সাইফ হাসান: টেস্ট ওপেনার থেকে টি-টোয়েন্টির ‘পছন্দ’
পরিচিতি পেতে শুরু করেন বয়সভিত্তিক দলে থাকতেই। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ছিলেন অধিনায়কও। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সুযোগ পান টেস্ট দলে। একসময় এই সংস্করণের ক্রিকেটার হিসেবে তকমাও গায়ে লেগে যায়। তবে অল্প দিনে থেমে যায় টেস্টের যাত্রা, টি-টোয়েন্টির সুযোগও কাজে লাগাতে না পারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পড়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেই।
গত বছর দুয়েক সময়ে নিজের গল্পটা পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন সাইফ হাসান। এখন তিনি টি-টোয়েন্টি সংস্করণে বাংলাদেশ যে ধরনের ক্রিকেটার খুঁজে বেড়াচ্ছে, তেমনই একজন। কাল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৮ উইকেটের জয়ে সাইফ বল হাতে দুই উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে খেলেছেন ১৯ বলে ৩৬ রানের অপরাজিত ইনিংস।
অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করে ২০২০ সালে সাইফের অভিষেকটা হয়েছিল টেস্ট সংস্করণ দিয়েই। ওই সময় পাঁচ বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে ৩৬ ম্যাচ খেলা সাইফের গড় ছিল ৪৬.১৮। টেস্ট ক্রিকেটে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হবেন, তখনো তাঁকে নিয়ে আশা তা–ই।
সম্ভাবনা হাওয়ায় ভাসিয়ে সাইফের টেস্ট ক্যারিয়ার এখনো আটকে আছে ওই শুরুর বছর দেড়েকেই। ওপেনার হিসেবে দলে এসে যে ছয়টি ম্যাচ খেলেছেন, কোনোটিতে হাফ সেঞ্চুরিও নেই। টেস্টে যাত্রাবিরতি পড়ার আগেই যদিও টি-টোয়েন্টি সংস্করণে অভিষেক হয়ে যায় তাঁর।
২০২১ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই সিরিজে দুই ম্যাচে আউট হন যথাক্রমে ১ ও শূন্য রানে। এই সংস্করণের শুরুতেও ধাক্কা খাওয়া সাইফের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারই আদতে থমকে যায় সেখানে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে এশিয়ান গেমসের সুবাদে আবারও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির স্বীকৃতি থাকলেও এশিয়ান গেমসে দলগুলো পাঠিয়েছিল দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির দল। ওই টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ম্যাচে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরিও পেয়ে যান সাইফ। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে ১ ও শূন্য রানে আউট হলে সেই পেছনের সারিতে থেকে যেত হয় তাঁকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ছবি থেকেও হারাতে শুরু করেন। তবে এই সময়ে নিজেকে তিনি আবার ভেঙে গড়েন। ছক্কা মারার সহজাত সামর্থ্য তাঁর ছিল আগে থেকেই— উন্নতি করেন মাঠের চারদিকে শট খেলতে পারায়। এর পাশাপাশি সাইফের জন্য কার্যকর হয়ে ওঠে তাঁর অফ স্পিন বোলিং।
বাংলাদেশ তাঁদের টি-টোয়েন্টি দলে সন্ধান করছিল এমন কারও, যিনি অবদান রাখতে পারবেন ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায়। সাইফের ক্রিকেটের শুরুর দিকের পথচলা ছিল ওপেনার হিসেবেই, টি-টোয়েন্টি সংস্করণে গত কয়েক বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে সাইফ তিন-চারে খেলতে শুরু করেন। টপ-অর্ডারে বাংলাদেশের হয়ে যাঁরা খেলেন, তাঁদের কেউ বোলিং করেন না, সাইফ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
প্রধান নির্বাচকের ভাষায় ‘মাল্টিপল প্লেসে অ্যাড্রেস’ (দলে একাধিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম) করার মতো খেলোয়াড় দরকার ছিল তাঁদের। তাতেই কপাল খুলে যায় ২৮ বছর বয়সী সাইফের—দুই বছর পর সাইফের প্রত্যাবর্তন হয় নেদারল্যান্ডস ও এশিয়া কাপের দলে। কিন্তু শুধু তো আর ‘ভাবনায়’ আটকে থাকলে হবে না, সাইফকে মাঠে প্রমাণ করতে হতো তাঁর ওপর রাখা আস্থারও।
সেটি তিনি নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কাল প্রথম ম্যাচে করেছেন বেশ ভালোভাবে, তা–ও প্রথমবার সুযোগ পেয়েই। টস হেরে ব্যাট করতে নামা ডাচদের ইনিংসের দশম ওভারে তাঁর হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক লিটন দাস।
দ্বিতীয় বলেই তাঁকে চার হাঁকান তেজা নিদামানুরু। নিজের প্রথম ওভারটা এই ডাচ ব্যাটসম্যানের উইকেট তুলে নিয়েই শেষ করেন সাইফ। এর আগে একই ওভারে তাঁর বলে নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসের ক্যাচ নিয়েছিলেন জাকের আলী। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে পরে আরও একটি ওভার করলেও উইকেট পাননি— তাঁর বোলিং পর্ব শেষ হয়েছে ২ ওভারে ১৮ রানে ২ উইকেট নিয়ে।
শুধু এটুকুতে থামলেও কাল রাতটা রঙিনই থাকত সাইফের জন্য। কিন্তু পরে ব্যাট হাতেও অধিনায়ক লিটন দাসের সঙ্গী হয়ে তিনি ম্যাচটা শেষ করেছেন ১৯ বলে ৩৬ রানের অপরাজিত ইনিংসে। ম্যাচ শেষ করেছেন টানা দুই বলে ছক্কা মেরে।
এমন একটা ম্যাচ খেলে মাঝবিরতিতে এসে বলা সাইফের ছোট্ট কথাগুলো যেন তাঁর ফিরে আসার সময়ের বড় একটা গল্পই বলে দেয়। সম্প্রচারকদের বলা সেই কথাগুলো তাঁর মুখেই শুনুন, ‘অনেক কঠোর পরিশ্রম ও প্রক্রিয়া ছিল (ফিরে আসার পেছনে)। আমি সুযোগ পেয়েছি আজ (কাল), সর্বোচ্চটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি।’
সুযোগ কাজে লাগাতে সাইফ কাল সত্যিই পেরেছেন। কিন্তু তাঁর এই যাত্রা আরও অনেক দীর্ঘ হতে হবে। তাতে তাঁর নিজের ভালো তো বটেই—দরকার বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও!