ক্রিকেটের স্কুল যখন ঠিকানাবিহীন

ধানমন্ডির বেশ কয়েকটি একাডেমি এখন ঠাঁই নিয়েছে শ্যামলী ক্লাব মাঠেমোহাম্মদ জুবাইর

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের দৃশ্যটার সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় ছিল। সারা মাঠে বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড়। কেউ হাঁটাহাঁটি করছেন, কেউ দৌড়াচ্ছেন। ক্রিকেট, ফুটবল খেলা তো আছেই। কাছে গেলে এই ভিড়ের মাঝেই একসঙ্গে দুই-তিনটা ক্রিকেট একাডেমির অনুশীলন চোখে পড়ত। মাঠের এক পাশে একাডেমির ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবারা অপেক্ষা করতেন। অনুশীলন শেষ হলে সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরায় অপেক্ষা।

এখন আর আবাহনী মাঠে সে দৃশ্য দেখা যায় না। একসময়ের ‘সবার মাঠে’ এখন চলছে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কাজ। আর তাতে স্বাভাবিকভাবেই ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়েছে এ মাঠে অনুশীলন করা ১৭টি ক্রিকেট একাডেমি। উদয়ন সে রকমই একটি ক্রিকেট একাডেমি। একাডেমির কোচ আল আমিন খান জানালেন, আবাহনী মাঠে জায়গা না পেয়ে মোহাম্মদপুরের ঈদগাহ মাঠে কোচিং করাচ্ছেন তিনি। জায়গা বদলের কারণে একাডেমির ছাত্রসংখ্যাও কমে এসেছে। এই টানাটানির মধ্যেই চলছে উদয়নের ক্রিকেট শিক্ষা।

ঠিকানাবিহীন হয়ে নিজের একাডেমির দুর্দশার কথা বলছিলেন আল আমিন, ‘মোহাম্মদপুরে আমি মাসে ২০ দিন অনুশীলন করাই। পাঁচ হাজার টাকা দিই মাঠভাড়া। আবাহনী মাঠে থাকা অবস্থায় নিয়মিত ৩৫-৪০ জন ছেলে আসত। এখন ছাত্রই আছে ৭-৮ জন। গত মাসে ১১ হাজার টাকা বেতন তুলে পাঁচ হাজার টাকা মাঠভাড়া দিয়েছি। তিনজন কোচ আমার। এখন একজন আসে না। লজ্জা লাগে। কাউকে বলতেও পারি না কী অবস্থায় আছি।’

ইকবাল হোসেন খুদে ক্রিকেটারদের অনুশীলন করাচ্ছেন শ্যামলী ক্লাব মাঠে
প্রথম আলো

লায়ন ক্রিকেট একাডেমির প্রধান কোচ মামুন ধানমন্ডি ছেড়ে চলে গিয়েছেন ঘাটারচরে। জায়গা বদল হওয়ায় ছাত্রসংখ্যা কমেছে তাঁরও, ‘খুবই খারাপ অবস্থা ভাই। বলতেও লজ্জা লাগছে। যেখানে আমার সব সময় ৭০-৭৫ জন ছাত্র থাকত, সেটা এখন ১২-১৩ জনে নেমে আসছে। দূরত্ব বেশি হওয়ায় যাতায়াত কঠিন। ছাত্রদের এত দূর আসতে দিতে চান না বাবা-মায়েরা। আমাদের বেশির ভাগ ছেলেই ছিল ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক। সেটার একটা প্রভাব পড়েছে।’

ধানমন্ডির বেশ কয়েকটি একাডেমি এখন ঠাঁই নিয়েছে শ্যামলী ক্লাব মাঠে। ক্রিকেট কোচিং স্কুল (সিসিএস) তার একটি। একাডেমির কোচ ইকবাল হোসেন খুদে ক্রিকেটারদের অনুশীলন করাচ্ছেন শ্যামলী ক্লাব মাঠে। ধানমন্ডি থেকে সরে আসায় ক্ষতি হয়েছে তাদেরও। ইকবাল বলছিলেন, ‘ধানমন্ডি থেকে ছাত্রদের আসা-যাওয়ায় ২০০-৩০০ টাকা লাগে। প্রতিদিন তো এটা সম্ভব নয়। তাই অনেকেই একাডেমি ছেড়ে দিচ্ছে। ধানমন্ডিতে থাকা অবস্থায় আমাদের ২০০-২৫০ জন ছাত্র ছিল, ৭০-৭৫ জন নিয়মিত আসত। এখন ৩০-৪০ জন নিয়মিত আসে।’

ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে যখন চলত একাডেমিগুলোর কার্যক্রম
শামসুল হক

এ অবস্থার জন্য একাডেমিগুলোও দায় এড়াতে পারবে না। অনেক বছর ধরেই ধানমন্ডির বেশ কয়েকটি একাডেমি নিজস্ব মাঠ ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। একাত্তর ক্রিকেট একাডেমির কোচ করিম দায়টা এড়িয়ে যাচ্ছেন না। তবে ঢাকা শহরের বাস্তবতাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি, ‘একাডেমিগুলোর একটা দায় অবশ্যই আছে। তবে মাঠ করা তো সহজ কথা নয়। চাইলেই আপনি ঢাকার মধ্যে মাঠ তৈরির মতো জমি পাবেন না। কেরানীগঞ্জের ওদিকে পাবেন। কিন্তু সেদিকে গেলে আবার ছাত্র পাবেন না। অন্যদের মতো আমারও ছাত্রসংখ্যা অনেক কমে এসেছে। যারা আসে, তারাও অনিয়মিত। একদিন এলে দুই দিন আসে না।’

বাংলাদেশে একাডেমিই ক্রিকেট শিক্ষার প্রথম ধাপ। একাডেমিতে খেলা শিখে কেউ বয়সভিত্তিক ট্রায়ালের প্রস্তুতি নেয়, কেউ বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে। কেউবা অপেক্ষায় থাকে বিসিবির একাডেমি কাপের। না হয় একাডেমির কোচরাই ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বিভাগ লিগে খেলার সুযোগ করে দেন। কিন্তু সেই একাডেমিই যে এখন ভাসমান!