যে ‘অপরাধে’ টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল ফ্লেমিংয়ের

টেস্ট ক্যারিয়ারটা মাত্র ২০ টেস্টের ফ্লেমিংয়েরফাইল ছবি

অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন স্টিভ ওয়াহ। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগও বলা যেতে পারে সে সময়কে। স্টিভ ওয়াহ খেলোয়াড়দের শুধু ভালো খেলতে উদ্বুদ্ধই করেননি, দলের মধ্যে কিছু নিয়মকানুনও চালু করেছিলেন। সেসব নিয়ম নিয়ে তাঁর সতীর্থরা যে খুব খুশি ছিলেন, ব্যাপারটা তা–ও নয়। ওয়াহর ব্যক্তিত্ব আর শৃঙ্খলার প্রতি অবিচল মনোভাবের কারণে দলের খেলোয়াড়েরা মেনে নিতেন।

ফ্লেমিং এখন
ছবি: এএফপি

স্টিভ ওয়াহর সময় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ‘ব্যাগি গ্রিন টেস্ট ক্যাপ’ পরার বাধ্যবাধকতা ছিল। সাবেক এই অধিনায়ক নিয়ম করে দিয়েছিলেন, টেস্ট ম্যাচের প্রথম সেশনে অন্তত দলের সব ক্রিকেটারকেই ব্যাগি গ্রিন পরে খেলতে হবে। অস্ট্রেলিয়া দলের টেস্ট ঐতিহ্যের প্রতি খেলোয়াড়দের অনুগত করা এবং তাঁদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার গর্বিত অনুভূতি জাগাতেই এমন নিয়ম করেছিলেন ওয়াহ। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দেশপ্রেমের ব্যাপারটিও।

ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ নিয়ে খুব স্পর্শকাতর ছিলেন স্টিভ ওয়াহ
ফাইল ছবি

তবে এই ব্যাগি গ্রিন টুপিই অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পেস বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে দিয়েছিল ২২ বছর আগে। কারণটা আর কিছুই নয়, ব্যাগি গ্রিন পরতে স্টিভ ওয়াহর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন ফ্লেমিং। যদিও সেটি মাঠে নয়, অন্য জায়গায়।

আরও পড়ুন

২০০১ সালে অ্যাশেজ সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে। সে সময়ই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল উইম্বলডন টেনিস। টেনিসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর অল ইংল্যান্ড ক্লাবের সেন্টার কোর্টে বসে দেখার আবেদনই আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা সেই স্বাদ পেয়েছিলেন সেবারের ফাইনালে। অস্ট্রেলিয়ার প্যাট্রিক রাফটারের মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্রোয়াট তারকা গোরান ইভানসেভিচ। পাঁচ সেটের সেই স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই জিতে ইভানসেভিচ ইতিহাসের প্রথম অবাছাই হিসেবে জিতেছিলেন উইম্বলডনের শিরোপা।

উইম্বলডনের কোর্টে ব্যাগি গ্রিন পরে যাওয়ার বিরোধী ছিলেন শেন ওয়ার্ন
ফাইল ছবি

ফাইনালের সময় অ্যাশেজের একটি টেস্ট ম্যাচ একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় নিজ দেশের খেলোয়াড় প্যাট্রিক রাফটারকে উইম্বলডনের গ্যালারিতে বসে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা। সবাই যখন অল ইংল্যান্ড ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই স্টিভ ওয়াহ একটা অদ্ভুত নির্দেশ জারি করে বসেন—উইম্বলডন ফাইনাল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের দেখতে হবে ব্যাগি গ্রিন টেস্ট ক্যাপ পরে। তিনজন ক্রিকেটার সেই অদ্ভুত নির্দেশ মানেননি—শেন ওয়ার্ন, স্টিভের ভাই মার্ক ওয়াহ আর ডেমিয়েন ফ্লেমিং। ফ্লেমিং অবশ্য এজবাস্টন টেস্টে একাদশে ছিলেন না।

আরও পড়ুন

প্রয়াত কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন ২০১৮ সালে এ নিয়ে বলেছিলেন, ‘পুরো বিষয়টি ভীষণ বিব্রতকর ছিল সবার জন্য। উইম্বলডনের ফাইনাল দেখতে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের কেন ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরে যেতে হবে! বিষয়টি ভেবেই আমার বমি আসছিল যে একদল পুরুষ মানুষ উইম্বলডনের গ্যালারিতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরে হাজির হয়েছে। আপনি টেস্ট ক্রিকেটার বা আপনি ক্রিকেটকে খুব ভালোবাসেন, এটা বোঝানোর জন্য ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরার কোনো দরকার নেই। গ্যালারিতে অনেকেই আমাদের দেখে হাসছিল। আশপাশ থেকে প্রচুর কটুকথাবার্তাও কানে এসেছিল সেদিন।’

সেদিন ব্যাগি গ্রিন না পরার ‘অপরাধে’ ভাই মার্ক ওয়াহকে দল থেকে বাদ দেননি স্টিভ ওয়াহ
ফাইল ছবি

ফ্লেমিং অবশ্য ওয়ার্নের মতো ভাবেন না। তাঁর এখন মনে হয়, কী হতো, যদি স্টিভ ওয়াহর নির্দেশ মেনে ব্যাগি গ্রিন টুপিটা পরতেন! তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার তো অন্তত বাঁচত আরও কিছু দিন। ফ্লেমিং ‘ফক্স স্পোর্টস’কে জানিয়েছেন, এরপর আর কখনোই টেস্ট খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর।

খড়্গটা স্টিভ ওয়াহ ফ্লেমিংয়ের ওপরই নামিয়েছিলেন। ওয়ার্ন কিংবা মার্ক ওয়াহ—কারও টেস্ট ক্যারিয়ার সে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ‘শেন ওয়ার্নকে সে সময় দল থেকে বাদ দেওয়া যেত না, বাদ পড়ার সুযোগ ছিল না মার্ক ওয়াহরও। বাকি থাকি আমি, আমার আর সেই ঘটনার পর টেস্ট খেলার সুযোগ হয়নি।’

ঘটনাটি ফক্স স্পোর্টসকে বলেছেন ফ্লেমিং, ‘সেবার এজবাস্টনের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়ার পর পরিকল্পনা হয় সবাই মিলে প্যাট্রিক রাফটারের সঙ্গে ইভানসেভিচের উইম্বলডন ফাইনালটি দেখতে যাব। টেস্ট জেতার পর খুব হই হুল্লোড় হচ্ছিল, খুব অ্যালকোহল খাওয়া হচ্ছিল। ওর মধ্যেই স্টিভ ওয়াহ কথাটা তুলেছিল। বলেছিল, উইম্বলডন ফাইনালে ব্যাগি গ্রিন পরে যেতে। আমার কথাটা কানে এল। কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি। ভেবেছিলাম বিয়ার টিয়ার খেয়ে সবাই বাজে বকছে। কিন্তু আসলে নির্দেশটি কড়াকড়িভাবেই আরোপ করেছিল স্টিভ।’

ফ্লেমিং ১৯৯৯ বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন
ফাইল ছবি

স্টিভ ওয়াহ কখন ব্যাপারটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, সে বিষয়ে ফ্লেমিং বলেন, ‘আমি যখন বাসে উঠলাম সেন্টার কোর্টে যাওয়ার জন্য, তখন দেখি, কেবল আমি, ওয়ার্ন আর মার্ক ওয়াহর মাথায় ব্যাগি গ্রিন নেই। কোর্টে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকেরা বিপুল করতালি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল। কিন্তু স্টিভ ওয়াহকে দেখলাম মুখ ভার করে আছে। তাঁর বিরক্তির কারণ, তাঁর নির্দেশ আমরা তিনজন মানিনি। এ ব্যাপারে স্টিভ ব্যবস্থা নিয়েছে, আর আমি কখনোই টেস্ট খেলার সুযোগ পাইনি। তবে এটা ঠিক, পরিণতি এমন হবে জানলে আমি সেদিন অবশ্যই স্টিভ ওয়াহর নির্দেশ মানতাম।’

১৯৯৪ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মাত্র ২০টি টেস্ট খেলেছেন ফ্লেমিং। উইকেট পেয়েছেন ৭৫টি। দুর্দান্ত ছিল তাঁর অভিষেক। ’৯৪ সালের অক্টোবরে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ইতিহাসে তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে তিনি সে কীর্তি গড়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৮৮টি ওয়ানডে খেলে তাঁর উইকেটসংখ্যা ১৩৪। তিনি ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য। খেলেছেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপও।