‘বিলিভ’ ছিল ওয়ালপেপারে, তাই খলনায়ক হতে হতে নায়ক সিরাজ

ভারতের ওভাল টেস্ট জয়ের নায়ক মোহাম্মদ সিরাজ। ইংল্যান্ডের শেষ উইকেটটি নেওয়ার পর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ‘সিউ’ উদ্‌যাপনএএফপি

প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার করা আগের ওভারে গাস অ্যাটকিনসনের ব্যাটিং নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলেন মোহাম্মদ সিরাজ। টেনে লেগে মারতে গিয়ে ব্যাটে পাননি, অফ স্টাম্পের বাইরে নিচু ডেলিভারিও ব্যাটে লাগাতে পারেননি। ৮৬তম ওভারে সিরাজ প্রথম বলটি করার আগেই তাই নিশ্চয় মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ইয়র্কার লেংথে বল করতে হবে, তাহলেই হয়তো গতকালের ক্যাচ মিসের প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব!

আরও পড়ুন

ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৭ রান,ভারতের ১ উইকেট। ওভাল টেস্টের সমীকরণ যখন এমন সুতোর দোলাচলে, তখন ওই (৮৬তম) ওভারে বোলিংয়ে এলেন সিরাজ। তাঁর ইয়র্কার লেংথের কাছাকাছি ফুল টস বলটি আগের ওভারের অভ্যাসমতোই লেগ সাইডে টানতে গিয়ে ব্যাটে পেলেন না অ্যাটকিনসন। ব্যস, তাতেই স্টাম্প ছত্রখান এবং তাতেই সিরাজের শাপমোচন! দুই হাত প্রসারিত করে উইকেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ‘সিউ’ উদ্‌যাপন করে হাসলেন সিরাজ। ততক্ষণে পাগলপারা দৌড়ে ছুটে এসেছেন তাঁর সতীর্থরা। ওভালের ভরপুর গ্যালারিতে করতালির বৃষ্টি। সিরাজ ভিজলেন তাতে, ঠিক যেভাবে রোমের কলোসিয়ামে একসময় গ্ল্যাডিয়েটররা ভিজতেন!

প্রায়শ্চিত্তের পর সিরাজ। ওভালে ভারতের জয় নিশ্চিতের পর
এএফপি

জয়ের জন্য ৩৭৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে গতকাল ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৫তম ওভারে ব্রুকের সহজ ক্যাচকে ছক্কা বানিয়ে দেওয়ার ভুল করেছিলেন সিরাজ। তখন ১৯ রানে অপরাজিত ব্রুক সেই ইনিংসকে টেনে নিয়ে যান ১১১ পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই গতকাল রাতে অনুশোচনায় সিরাজের ঘুম হওয়ার কথা নয়। ক্যাচটি ধরে সিরাজ সীমানায় পা না রাখলে তো এই ম্যাচ চতুর্থ দিন শেষে ইংল্যান্ডের জন্য ৩৫ রান ও ভারতের জন্য ৪ উইকেট নেওয়ার সমীকরণে নেমে আসত না। আজ পঞ্চম দিনের শুরুতে এই সমীকরণে বিশ্লেষকদের চোখে ইংল্যান্ডই ছিল এগিয়ে। কিন্তু হার্শা ভোগলের ওই কথাটি সবাই সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন, টেস্ট ক্রিকেট হলো জীবনের মতো, দ্বিতীয় সুযোগ মেলেই।

আরও পড়ুন

সিরাজ সেই সুযোগটাই পেয়েছিলেন আজ ৮৬তম ওভারে। দুই হাতে তা গ্রহণ করে ওভালের গ্যালারির সামনে স্টাম্প ও ম্যাচের বল হাতে সতীর্থদের সঙ্গে সিরাজ যখন ল্যাপ অব অনার দিচ্ছিলেন, তখন অনেকের মনেই একটি ভাবনা আসতে পারে, পাঁচ টেস্টের এই সিরিজে মাঠে ২৫টি দিনই জমজমাট লড়াই শেষে ফল নির্ধারিত হলো শেষ দিনে। আর যাঁর মাধ্যমে সেই ফলটা নির্ধারিত হলো, সেটা তাঁর জন্য আবার শাপমোচনও। আহা, এটাই তো টেস্ট ক্রিকেট—যে আনন্দের গভীরতার কোনো তুলনাই হয় না!

সিরাজ দর্শকদের সেই গভীরতার তলটা পাইয়ে দিয়েছেন স্রেফ নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে। ম্যাচ শেষে ধারাভাষ্যকার দিনেশ কার্তিককে বলেছেন সে কথা। মাইক্রোফোন হাতে কার্তিক বলেছেন, ‘তার মতো তরুণের এই চাপের মধ্যে পারফর্ম করতে কী দরকার ছিল, এটা জানতে চাওয়ার পর সে (সিরাজ) বলেছে, নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছে। তার ফোনের ওয়ালপেপারে লেখা আছে “বিলিভ”, সে এটাই মাঠে ফলানোর চেষ্টা করেছে।’

দলকে জেতানোর পর সিরাজকে এমন বাঁধভাঙা উদ্‌যাপনেই মানায়
এএফপি

কার্তিককে সিরাজ এ নিয়ে কী বলেছেন, সেটা আরও ভালোভাবে জানা গেল পুরস্কার বিতরণীতে। সিরাজের মুখেই শুনুন, ‘আজ ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হয়েছে এটা সম্ভব। গুগল থেকে একটি ছবি (ফোনে) ডাউনলোড করেছি, যেখানে লেখা “বিলিভ”...লর্ডসে হৃদয় চূর্ণ হয়েছিল। জাড্ডু (রবীন্দ্র জাদেজা) ভাই বলেছিলেন, নিজের শক্তির ওপর আস্থা রেখে বাবাকে স্মরণে রাখতে এবং তার জন্য এটা করতে।’

কার্তিক সিরাজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ব্রুকের ক্যাচ ছাড়ার পর কেমন লেগেছে? সিরাজ বলেছেন, ‘সত্যি বলতে, ক্যাচটা ছক্কা হবে এটা ভাবিনি। তবে ওটা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ছিল। হ্যারি ব্রুক তারপরই টি-টোয়েন্টি মানসিকতায় (ব্যাট) করেছে। আমরা তখন একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম।’ শেষ প্রশ্ন হিসেবে সিরাজের কাছে কার্তিক জানতে চেয়েছিলেন, কাল যখন ইংল্যান্ডের স্কোর ৩ উইকেটে ৩০০, তখন কি সিরাজের বিশ্বাস ছিল যে এই ম্যাচ জেতা সম্ভব? উত্তর শুনুন ওভাল টেস্টে মোট ৯ উইকেট নেওয়া সিরাজের মুখেই, ‘হ্যাঁ, সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাসটা ছিল। যেকোনো অবস্থা থেকে ম্যাচ জেতাতে পারি।’

ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৫ রানে ৫ উইকেট পেয়েছেন সিরাজ। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ৮৬ রানে নেন ৪ উইকেট। এই সিরিজে ৫ টেস্টেই খেলে সবচেয়ে বেশি বল করে (১১১৩টি বৈধ ডেলিভারি বা ১৮৫.৩ ওভার) সর্বোচ্চ ২৩ উইকেটও তাঁর। যশপ্রীত বুমরার অভাব এতটুকু বুঝতে দেননি ওভালে। ভারত তো এমন সিরাজকেই দেখতে চায়!