‘কমলায় নৃত্য করে...’
কাগিসো রাবাদা ৩৬তম ওভারে আউট হওয়ার পরই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বেরসিক শেষ উইকেট জুটিতে লুঙ্গি এনগিডি ও কেশব মহারাজ মিলে ৪৭ বলে ৪১ রান তুলে তাতে বাদ সাধার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধর্মশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে দর্শকেরা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন, ‘কমলা’দের নৃত্য আজ আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না! এমন একটা মুহূর্তের জন্য কত দিন ধরে অপেক্ষায় ছিল ডাচরা? কেউ কেউ বলবেন, ১৪২ বছর!
নেপোলিওনিক (১৮০৩-১৮১৫) যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত ধরে নেদারল্যান্ডসে ক্রিকেটের আগমন। এরপর তো ধীরে ধীরে সেখানে কিছু ক্লাবেরও জন্ম হলো। ১৮৮১ সালে প্রথম ম্যাচ খেলল নেদারল্যান্ডস জাতীয় ক্রিকেট দল। ব্রিটেনের আক্সব্রিজ ক্রিকেট ক্লাব একাদশের বিপক্ষে সে ম্যাচে ২২ জন খেলোয়াড় মাঠে নামিয়েও হারতে হয়েছিল ইনিংস ব্যবধানে। এরপর ১৪২ বছরের এই পথচলায় নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট অন্যদের তুলনায় এগিয়েছে শম্ভুক গতিতে।
১৮৯০ সালে জন্ম হলো রয়্যাল ডাচ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের। ১৯০৯ সালে যাত্রা শুরু করা ইমপেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স ১৯৬৫ সালে নাম পাল্টে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স (আইসিসি) হিসেবে আবির্ভাবের পরের বছর সহযোগী সদস্যপদ পায় নেদারল্যান্ডস। তারপর আইসিসি ট্রফি খেলার মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডস ক্রিকেটের বৈশ্বিক মানচিত্রে পা রাখে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। মাঝে ওয়ানডে খেলার অনুমোদন (স্ট্যাটাস) মিলেছে (২০০৬), চলে গেছে (২০১৪), আবার ফিরেও এসেছে (২০১৮)। ১৮৮১ সালে সেই যে প্রথম খেলতে নেমেছিল নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট দল—তখন থেকে হিসাব করলে এই ১৪২ বছরে গতকাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়টি নিশ্চিতভাবেই ডাচ ক্রিকেটের সেরা সাফল্য।
বড় দলগুলোর বিপক্ষে ডাচরা ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে; বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও জয় আছে এই সংস্করণে। আর টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপে জয় আছে ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জয়টি মাত্রই এগার মাস আগের, অ্যাডিলেডে।
কিন্তু ক্রিকেটে বিশ্বকাপ বলতে তো ওয়ানডে সংস্করণের টুর্নামেন্টকেই বোঝায় আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ আসরও এটাই। ২০০৩ টুর্নামেন্টে নামিবিয়া ও ২০০৭ টুর্নামেন্টে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের ১৬ বছর পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে ডাচরা। আগের দুটি দল আইসিসির সহযোগী সদস্য, দক্ষিণ আফ্রিকা পূর্ণ সদস্য। বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে প্রথম জয়—গতকাল শেষ উইকেট কেশব মহারাজকে আউট করার পরই তাই আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল ডাচদের। কিন্তু দেখা গেল উল্টোটা!
ইতিহাস গড়ে নাচানাচি দূরের কথা, মাঠ ছাড়ার সময় কমলা-জার্সির খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনো হেলদোলই দেখা গেল না! মুখে হাসির ছিটেফোঁটা উঁকি দিলেও স্কট এডয়ার্ডসের দল মাঠ ছেড়েছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। অথচ মাঠের বাইরে তখন উল্টো চিত্র। গ্যালারিতে গুটিকয়েক ‘কমলা’ সমর্থক নাচের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিয়েছেন। ধর্মশালা থেকে উড়োজাহাজে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার দূরের শহর আমস্টারডামে উঠল কমলা-ঢেউ। সাধারণত ব্যাপারটা ফুটবলে দেখা গেলেও নেদারল্যান্ডসে এখন ক্রিকেটার কম নেই। সংখ্যাটা ৬ হাজারের বেশি। সমর্থকসংখ্যা তাই আরও বেশি হওয়ার কথা। বাংলা ভাষার সেই লোকগীতি হয়তো ডাচদের জানা নেই। কিন্তু ধর্মশালা থেকে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম পর্যন্ত ওই গানটারই সার্থক প্রতিচ্ছবি দেখার অপেক্ষা ছিল—‘তোমরা দেখ গো আসিয়া/কমলায় নৃত্য করে থমকিয়া থমকিয়া...।’
অবাক করা বিষয় খেলোয়াড়দের মধ্যে তেমন আনন্দ প্রকাশের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি! তাই বলে আনন্দ ভর করেনি সেটা ভাবাও ভুল। শরীর ভাষায় হয়তো উদ্বাহু প্রকাশ ছিল না, তবে ক্রিকেট নেদারল্যান্ডস ‘এক্স’-এ (টুইটার) জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ উইকেটটি পড়ার পর গ্যালারি থেকে হিমাচল প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘নাতি ড্যান্স’–এ তাদের স্বাগত জানানো হয়েছে। ডাচরা সে তুলনায় এ জয় উদ্যাপন করেছে সামান্যই। মনের ভেতর পুষে রাখা জিদ কি তার কারণ? হতে পারে!
গত ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকাপে ১৫ জনের স্কোয়াড ঘোষণার পর ক্রিকেট বিশ্বের কাছে একটি আবেদন রেখেছিলেন নেদারল্যান্ডস কোচ রায়ান কুক। তাদের যেন আর ‘মিনিয়ন’ না বলা হয়। বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলাই ভালো। ‘মিনিয়ন’ শব্দের অর্থ হলো—অগুরুত্বপূর্ণ কেউ এবং যে সব সময় তার চেয়ে উঁচু স্থানীয়দের নির্দেশ মান্য করে। ক্রিকেটীয় ভাষায় ‘ছোট দল’ আর কি! তখন রায়ান কুকের সে কথায় ক্ষোভটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, ‘লোকে আমাদের প্রায়ই ক্রিকেট-মিনিয়ন বলে থাকে। আমরা কিন্তু তা মনে করি না। এমন কিছু বলার অর্থ হলো আমাদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখা।’
কোচের এই বক্তব্য কি স্কট এডওয়ার্ডসদের দল মনে রেখেছিল? পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে হারের পর গতকাল সামনে পড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা—যাঁরা নিজেদের প্রথম ম্যাচে (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে) তুলেছে ৪২৮ এবং পরের ম্যাচ (অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) ৩১১ করেও জিতেছে। ক্রিকেটে কুলীন গোত্রের বাইরে থেকে আসা ডাচরা কি না এমন দাপট ছড়ানো দলকেই হারিয়ে দিল! আর এমন জয়ের পর ডাচদের শান্ত-শিষ্ট মেজাজে মাঠ ছাড়াকে আর যা–ই হোক স্বাভাবিক বলা যায় না। কমলা-জার্সির ছেলেদের মনের মধ্যে ‘কমলা’ রং নেচেছে ঠিকই, কিন্তু চাহনি ও শরীরী ভাষায় তা অনূদিত না হওয়ার কারণ বোধ হয় সেই ‘মিনিয়ন’ তকমা! স্বাভাবিক চাহনিতে স্কট এডওয়ার্ডসরা হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন—‘আমরা নিজেদের কাজটা করলাম, কী বলবে না বলবে সেই সিদ্ধান্ত এখন তোমাদের!’
ডাচদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো। গত জুনে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। এরপর অক্টোবরে শুরু হওয়া বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগপর্যন্ত তারা কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলেনি। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আগেভাগে ভারতে এসেছিল ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’রা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বোলার ডেকে নিয়েছে নেটে। প্রস্তুতি ম্যাচে হেরেছে ভারতের রাজ্য দল কর্ণাটকের কাছে। আর নেদারল্যান্ডস দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই পুরোপুরি পেশাদার খেলোয়াড় নন। জীবিকা নির্বাহে অন্য কাজও করতে হয়।
তথ্যগুলো জেনে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের ‘মিনিয়ন’ ডাকার পেছনে যুক্তি খুঁজে পাবেন অনেকে। ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা হয়তো তেমনই। নইলে কী আর বিশ্বকাপ শুরুর আগে ডাচ কোচ রায়ান কুককে উপমহাদেশের দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত খেলার জন্য আর্তি জানাতে হয়! অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোকে ‘মাটির প্রদীপ’ বিচার করে বড়রা কেরোসিন শিখা সেজে ‘ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে’ বলে যে চোখ রাঙায় না—তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
মজার ব্যাপার, এই নেদারল্যান্ডস কিন্তু ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে প্রথম বিশ্বকাপেরও আগে। ১৯৬৪ সালে বব সিম্পসনের অ্যাশেজজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে অনানুষ্ঠানিক ওয়ানডেতে হারায় নেদারল্যান্ডস। সে ম্যাচটি খেলা হয়েছিল ম্যাটের উইকেটে। টেস্টখেলুড়ে কোনো দলের বিপক্ষে সেটা ছিল ডাচদের প্রথম জয়। এরপর ১৯৮৯ ও ১৯৯৩ সালে হেরেছে ইংল্যান্ড একাদশও। পরের বছর হান্সি ক্রনিয়ে এবং গ্যারি কারস্টেনদের দক্ষিণ আফ্রিকাও হেরেছিল ডাচদের কাছে। কিন্তু কোনো ম্যাচই ওয়ানডে মর্যাদা পায়নি। তাই বলে কি জয়গুলোকে খাটো হয়ে যায়? মোটেও না।
দাহকালের সেসব দিনে এমন দু-একটি জয়-ই ডাচদের উত্থানের ভিত। গতকাল তার-ই সেরা উদাহরণকে ডাচ সংবাদমাধ্যমগুলো নাম দিয়েছে ‘মিরাকল অব ধর্মশালা’ হ্যাঁ, ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে লিভারপুলের সেই ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুলে’রই আরেক সংস্করণ!
ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে ১৪তম দল হয়ে ৩য় দলকে হারিয়ে অলৌকিক গল্পের জন্ম দেওয়া ডাচরা এখন আর কোনো দলকেই ভয় পায় না। ৭৮ রানের ইনিংসে প্রোটিয়াদের হারানোয় দারুণ অবদান রাখা অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস কাল সংবাদ সম্মেলনে তেমন সুরেই কথা বলেছেন, ‘আমরা প্রতিটি ম্যাচে নিজেদের পরিকল্পনামতো খেলে জিততে চাই...আমরা ভালো খেললে যেকোনো দলকেই হারাতে পারি।’
ডাচরা আসলে না নেচে কথায়ই সব বুঝিয়ে দিয়েছে। জয়ের পর তাদের প্রতিটি উচ্চারণে আত্নবিশ্বাসের যে ছটা—সেটাই যেন ‘কমলা’র নাচের মুদ্রা! আর সেসব কথা যাঁরা শুনছেন তাঁরা যেন সেই ‘নাচ’ এর দর্শক।
অনুচ্চারে কিংবা ফিসফিস করে তাঁরাই বলাবলি করছেন—‘তোমরা দেখ গো আসিয়া/কমলায় নৃত্য করে থমকিয়া থমকিয়া...।’