সন্দেহের বিপিএল
৫ রানের ওয়াইড আর ওভারে ১১-১৫ রান
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ মানেই স্পট ফিক্সিংয়ের অবারিত সুযোগ। বিপিএলও এর বাইরে নয়। প্রতি মৌসুমেই সন্দেহজনক কিছু না কিছু ঘটে, কখনো কখনো তা প্রমাণিতও হয়েছে। সন্দেহের বাইরে থাকছে না এবারের বিপিএলও। ৩০ ডিসেম্বর শুরু টুর্নামেন্টে গত রোববার পর্যন্ত ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের ২৬টি ম্যাচে এমন বেশ কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো স্পট ফিক্সিং সন্দেহের উদ্রেক করছে।
‘ক্রিকেট খেলা এমন এক জিনিস, সন্দেহের চোখে দেখলে সবই সন্দেহজনক মনে হবে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে সবই স্বাভাবিক মনে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক সাবেক ক্রিকেটারের উক্তি, যিনি ক্রিকেট খেলাটাকে সফেদ-পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছেদে দেখতে চান। খেলাটা ক্রিকেটারদের রুটিরুজি। তাঁর বিশ্বাস, এর সঙ্গে তাঁরা বেইমানি করতে পারেন না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ওই সাবেক ক্রিকেটারের ‘বিশ্বাস’কেও চলমান বিপিএল বারবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর মনেও জন্ম নিচ্ছে অবিশ্বাস আর সন্দেহ।
বিপিএল নিয়ে সন্দেহের দোলাচল প্রতিবারই দেখা গেলেও এবার সেটা একটু বেশি। এরই মধ্যে মাঠের খেলায় বেশ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো খেলোয়াড় থেকে শুরু করে বিপিএল-সংশ্লিষ্ট অনেক সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটার, বোর্ড কর্মকর্তা, সাংবাদিক এমনকি দর্শকদের মনেও স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহ ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
একটি নির্দিষ্ট ওভার বা একটি নির্দিষ্ট বলে ঘটা এসব ঘটনা ম্যাচের ফলাফলে বেশির ভাগ সময়ই প্রভাব ফেলে না। আর পুরো ম্যাচ এখন ফিক্সিং হয় না বললেই চলে, বেশি হয় স্পট ফিক্সিং। স্পট ফিক্সিংয়ের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ফলাফলে প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা ঘটানোর দরকারও নেই। এ ধরনের ফিক্সিং হয়ই একটি নির্দিষ্ট ওভার ধরে।
ওভারে ১১ থেকে ১৫ রান, ওয়াইড বলে ৫
‘ওয়াইড বলে ৫ রানের একটা খেলা হচ্ছে সম্ভবত, যাতে কিপার ইনভলভ থাকে না। এমন ওয়াইড হবে যে, কিপারও ধরতে পারবে না’—বলেছেন বিপিএল-সংশ্লিষ্ট একজন।
ওয়াইড বল থেকে কখনো কখনো বাউন্ডারি হতেই পারে। ওয়াইড ইয়র্কার দিতে চাইলে সেই সম্ভাবনা বাড়ে।
কিন্তু ওয়াইড ইয়র্কার তো করার কথা অফসাইডে। বিপিএলে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। এ ধরনের বিশাল ওয়াইড বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাচ্ছে লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে। বল লেগ স্টাম্পের একটু বাইরে গেলেই ওয়াইড, সেখানে এসব সন্দেহজনক বল পপিং ক্রিজ তো বটেই, অনেক সময় পিচেরও বাইরে দিয়ে যাচ্ছে!
ওয়াইড করার জন্য তো পাশের উইকেটে বল করার দরকার নেই। লেগ সাইডে একটু বাইরে করলেই ওয়াইড, তবু অন্য পিচে কেন করছে? ৪-৫ রান হওয়ার জন্য। যেন ওই ওভারের জন্য ধরা বাজির নির্দিষ্ট রানটা আসে। উইকেটকিপার তো না-ই; থার্ডম্যান, ফাইন লেগও সব সময় এসব কাভার করতে না-ও পারে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক ক্রিকেটার
ধরা যাক, ওয়াইড বল হবে ধরে নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ওভারের একটি বল নিয়ে স্পট ফিক্সিং ছিল। কিন্তু সেটার জন্য এত বড় ওয়াইড কেন দেবেন একজন বোলার?
বিপিএল কাছ থেকে দেখছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক সাবেক ক্রিকেটারের মনেও প্রশ্নটা এসেছে, ‘ওয়াইড করার জন্য তো পাশের উইকেটে বল করার দরকার নেই। লেগ সাইডে একটু বাইরে করলেই ওয়াইড, তবু অন্য পিচে কেন করছে? ৪-৫ রান হওয়ার জন্য। যেন ওই ওভারের জন্য ধরা বাজির নির্দিষ্ট রানটা আসে। উইকেটকিপার তো না-ই; থার্ডম্যান, ফাইন লেগও সব সময় এসব কাভার করতে না-ও পারে।’
এ বিষয়ে আরেক সাবেক ক্রিকেটারের মন্তব্য, ‘এই পর্যায়ের একজন ক্রিকেটারের পক্ষে অন্য পিচে বল করা অবাস্তব। এসব উইকএন্ড ক্রিকেটেও হয় না। এমন বোলিং পেশাদার ক্রিকেটারদের কাছে অপ্রত্যাশিত।’
বিপিএলের দলগুলোর সঙ্গে থাকা অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, এবার স্পট ফিক্সিংয়ের ট্রেন্ড নির্দিষ্ট একটি ওভারে ১১ থেকে ১৩, ১৪, ১৫ রানের মতো দেওয়া। কিন্তু ব্যাটসম্যান তো আর বোলারের মনের কথা জানেন না! অনেক সময় মারার বল পেয়েও তাঁরা মারেন না। বোলার তখনই ওয়াইড-নো করতে শুরু করেন। নিজ দলের কিপারকেও ফাঁকি দিয়ে ওয়াইড বলে বাউন্ডারি দিয়ে প্রতিশ্রুত রানের কোটা পূরণ করতে অনেক সময় বল চলে যায় পাশের উইকেটে। তাতেও কাজ না হলে আছে ওভারথ্রো।
সন্দেহজনক কিছু ঘটনা
প্রমাণ যেহেতু নেই, কোনো দল বা খেলোয়াড়ের নাম উল্লেখ না করেই কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ওয়াইডে ৫ রান হওয়াটা নিয়েই যেহেতু বেশি সন্দেহ আর আলোচনা, সেটাই আগে—
গত রোববার পর্যন্ত ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম পর্ব মিলিয়ে ২৬টি ম্যাচের ১০টিতে মোট ১৬টি ওয়াইড বাউন্ডারি হয়েছে, মানে ১৬ বার ওয়াইড থেকে ৫ রান এসেছে। এ রকম বল হয়েছে গত পরশুও। এই সংখ্যা অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক ঠেকছে। এসব ওয়াইড বাউন্ডারি স্থানীয় ও বিদেশি দুই রকম বোলারই দিয়েছেন। এমনকি স্পিনাররাও!
ওয়াইড বাউন্ডারির মতো সন্দেহজনক ওভারথ্রোও হচ্ছে। সিলেটে বর্তমানে পয়েন্ট তালিকায় ওপরের দিকের এক দল ব্যাটিং করছিল এখনো পয়েন্ট তালিকার নিচের দিকের এক দলের বিপক্ষে। ব্যাটিং দলের এক বিদেশি ব্যাটসম্যান ছক্কা মারলেন। পরের দুই বলে দুটি সিঙ্গেলের পর আবারও ওই ব্যাটসম্যান ব্যাটিং প্রান্তে। বোলার বাউন্ডারি হাঁকানোর মতো বল দিয়েও ব্যাটসম্যানকে প্রত্যাশিত লোভে ফেলতে পারেননি। অগত্যা ব্যাকআপ ফিল্ডার বা কিপার না থাকা সত্ত্বেও বোলার অযথা স্টাম্পের দিকে বল থ্রো করে বসেন, চার রান হয়ে যায় ওভারথ্রোতে। দুই-তিন ওভার ভালো বোলিং করলেও কোনো একটি ওভারে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটানোর জন্য ক্রিকেটারদের মধ্যে বিশেষ ‘খ্যাতি’ আছে এখনো বাংলাদেশ দলে না খেলা ওই বাঁহাতি স্পিনারের।
স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য কাজে লাগানো হয় মূলত বোলারদের। কম রান দেওয়াটা তাঁদের হাতে থাকে না, তবে একটা নির্দিষ্ট ওভারে বেশি রান দেওয়া তো নিশ্চিত করতে পারেন। ‘ওয়াইড’ বা ‘নো’ বল করাটা তো ইচ্ছার ব্যাপার। তবু ব্যাটসম্যানদের কিছু কাণ্ডও চলে আসছে সন্দেহের আতশি কাচের তলায়।
সিলেট পর্বেই এক ম্যাচে দুই বিদেশি ব্যাটসম্যানের জুটির হঠাৎ গতি হারিয়ে ফেলা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। যা নিয়ে ম্যাচ শেষে তাঁদেরই এক সতীর্থ সংবাদমাধ্যমের কাছে বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন।
একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির অধিনায়কের ব্যাটও হঠাৎ স্থবির হয়ে যেতে দেখা গেছে। নির্দিষ্ট সময় পর তিনি আবার গতি ফিরে পান। নির্দিষ্ট কয়েক ওভারে রানটাকেও নির্দিষ্ট রাখতেই এমন ব্যাটিং বলে ধারণা অনেকের। সিলেটেই আরেক ম্যাচে জাতীয় দলে খেলা স্থানীয় এক ব্যাটসম্যানের আউট হওয়ার ধরনও অবাক করেছিল সবাইকে।
মিরপুরে বিপিএলের শুরুর দিকের এক ম্যাচে একজন বিদেশি বোলারের কাছ থেকে একের পর এক শর্ট বল পেয়ে বিস্মিত হয়েছিল ব্যাটিং দলই। এ নিয়ে সেই দলের এক কোচিং স্টাফ সদস্যের মন্তব্য, ‘ওই বোলার একের পর এক শর্ট বলে করে গেল, ছয় খেতে থাকল। সবাই ভাবে এ রকম একটা ওভার তো হতেই পারে, সমস্যা কী! কিন্তু যাঁরা খেলাটাকে ভালোভাবে দেখেন, তাঁরা বুঝতে পারেন সন্দেহজনক কিছু একটা হচ্ছে।’
কারা, কেন করছেন এসব
কেন করছেন, তার উত্তর তো একটাই—টাকার লোভে। ভালো খেলেও অনেক সময় যে টাকা পাওয়া যায় না, খারাপ খেললে তার চেয়ে বেশি টাকা! আর এখন যেহেতু এসব ক্রিকেটারের ভালো খেলার দিনও গত হয়ে গেছে, খারাপ খেলেই না হয় ‘আয়’টা এল!
এই গুটিকয় ক্রিকেটার এটাও জানেন যে সবাই তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখেন। কিন্তু প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত যেহেতু শাস্তি হবে না আর ক্রিকেটীয় বাস্তবতায় এসব প্রমাণ করাও কঠিন, সন্দেহ আর অন্যদের আড়চোখে দেখাটাকে তাঁরা গায়েই মাখেন না।
এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত যে নামগুলো সন্দেহের তালিকায় এসেছে, তাঁদের বেশির ভাগেরই ক্যারিয়ার পড়ন্ত বেলায়। কেউ কেউ জাতীয় দলে কখনো খেলেননি বা খেলার সম্ভাবনাও নেই। আবার কেউ কেউ জাতীয় দলে খেললেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের ফর্মও এতটাই পড়তির দিকে যে পরের বিপিএলের ড্রাফটে থাকেন কি না, সেটা নিয়েই সন্দেহ।
ক্রিকেটে আর তেমন ক্যারিয়ার না থাকা এক দল স্থানীয় ও বিদেশি ক্রিকেটার এসব অসদুপায়কেই ‘পেশা’ হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন। স্থানীয়দের মধ্যে এমন সন্দেহের তালিকায় আছেন অন্তত ১২-১৩ জন। তাঁদের মধ্যে দুজন আবার অধিনায়কত্বও করেছেন। বিদেশি ক্রিকেটারের সংখ্যাটা এখন পর্যন্ত ৪-৫ জন।
ফ্র্যাঞ্চাইজি কি জড়িত
কোনো কোনো দুর্বল ফ্র্যাঞ্চাইজি এসবের সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যায়। নির্দিষ্ট দু-একজন ক্রিকেটারকে দিয়ে তারাই নাকি এসব কাজ করায়। ফ্র্যাঞ্চাইজির কাজকর্ম সম্পর্কে ধারণা আছে, এমন একজন এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘অনেক সময় খেলোয়াড়ের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজির চুক্তিই হয় এভাবে, আমি তোমাকে দলে নেব, এত টাকা দেব, আমার হয়ে ওই কাজটা করে দিতে হবে।’
শুধু বিপিএলে নয়, বাংলাদেশের বাইরের অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টেও এভাবে চুক্তি হয় বলে জানিয়েছেন তিনি, ‘বাংলাদেশেরও এমন কিছু ক্রিকেটার দেখবেন, যারা কোথাও খেলার সুযোগ পায় না কিন্তু বিদেশের ওসব টুর্নামেন্টে সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের চুক্তিই হয় এভাবে। একইভাবে বিপিএলেও এ রকম বিদেশি ক্রিকেটার আনা হয়।’
যদি প্রমাণ করতে পারি, ও রকম কিছু হয়েছে, আমরা সেটা লুকাব না, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব না। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।
জাতীয় দলের এক সাবেক অধিনায়ক বলেছেন, বিপিএলকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি, ‘কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি হঠাৎ করে আসে। আসেই এক মৌসুমের জন্য, এভাবে কিছু টাকা কামিয়ে নিতে। খেলোয়াড়ও নেয় সেভাবে, যারা তাদের কথামতো কাজ করবে। লম্বা চুক্তিতে ফ্র্যাঞ্চাইজি না নিলে এর সমাধান হবে না।’
বিসিবি কী বলছে
বিপিএলের সন্দেহজনক ঘটনাগুলো নিয়ে গত দুই-তিন দিনে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রধান রাইয়ান আজাদের সঙ্গে। ব্যস্ততার কারণে তিনি কথা বলার সময় বের করতে পারেননি।
তবে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও বিসিবির পরিচালক নাজমূল আবেদীন বলেছেন, সবকিছুই তাঁদের নজরদারিতে আছে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগ তা খতিয়ে দেখেছে। তবে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নেই বলে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলের সঙ্গে বর্তমানে কুয়ালালামপুরে থাকা নাজমূল আবেদীন প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেছেন, ‘যদি প্রমাণ করতে পারি, ও রকম কিছু হয়েছে, আমরা সেটা লুকাব না, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব না। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।’
সূত্র জানিয়েছে, বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগ এরই মধ্যে একটি দলের ম্যানেজার ও অধিনায়ককে তলব করেছে। তবে এটা নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি নাজমূল আবেদীন।
বিপিএলে এখন পর্যন্ত সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন কি না—জানতে চাইলেও তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারব না। কিন্তু যেটা নিয়েই সন্দেহ হবে, সেটাকেই আমরা ট্র্যাক করব। কোনো ঘটনা প্রমাণ করতে না পারলেও রেকর্ডে রাখব। তাহলে সবই যে আমাদের নজরে আছে, এসবের সঙ্গে জড়িতরা তা বুঝতে পারবেন।’