পাকিস্তানের হৃদয় ভেঙে ১ উইকেটের জয়ে শীর্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা

জয় নিশ্চিত হওয়ার পর কেশব মহারাজের উল্লাসরয়টার্স

আগের ২৫টি ম্যাচে দেখা যায়নি এমন। অবশেষে বিশ্বকাপের হারিয়ে যাওয়া জমজমাট লড়াইয়ের সে রোমাঞ্চ ধরা দিল চেন্নাইয়ে। পাকিস্তানের হৃদয় ভেঙে সেখানে ১ উইকেটের জয় পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা—ভারতকে টপকে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষেও চলে গেছে তারা। অন্যদিকে খাদের কিনারে থাকা পাকিস্তান ধাক্কা খেয়েছে আরেকটি।

২৭১ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করা দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৯ বলে ৪ উইকেট হাতে রেখে দরকার ছিল ২১ রান, পরিষ্কারভাবে এগিয়ে ছিল তারাই। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম কনকাশন-বদলি হিসেবে আসা উসামা মিরের বলে ৯১ রান করা এইডেন মার্করামের আউটে বদলে যায় চিত্রটা, নাটকের শুরুটাও বলা যায় তখন থেকে। ঠিক পরের ওভারে এসে জেরাল্ড কোয়েৎজিকে আউট করে পাকিস্তানকেই ফেবারিট বানিয়ে দেন শাহিন শাহ আফ্রিদি।

কিন্তু লুঙ্গি এনগিডি ও কেশব মহারাজের জুটি নিজের শেষ ওভারে ভাঙতে পারেননি আফ্রিদি, আসে মাত্র ২ রান। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার তখন রান তোলার চেয়েও টিকে থাকাই বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। আর ফুরিয়ে আসছিল পাকিস্তান পেসারদের ওভার। কিছুক্ষণ থেকেই ক্র্যাম্পে ভোগা মোহাম্মদ ওয়াসিমের ওভারও পার করেন দুজন। এরপর হারিস রউফ, প্রথম ৯ ওভারে যিনি ছিলেন খরুচে। এনগিডি সুযোগ দেন; ফলো-থ্রুয়ের গতিপথ বদলে, সামনে ডাইভ দিয়ে প্রায় মাটি থেকে বাঁ হাতে তুলে সে ক্যাচটি নেন রউফ। শেষ বলে রউফ পেতে পারতেন শেষ ব্যাটসম্যান তাব্রেইজ শামসির উইকেট, কিন্তু এলবিডব্লিউর রিভিউ পাকিস্তানের কাজে আসেনি উইকেটে আম্পায়ার্স কল হওয়াতে।

দুর্দান্ত ক্যাচ হারিস রউফের
রয়টার্স

আফ্রিদির পর রউফের ওভার শেষ, পেসার হিসেবে বাকি ছিল শুধু ওয়াসিমের ওভার। সে ওভারে ৩ রান তুলে টিকে থাকেন কেশব মহারাজ ও শামসি। মোহাম্মদ নেওয়াজের দিকে ঝুঁকতে হয় বাবরকে, তাঁর প্রথম বলে সিঙ্গেল নেন শামসি। দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪ রান, মহারাজ লেগ সাইডে পেয়ে গ্যাপ দিয়ে মারেন সেটিই। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের পর আরেকটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ওভার করতে এসে তাতেই হৃদয়ভঙ্গ হয় নেওয়াজের। আর দক্ষিণ আফ্রিকা মাতে উল্লাসে, যাতে মিশে থাকে বার্তা—রান তাড়া করে চাপকে জয় করেও জিততে পারে তারা!

এর আগে একটি ম্যাচ পরে ব্যাটিং করতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে, সেটিই হেরেছিল তারা। আফ্রিদির প্রথম ওভারে চারটি চার মেরে কুইন্টন ডি কক বার্তা দিয়েছিলেন, রান তাড়ায় কীভাবে এগোতে চান তাঁরা। অবশ্য আফ্রিদির পরের ওভারে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন আগের দুই ম্যাচে শতক করা ডি কক ১৪ বলে ২৪ রান করে। ধীরগতির শুরু করা টেম্বা বাভুমাও এগিয়ে এসেছিলেন মোহাম্মদ নেওয়াজের এক ওভারে টানা তিন চার মেরে, কিন্তু ওয়াসিমকে তুলে মারতে গিয়ে প্রথম পাওয়ারপ্লের ১ বল বাকি থাকতে ফেরেন তিনিও।

রেসি ফন ডার ডুসেনের সঙ্গে এইডেন মার্করামের ৫৪ রানের জুটি অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে এগিয়ে নেয় ভালোভাবেই। প্রথম ওভারেই ফিল্ডিং করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়া শাদাব খানের কনকাশন বদলি হিসেবে আসা উসামা মির ভাঙেন সে জুটি, রেসি ফন ডার ডুসেনকে এলবিডব্লু করে। পরপর ২ ম্যাচে একই আউট হলেন ফন ডার ডুসেন।

ফর্মের তুঙ্গে থাকা হাইনরিখ ক্লাসেনকে বেশিক্ষণ টিকতে দেননি মোহাম্মদ ওয়াসিম। ডিপ থার্ডম্যানে ক্লাসেন ক্যাচ দিয়ে ফিরলে চাপেই পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। মার্করাম ও মিলারের জুটিতে নিয়ন্ত্রণ অবশ্য আবারও নেয় তারা। মিলারকে আউট করে ৬৯ বলে ৭০ রানের সে জুটি ভাঙেন শাহিন শাহ আফ্রিদি, লেংথ বলে কট বিহাইন্ড হন ২৯ রান করা মিলার।

সে উইকেটে ক্রিজে আসে শেষ স্বীকৃত জুটি—মার্করাম ও ইয়ানসেন। হারিস রউফের বলে পয়েন্টে ক্যাচ দেওয়ার আগে ইয়ানসেন অবশ্য ১৪ বলে ২০ রানের ইনিংসে আঘাত করেন পাকিস্তানকে। কিন্তু মার্করাম ছিলেন পাকিস্তানের বড় বাধা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বড় আশা হয়ে। ভাগ্যকেও পাশে পেয়েছেন মার্করাম, একাধিকবার রানআউটের হাত থেকে বেঁচেছেন, বেশ কয়েকটি ক্যাচ অল্পের জন্য গেছে ফিল্ডারের নাগালের বাইরে দিয়ে। তিনি শেষ করে আসতে না পারলেও দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য ঠিকই মেতেছে উল্লাসে।

শামসি ও মহারাজের শেষ উইকেট জুটিতে জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা
রয়টার্স

এমনিতে উইকেট ধরে রেখে ইনিংস গড়ার যে ধাঁচ, টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া পাকিস্তান আজ ঠিক সে পথে এগোয়নি। প্রথম ৫ ব্যাটসম্যানের কেউ শুরুতেই ফিরেছেন, কেউ ভালো শুরু পেলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি, কেউ অর্ধশতকের পরই আটকে গেছেন। তবে সবাই থেমেছেন প্রশ্নবিদ্ধ শট নির্বাচনের পর।

দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকেই মার্কো ইয়ানসেন ফেরানোর পর বাবর ও রিজওয়ানের জুটিতে আসে ৪৮ রান। জেরাল্ড কোয়েৎজির শর্ট বলে ক্যাচ দেওয়ার আগে রিজওয়ান ২৭ বলে করেন ৩১ রান। ইফতিখার আহমেদ চারে আসেন, কিন্তু সেটি ঠিক কাজে আসেনি। বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার শামসির গুগলি পড়তে না পেরে ক্যাচ দেন তিনি।

মাঝের ওভারে শামসিই সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন পাকিস্তানিদের। যাঁর পরের শিকার বাবর। আরেকবার ৫০ ছুঁলেও এর পরপরই শামসিকে সুইপ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন পাকিস্তান অধিনায়ক। ৩০ ওভারের আগেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা পাকিস্তানকে তখন চোখ রাঙাচ্ছিল ২০০-এর নিচে অলআউট হয়ে যাওয়াও। শাদাব ও শাকিলের পাল্টা-আক্রমণ অবশ্য ৩০০ রানের সম্ভাবনাও তৈরি করে। ৪৩ রান করা শাদাবের পর ৫২ রান করা শাকিল দ্রুতই থামলে সে আশা মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। মোহাম্মদ নেওয়াজ ২৪ রানের ইনিংসে টানার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ইনিংসের ২৫ বল বাকি থাকতে ইয়ানসেনের তৃতীয় শিকার তিনি। এর আগেই আফ্রিদিকে আউট করে নিজের চতুর্থ উইকেটটি পান শামসি। ১১ রানের মধ্যে শেষ ৩ উইকেট হারায় পাকিস্তান।