পাকিস্তানের এই আমির অন্যদের চেয়ে আলাদা

অ্যাকশনে আমির জামাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম টি–টোয়েন্টিতেছবি: এএফপি

সাত ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজ—সূচি দেখে নিশ্চয়ই অনেকের চোখ কপালে উঠেছে?

ব্যস্ততার এই যুগে ৭ ম্যাচের সিরিজ দেখার সময় কোথায়! তার ওপর কোনো দল যদি প্রথম তিন–চারটি ম্যাচ জিতে নেয়, তাহলে অন্য ম্যাচগুলো নিয়ে আগ্রহেও তো ভাটা পড়ে। কিন্তু চলতি পাকিস্তান–ইংল্যান্ড টি–টোয়েন্টি সিরিজে এমন কিছু ঘটেনি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বলতে যা বোঝায়, এই সিরিজে তা–ই হচ্ছে।

সিরিজে ৩–২ ব্যবধানে এগিয়ে পাকিস্তান। গত বুধবার পঞ্চম ম্যাচটি জিতে এগিয়ে যায় বাবর আজমের দল। আজ লাহোরে ষষ্ঠ ম্যাচে কি তাহলে ইংল্যান্ডের সমতা আনার পালা?

সিরিজে চতুর্থ ম্যাচ পর্যন্ত তো তেমন কিছুই দেখা গেল। প্রথম ম্যাচ জিতল ইংল্যান্ড, পরেরটি পাকিস্তান, এরপর আবারও জিতল ইংল্যান্ড এবং তারপর পাকিস্তান জিতে সমতায় ফিরল এবং শেষ ম্যাচও জিতে সিরিজে এগিয়েও গেল।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে শেষ ওভারে ঠান্ডা মাথায় বল করেন আমির
ছবি: এএফপি

এত বড় দৈর্ঘ্যের সিরিজ কতটা মজার ও রোমাঞ্চকর হতে পারে, তা বহুদিন পর ইংল্যান্ড–পাকিস্তানের সৌজন্যে বোঝা যাচ্ছে। পাকিস্তান যেমন এই সিরিজে ২০০ ছুঁই ছুঁই সংগ্রহ তাড়া করে ১০ উইকেটে জিতেছে, তেমনি টি–টোয়েন্টিতে নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সংগ্রহ নিয়ে জয়ের নজিরও গড়েছে।

রোমাঞ্চ, উত্তেজনা—কোনো কিছুরই কমতি থাকছে না এই সিরিজে। আজ ষষ্ঠ ম্যাচেও তা–ই হয়তো দেখা যাবে। ক্রিকেটপ্রেমীরা ভাবতে পারেন, এই সিরিজে এত রোমাঞ্চের পরও কারও যদি মনে হয় ‘তবু খানিকটা কমতি রইল’—তাহলে আমির জামালকে দেখে খেদটা মিটতে পারে।

আরও পড়ুন

সিরিজের পঞ্চম ম্যাচটি দেখে না থাকলে কিংবা খোঁজখবর না রাখলে অনেকেই হয়তো ডানহাতি এই পেসারকে চিনবেন না। পরশু সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে অভিষেকেই দলকে জেতান এই ক্রিকেটার। শেষ ওভারে তাঁর দুর্দান্ত বোলিংয়ে জয়ের জন্য ১৫ রান নিতে পারেনি ইংল্যান্ড।

অথচ অভিষেকের আগে মাত্র ১২টি ঘরোয়া টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন ২৬ বছর বয়সী এ পেসার। ইকোনমি রেট ৯.১৭। ব্যাটিংয়ে ১৭৬.৮৬, স্ট্রাইক রেটে ২৩৭ রান। খেলেননি পাকিস্তান সুপার লিগেও (পিএসএল)। তবু জাতীয় দলে আমির জামালের অন্তর্ভুক্তিতে বোঝা যায়, প্রতিভা পেলে দেশটির নির্বাচকেরা দেরি করেন না। অতীতেও এমন দেখা গেছে বহুবার।

আমির জামাল। দলকে জেতানোর পর
ছবি: এএফপি

আমিরের ঘরোয়া পারফরম্যান্স হয়তো তাঁর জাতীয় দলে এত দ্রুত চলে আসার পক্ষে কথা বলে না। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চাপের মধ্যে যে দুটি ওভার বল করেছেন, তাতেই বোঝা গেছে আন্তর্জাতিক ময়দানে টিকে থাকার রসদ আছে এই ক্রিকেটারের। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান ক্রিকেট আবারও প্রমাণ করল, পরিসংখ্যান সব সময় একজন ক্রিকেটারের সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটায় না। কারণ ম্যাচে চাপের মধ্যে মনের সাহস মাপার সামর্থ্যে নেই সংখ্যার।

ইংল্যান্ডের ইনিংসে ১৪তম ওভার পর্যন্ত সময়টুকু মনে করে দেখুন। পাঁচ বোলার ব্যবহার করেছেন বাবর। মোহাম্মদ নওয়াজ, হারিস রউফ ও মোহাম্মদ ওয়াসিম—এই তিন বোলার মিলিয়ে তখনো ৬ ওভার বাকি ছিল। আর আমির জামালকে বাবর তখনো বোলিংয়ে আনেননি। অর্থাৎ, হয় আমির এমন চাপের মধ্যে বল করবেন, কিংবা তাঁকে বল দেওয়া হবে না—এই ছিল হিসাব। বাবর প্রথমটি বেছে নেন, বল তুলে দেন আমিরের হাতে। নিজের প্রথম ওভারেই ১ উইকেট ও ৫ রান দিয়ে আস্থার প্রতিদানও দেন আমির। এরপর শেষ ওভারে তো জিতিয়েই দিলেন। অথচ একবার ভেবে দেখুন, কেউ জানত না, শেষ ওভারে ছেলেটি পারবেন কি না। কেউ জানত না, এমন চাপে তিনি এর আগে কখনো পড়েছেন কি না!

আরও পড়ুন

সেই ওভারের গল্পটা পিসিবির ভিডিও বার্তায় বলেছেন আমির জামাল, ‘ববি ভাই (বাবর আজম) জানতে চাইলেন, কী বল করব? বললাম, ওয়াইড ইয়র্কার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা করতে পারব তো? বললাম, অবশ্যই। এরপর তিনি আমাকে ফিল্ডিং সাজিয়ে দিলেন।’

আমির জামাল সে ওভারে চারটি ‘ডট’ বল করেন। মাত্র ৮ রান দিয়ে জিতিয়ে দেন পাকিস্তানকে। দেশটির সব কিংবদন্তি পেসারের মতো প্রচণ্ড গতি নেই আমিরের। তেমন আগ্রাসীও নন। কিন্তু মিডিয়াম পেস গতিতে লাইন–লেংথ নিখুঁত। নইলে শেষ ওভারে চারটি ওয়াইড ইয়র্কার করতে পারতেন না।

এখন প্রশ্ন হলো, এই আমির জামাল কে? পাকিস্তান এই সিরিজে তাঁর সঙ্গে আরও একজনকে ডেকেছে—আবরার আহমেদ। এই রহস্য স্পিনার পিএসএলে খেলেছেন এবং সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে হয়তো তাঁকে দেখাও যেতে পারে। তবে আমির কিংবা আবরার—দলে ডাক পেলেও কারও এই সিরিজে খেলাটা নিশ্চিত ছিল না। পাকিস্তানের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলেও নেই তাঁরা।

নাসিম শাহ অসুস্থ হওয়ার পরই কপাল খুলে যায় আমিরের। পঞ্চম ম্যাচে খেলার কথা শোনার পর তাঁর কেমন লেগেছিল, সে কথাও বলেছেন আমির, ‘সাকি ভাই (সাকলায়েন মুশতাক) আমাকে বলার পর প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। জানতে চাওয়া হয়েছিল, মাঠে কী করতে পারব? বলেছি, যা করতে বলা হবে তা–ই করব। যা পারি না, তা করব না। নিজের শক্তিতে যা কুলায়, তা–ই করব।’

আরও পড়ুন

আমিরের জন্ম পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালিতে। কিন্তু বেড়ে ওঠা রাওয়ালপিন্ডিতে। ২০১৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে পা রেখে পরের বছর পাকিস্তান অনূর্ধ্ব–১৯ দলের হয়ে ৫ ম্যাচে ৩০ উইকেট নেন আমির। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নামার আগে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে সেভাবে আলোচনায় আসেননি এই পেসার

সে বছর পাকিস্তান টেলিভিশনের হয়ে নেন ১৭ উইকেট। শেষ দুই মৌসুমেও ভালো খেলেছেন ঘরোয়ায়। আটে নেমে রানও পেয়েছেন ভালোই। পাকিস্তান দলে তাঁর ডাক পাওয়াটা অপ্রত্যাশিত হলেও আমির কিন্তু প্রত্যাশা মিটিয়েছেন।

এখন বাকি পথে কী করবেন, তা সময়ই বলে দেবে।