তাই ১১ বছরের সেই শূন্যতা নিয়ে তাঁর নিজেরই আক্ষেপ হবে সবচেয়ে বেশি। অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের বয়সই তো এত দিন হয় না!

কিন্তু লড়াই ফাওয়াদের রক্তে বলেই হয়তো ফেরার পর আর দেরি করেননি। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলে ৫টি শতক তুলে নেওয়ার রেকর্ড গড়েন এবং এখন তিনি পাকিস্তানে দলের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। তবু আক্ষেপের জায়গাটা থাকেই। ফাওয়াদের টেস্ট অভিষেকের পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত এই সংস্করণে ৫১ জন নতুন ক্রিকেটার খেলিয়েছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। ওয়াহাব রিয়াজ ও মোহাম্মদ ইরফানদের মতো অনেকের ক্যারিয়ারও প্রায় শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। অনেকেই তাঁর চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন। একবার ভেবে দেখুন তো, ফাওয়াদের ক্যারিয়ারে প্রায় এক যুগের বিরতি না পড়লে আজ তিনি কোথায় থাকতেন!

অবশ্যই ম্যাথুসের আশপাশে। খেলোয়াড়ি সামর্থ্যে সমমানে না হোক (সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না), অন্তত দেশের হয়ে ইতিবাচক আরও কিছু মাইলফলকের দেখা তো পেতেন। টেস্টে ১৩ বছরে এসে হাজার রানের মতো মাথা হেঁট করা মাইলফলক অন্তত দেখতে হতো না। তবু লড়াই করাই যেহেতু ফাওয়াদের মতো ক্রিকেটারদের ধ্যান-জ্ঞান, তাই গলে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসের জন্য নিশ্চয়ই এখন মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফাওয়াদ।

প্রথম ইনিংসে ২৪ রানে আউট হওয়ায় ভালো করার তাড়না তো থেকে গেছে। আর পাকিস্তানও তেমন একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তৃতীয় দিনে এ প্রতিবেদন লেখার সময় নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করছিল (৪ উইকেটে ১০০) শ্রীলঙ্কা। এরই মধ্যে ২৪৭ রানের লিড নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে যে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে, তা ভালোভাবেই জানেন ফাওয়াদ।

দীর্ঘ ১১ বছর জাতীয় দলের বাইরে থাকার ‘পরীক্ষা’ যিনি দিয়ে এসেছেন, তাঁর মাঠের পরীক্ষায় অন্তত খুশিই হওয়ার কথা।