রশিদের ‘কমন রুমের’ দরজা সব সময়ই খোলা

রশিদ খান আফগানিস্তান দলের সবার জন্যইছবি: শামসুল হক

ড্রেসিংরুমে জার্সি বদলাচ্ছিলেন রশিদ খান। হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় চোখ পড়তেই স্থির হয়ে যান হতভম্ব আফগান লেগ স্পিনার। নিজের চোখ জোড়াকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর।

হবে কীভাবে! টস হয়ে গেছে, একটু পর শুরু হবে বাংলাদেশের বিপক্ষে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ওয়ানডে। অথচ আফগানিস্তান দলের যে খেলোয়াড় তালিকাটা এই মাত্র টেলিভিশনে ভেসে উঠল, তাতে নাম নেই রশিদ খানের! বিস্মিত রশিদ বলে ওঠেন, ‘আমার নাম কোথায়!’ পরক্ষণে মুজিব–উর রহমানকে ডেকে বলেন, ‘মুজিব, তোমার নামও তো নেই! আমরা কি খেলছি না?’

কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল পুরো ড্রেসিংরুমেই। তবে কি ম্যাচের জন্য যে একাদশ ঠিক হয়েছিল, সেটা কোনোভাবে বদলে গেল! কিন্তু কে বদলাবে দল?

চট্টগ্রামের হোটেলে রশিদের কক্ষটি যেন ‘কমন রুম’
ছবি: সংগৃহীত

ভুলটা ছিল টেলিভিশন সম্প্রচারকারীদের। দ্বিতীয় ওয়ানডের খেলোয়াড় তালিকা দেখাতে গিয়ে ভুলে তারা দেখিয়ে ফেলেছিল মিরপুরে হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ–আফগানিস্তান একমাত্র টেস্টের খেলোয়াড় তালিকা। রশিদ, মুজিবসহ ওয়ানডে দলের অন্য যাঁরা টেস্ট দলে ছিলেন না, স্বাভাবিকভাবে তাঁদের নাম ছিল না সেখানে। ভুলটা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই সংশোধন করে ফেলা হয়। বিভ্রান্তি কেটে গিয়ে স্বস্তি ফিরে আসে আফগান ড্রেসিংরুমেও।

রশিদ খান মাঠের বাইরে এমনই
ছবি: সংগৃহীত

আফগানিস্তান দলের জন্য বড় এক স্বস্তি আসলে রশিদ খান নামটাই। মাঠে যেমন, মাঠের বাইরেও তেমন। দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা হয়েও ছোট–বড় সবার সঙ্গে দিলখোলা সম্পর্ক তাঁর। রাত ছাড়া হোটেলে রশিদের রুমের দরজা নাকি কখনোই বন্ধ হয় না। সব সময়ই খোলা এই একটা রুমে যে যখন ইচ্ছা ঢুকে পড়তে পারে।

চট্টগ্রামের র‌্যাডিসন ব্লু হোটেলেও রশিদের রুম হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান দলের ‘কমন রুম’, বাংলাদেশ দলে যেটা একসময় ছিল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার রুম। রশিদের রুমে এমনকি যখন–তখন ঢুকে পড়ার অনুমতি আছে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া দলের টিম বয়েরও।

দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই বাইরে থেকে খাবার এনে খান। কাবাব–রুটি আর বিরিয়ানিই বেশি পছন্দ তাঁদের। রশিদ খানের ‘কমন রুম’ তখন আবার হয়ে যায় ‘ডাইনিং রুম।’ সুইট রুম যেহেতু, জায়গার অভাব নেই। সবাই মিলে ফ্লোরে বসেই চলে লাঞ্চ–ডিনার, আড্ডা এবং লুডু খেলাও।

আরও পড়ুন
আইপিএলের সময়ও একই দৃশ্য দেখা যেত
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

লুডুর কথাটা আলাদা করেই বলতে হয়। বাংলাদেশেও প্রচলিত এই খেলা বেশ জনপ্রিয় আফগানিস্তানে। আফগানদের অবসরের প্রিয় বিনোদন বলতে পারেন। চট্টগ্রামে এসে যেহেতু খেলা–অনুশীলন ছাড়া বাকি সময়টা খেলোয়াড়েরা বলতে গেলে হোটেলেই কাটাচ্ছেন, সবাই লুডু খেলেই পার করে দেন অবসর।

গতকাল অবশ্য দু–একজন টুকটাক শপিংয়ে বেরিয়েছিলেন। হোটেল লবিতে বসে দেখা গেল তাঁদের ব্যাগ হাতে শপিং থেকে ফেরার দৃশ্য। তবে বরাবরের মতো রশিদ ছিলেন তাঁর রুমে। খাওয়াদাওয়াটাও যেহেতু রুমেই হয়, বড়জোর হোটেলের জিম এবং খেলা–অনুশীলনের দিন মাঠে; এর বাইরে রশিদের আর কোথাও যাতায়াত নেই।

আরও পড়ুন
রশিদ দলের অভিভাবকও
ছবি: শামসুল হক

ভাঁজ করা বড় এক লুডুঘর রশিদ তাঁর ব্যাগেই বয়ে বেড়ান সব সময়। শতরঞ্জির মতো সেই লুডুঘর ফ্লোরে বিছিয়ে চলে খেলা। বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের সমান্তরালে রশিদের রুমে নাকি চলে লুডুর টুর্নামেন্টও!

তবে আড্ডা, গল্প, লুডু—সবই সন্ধ্যা সাতটা–সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। দলীয় শৃঙ্খলায় সচেতন আফগান ক্রিকেটাররা এরপরই ঢুকে যান যে যাঁর রুমে। রুমের বাতি বন্ধ রাত আটটার মধ্যে। মাঠে দিবারাত্রির ম্যাচ থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

আফগান ক্রিকেটারদের নিয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয়। বিশ্বের অনেক বড় ক্রিকেটারের সাক্ষাৎকারও অনেক সময় পাওয়া যায়, কিন্তু এই দলটার ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকার পেতে অনুমতি আনতে হয় দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে, প্রয়োজনে সেই অনুমতির জন্য দলের পক্ষ থেকে দেশেও যোগাযোগ করতে হয়।

আরও পড়ুন
রশিদ খানের আরেক দিন
ছবি: সংগৃহীত

নিয়মটা এমন কঠিন করে রাখার মূল উদ্দেশ্য ক্রিকেটারদের বিব্রত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। আফগান ক্রিকেটারদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে তেমন সড়গড় নন। আর বিদেশি সাংবাদিকেরা যেহেতু ইংরেজিতেই প্রশ্ন করবেন, সে ঝামেলা থেকে তাঁদের দূরে রাখে টিম ম্যানেজমেন্ট। এ ছাড়া আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রায়ই তাঁদের দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও প্রশ্ন চলে আসে। সেই স্পর্শকাতর প্রশ্ন থেকে তাঁদের নিরাপদ রাখাটাও সাক্ষাৎকার না দেওয়ার আরেকটি কারণ।

রশিদ, মোহাম্মদ নবীর মতো দু–চারজন অবশ্য ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক আলাপে তাঁদের বেলায়ও বিধিনিষেধ আছে, তবে ইংরেজি বলায় সমস্যা নেই। তারপরও রশিদ–নবীসহ আফগান ক্রিকেটাররা প্রচারের আলো থেকে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করেন। বাইরের অস্বস্তিতে পড়ার চেয়ে তাঁদের কাছে বরং রশিদের ‘কমন রুমের’ স্বস্তিটাই বেশি উপভোগ্য।