বাংলাদেশের আশায় থাকলে সেই সমর্থকের কি আর বিয়ে হবে
বাংলাদেশের ইনিংসে প্রথম ওভারের খেলা চলছিল। প্রথম চার বলে উঠেছে ৯ রান। বেশ ভালো একটা শুরু। ঠিক তখনই ক্যামেরা ধরা হলো গ্যালারিতে। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে গ্যালারিতে বসে এক সমর্থক মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডটি উঁচিয়ে ধরলেন। তাতে লেখা, ‘বাংলাদেশ বিশ্বকাপ না জেতা পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না’।
আরব আমিরাতের কাছে কাল রাতে বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য হার নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়া চলছে। কোথায় হারল, কেন হারল—এসব ক্রিকেটীয় কারণ আর কি! খুঁজলে এমন অনেক কারণই হয়তো পাওয়া যাবে। তবে এই কারণগুলোর পেছনের কারণ সম্ভবত মনস্তাত্ত্বিক।
বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা ম্যাচের শুরুতেই ‘ধনুর্ভঙ্গ’ পণ নিয়ে গ্যালারিতে বসে থাকা সেই ভক্তকে দেখে সম্ভবত ম্যাচের কলাকৌশল পাল্টেছেন। কারণ, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সমর্থকেরা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। নইলে পারফরম্যান্স ক্রমেই নিম্নমুখী হওয়ার পরও কোন দেশের সমর্থক সাহস করে দলের বিশ্বকাপ জয় পর্যন্ত নিজেই নিজের বিয়ে আটকে রাখতে পারেন!
শুধু বাংলাদেশের সমর্থকেরাই পারেন।
এখন যে সমর্থক দলের জন্য নিজের এতটা নিংড়ে দিতে পারেন, তাঁর জন্য কি দলের কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে এবং বাংলাদেশ দল ঠিক সেটাই করেছে। গ্যালারির সেই সমর্থকের চোখের ‘ছানি অপারেশন’ করে বাংলাদেশ দল তাঁকে বাস্তবতাটুকু বুঝিয়ে ছেড়েছে—যেন তিনি খামোখাই অপেক্ষা করে নিজের যৌবনকে জলাঞ্জলি না দিয়ে বিয়েটা সেরে নেন। কিংবা উল্টোভাবেও ভাবা যায়। বাংলাদেশ দলে বেশ কজন বিবাহিত ক্রিকেটার আছেন। বিয়ের মতো ‘দিল্লি কা লাড্ডু’ খেলে কী হয়, সেটা পৃথিবীর আপামর বিবাহিত পুরুষের মতো তাঁরাও জানেন, ‘বিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাস, যার প্রথম পরিচ্ছেদেই নায়কের মৃত্যু ঘটে।’
পৃথিবীর কোনো দলই তাঁদের সমর্থকদের ‘মৃত্যু’ চাইবে না, সেটা যেমন মরণই হোক। বাংলাদেশ দলও তাই সম্ভবত শুধু সেই সমর্থককে বাঁচাতে টেস্ট খেলুড়ে দেশ হয়েও সহযোগী দেশের কাছে হেরে বসেছে। চাইলে এই হারের হাজারো ক্রিকেটীয় কারণ আপনি খুঁজে বের করতে পারেন, যার শিরোনাম হবে একটাই—বাজে খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কেউ হয়তো খোঁজ নেবে না, কাল হারের পর সেই সমর্থক বাড়ি ফিরে বিষণ্নবদনে বিছানায় নিজেকে ভূপাতিত করে হয়তো ভেবেছেন, সহযোগী দলের কাছেই এমন হার! যাহ, বিয়েই করব না!
আসলে যে সমর্থক বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয় পর্যন্ত বিয়ে না করার পণ করতে পারেন, তিনি যে এই দলের জন্য বাকি জীবনে বিয়ে না–ও করতে পারেন, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য। লিটন দাসের দল ঠিক এটা ভেবেই সম্ভবত সহযোগী দলের কাছে হেরেছে। এ ছাড়া আসলে আর কোনো মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি নেই। কারণ ক্রিকেটীয় যুক্তি বলে, আরব আমিরাতের বিপক্ষে শুধু দাপুটে জয়ই হতে পারত প্রত্যাশিত ফল। সেখানে দুই শ করেও ম্যাচ শেষ ওভার পর্যন্ত চলে যাওয়া, বোলারদের থরহরি কম্পমান দশা—এই ম্যাচ না হেরে বাংলাদেশ যদি কষ্টকর জয় তুলে নিত সেটাও তো এক অর্থে হারই।
কিন্তু এই হারেও বাংলাদেশ দল এমন দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে যা টেস্ট খেলুড়ে অন্য দলগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে। সমর্থকের জন্য ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ কৌশলে খেলে হারের এমন নজির সত্যিই অনন্য।
যেমন ধরুন, আগে ব্যাট করে ২০৫ রান তুলেছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে দুই শর ওপাশের স্কোর সব সময়ই জেতার মতো। অর্থাৎ কেউ বলতে পারবে না ব্যাটিংয়ে খারাপ করেছে বাংলাদেশ দল। পরের প্রশ্নটিই হবে যেহেতু এই রানও তাড়া করে জিতেছে আরব আমিরাত—তাহলে নিশ্চয়ই বোলিং খারাপ হয়েছে? তা তো বেশ কিছুটা হয়েছেই, কিন্তু এর পেছনেও একটি সাধারণ ক্রিকেটীয় যুক্তি হলো, ক্রিকেট গোল ‘গুটি’র (বল) খেলা, গোলাকার বস্তু হাতের মুঠোয় সব সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না, যেটার পেছনে ম্যাচ শেষে শিশিরের ভূমিকাকে দুষেছেন অধিনায়ক লিটন। একদম নির্ভেজাল যুক্তি।
তবে ম্যাচটি দেখে থাকলে বাজে বোলিং নিয়ে ভাবার আগে হারের কারণ হিসেবে কিছু দৃশ্যপট ও হিসাব মাথায় আসে। যেমন ধরুন, আমিরাতের ইনিংসে প্রথম বলে স্লিপে ওপেনার মুহাম্মদ জোহাইবের ক্যাচ মিস। একটু কঠিন ক্যাচটি নাজমুলের হাত ফসকে গেলেও তখনো পরিষ্কার বোঝা যায়নি বাংলাদেশ দল আসলে কী লক্ষ্য নিয়ে কার জন্য খেলছে। ব্যাপারটা একটু আঁচ পাওয়া গেল মুহাম্মদ ওয়াসিম ৬৪ রানে লং অফে ক্যাচ তোলার পর। বোলারদের বাজে বোলিংয়ে আমিরাত ততক্ষণে ১১.৪ ওভারে ১১৩/২ তুলে ফেলেছে। পরের বলে লং অফ থেকে দৌড়ে এসে বলের নিচে দাঁড়িয়ে ওয়াসিমের ক্যাচ ছাড়লেন বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার তাওহিদ হৃদয়। ক্যামেরাম্যান কী বুদ্ধিমান, ওই ক্যাচ মিসের পর প্লাকার্ড দেখানোর সমর্থককেও একবার ক্যামেরায় ধরলেন। তখনই আসলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু সেটা পারা যাচ্ছিল না কারণ ওই ওভার শেষে ৪৮ বলে ৯২ দরকার ছিল আমিরাতের। অর্থাৎ জয়ের ভালো সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের।
সে সম্ভাবনা বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টাটা পরিষ্কার বোঝা গেল ১৬তম ওভারে নাহিদ রানার শেষ বলে সগীর খানের আকাশে তোলা ক্যাচ লিটন, হৃদয় ও রিশাদ মিলেমিশে কীভাবে মিস করলেন সেটা বোধগম্য ছিল না। কিন্তু আমিরাত তখনো ২৪ বলে ৪৫ রানের দূরত্বে থাকায় সমর্থকের ভালো চেয়ে জয় বিসর্জনের এই ‘চেষ্টা’র বিষয়টি সরাসরি বলাও যাচ্ছিল না।
যেমন ধরুন, ১৯ম ওভারের শেষ বলে বোলার শরীফুল ইসলামের সেই থ্রো। ৭ বলে আমিরাতের দরকার ছিল ১৭। উইকেট পড়েছে ৭টি। একে তো সহযোগী দেশ, বড় দলের বিপক্ষে এমন চাপের ম্যাচ শেষ দিকে এসে কীভাবে বের করতে হয়, সেই অভিজ্ঞতায় আমিরাতের ঘাটতি থাকাই স্বাভাবিক। বুদ্ধিমত্তার অবিশ্বাস্য ব্যবহারে সেটুকু পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শরীফুল। যেখানে ১ রান হয়, ওভার-থ্রো করে শরীফুল সেখানে দিয়েছেন ৪—মানে মোট ৫ রান। শরীফুলের কাছে ওই থ্রোয়ের ক্রিকেটীয় যুক্তিও আছে, মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে করা থ্রো স্টাম্পে লাগলেই রানআউট হতো! ব্যাকআপ দেওয়ার কেউ না থাকলে এখন তাঁর আর কী করা! পাল্টা যুক্তি উঠতে পারে, ব্যাকআপ যে ছিল না সেটা তাঁর চোখের সামনেই স্পষ্ট ছিল। ঠিক এ জায়গাতে এসেই খটকা লাগে। কিসের খটকা, কার জন্য চোখের সামনে স্পষ্ট পরিস্থিতি না দেখা—সেটা আগেই বলা হয়েছে।
তবে খটকাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে ২০তম ওভারের পঞ্চম বলে। ২ বলে ২ রান দরকার ছিল, তানজিমের ডেলিভারিটি ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ঠেলে হায়দার ও মতিউল্লাহ যখন ২ রানের জন্য ছুটলেন। সে মুহূর্তে ফিল্ডার হৃদয় বলটি হাতে নিয়ে কেন তৎক্ষণাৎ থ্রো করলেন না—এই প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠছে কাল রাত থেকেই।
ক্রিকেটীয় যুক্তিতে উত্তর হতে পারে ‘ব্রেইন ফেড’, যেটা শরীফুলের ওভার-থ্রোতেও বলা যায়। কিন্তু যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ দল কি আসলে টেস্ট খেলুড়ে দেশের মতো ক্রিকেট খেলেছে সহযোগী দেশের বিপক্ষে?
উত্তর আমরা সবাই জানি। আর জানি বলেই সান্ত্বনা হিসেবে সেই সমর্থককে টেনে আনতে হচ্ছে। নইলে শেষ ওভারে তানজিমের বুকসমান উচ্চতার ফুল টসে নো, নাহিদ রানার প্রথম ওভারে পরপর দুটি নো—এসবের আসলে কোনো ব্যাখ্যা হয় না। হ্যাঁ, অধিনায়ক লিটন ম্যাচ শেষে শিশির পড়ার দায় দিয়েছেন। অর্থাৎ শিশিরের কারণে বল গ্রিপ করতে বোলারদের অসুবিধা হয়েছে। ধরে নেওয়া যাক, সে জন্যই তানজিম-নাহিদদের হাত থেকে বল ছুটে গিয়ে ফুল টস এবং নো হয়েছে।
কিন্তু এই যে প্রতিপক্ষের কন্ডিশন, শিশির—এসব কিছুর মোকাবিলা করার দক্ষতাটুকুই তো বছরের পর বছর ধরে চর্চা করা হচ্ছে। আমিরাতের বিপক্ষে হারে টেস্ট খেলুড়ে দেশের অধিনায়কের শিশিরকে দায় দেওয়ার ব্যাপারটি তাই যদি অবিশ্বাস্য লাগে, তবে ওই সমর্থকের জন্য বাংলাদেশ দলের খেলার যুক্তিটি তার চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এই কথার পেছনে যুক্তি আছে আরও।
২০২৩ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তানজিমই বলেছেন, ‘ছয় বলে ছয়টা ইয়র্কার মারতে পারি।’ সেই তানজিম কাল শেষ ওভারে দিয়েছেন ফুল টস। শিশিরের জন্য বল হাত ফসকে গেছে? মাঠে কিন্তু বেশির ভাগ ফিল্ডারের কাছে রুমাল থাকে। শিশির পড়লে বলটা রুমাল দিয়ে মুছে বোলারের হাতে তুলে দেন ফিল্ডাররা। আর ক্রস সিম নামে একটি গ্রিপও আছে, যেটায় অন্তত শিশিরে বল ভালোভাবে হাতে আটকানো যায়। তাহলে?
তাহলে আসলে উত্তর ওই একটাই। সমর্থকের ওই প্ল্যাকার্ড দেখার পর বাংলাদেশ দল আসলে একজনের জীবন বাঁচানোর মতো অনেক বড় একটি লক্ষ্য অর্জন করতে সহযোগী দেশের বিপক্ষে সামান্য একটি জয় বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, খেলার চেয়ে জীবন বড়। ধন্যবাদ বাংলাদেশ দল। সেই ভক্ত যদি দলের বার্তা বুঝে থাকেন তাহলে ভালো কথা। আর না বুঝলে পরিষ্কার করে বলতেই হয়, বাংলাদেশ দলের আশায় থাকলে বিয়েটা সম্ভবত তাঁর কপালে নেই।