রানাতুঙ্গাদের লিগ এখন কচিকাঁচার মেলা

রেলিগেশন লিগসহ প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ আয়োজনের দাবিতে পেশাদার ক্রিকেটাররা বর্জন করেছেন সিলেটের লিগ। দাবি না মেনে জেলা ক্রীড়া সংস্থা লিগ চালিয়েছে দায়সারাভাবে। ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাঁদের বিরোধে হযবরল অবস্থা জেলার ক্রিকেটের। এ নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব—

সিলেটের ক্রিকেটারদের আড্ডায় একটা ম্যাচের কথা প্রায়ই আসে। ১৯৮৮ সালে সিলেট ক্রিকেট লিগে জিমখানা-অনির্বাণের ম্যাচে মাঠভর্তি দর্শকের সামনে অনির্বাণ প্রথমে ব্যাট করে ২১২ রান করেছিল। সেই ম্যাচ হয়েছিল টাই। তবে ম্যাচটা এখনো স্মরণীয় সে কারণে নয়। সেই ম্যাচ এখনো আলোচনার উপজীব্য; কারণ, সেদিন অনির্বাণের হয়ে খেলেছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, যাঁর নেতৃত্বে পরে বিশ্বকাপও জিতেছে শ্রীলঙ্কা। জিমখানা দলে বিদেশি ক্রিকেটার না থাকলেও ছিলেন তখনকার বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার গোলাম ফারুক।

পরে সিলেটের মাঠে খেলে গেছেন শ্রীলঙ্কার রুমেশ কালুভিথারানা, অশোকা ডি সিলভারা। খেলেছেন ভারতের প্রয়াত ক্রিকেটার রমন লাম্বা, অজয় শর্মাও। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা তো এখানকার লিগে নিয়মিতই খেলতেন। গোলাম ফারুক ছাড়াও সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খানদের স্মৃতিতেও এখনো সিলেট লিগের জমজমাট ছবিটা স্পষ্ট। ভালো পারিশ্রমিক ছিল, ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট।

এনামুল হক জুনিয়র, রাজিন সালেহ, অলক কাপালি, তাপস বৈশ্যদের—সিলেটের এই ক্রিকেটারদের সবাই সিলেট লিগ খেলেই জাতীয় পর্যায়ে এসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গত কয়েক বছরেও সিলেটের অনেকে ক্রিকেটার জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু এক খালেদ আহমেদ ছাড়া সবাই বিসিবির বয়সভিত্তিক কাঠামো বা বিকেএসপি থেকে আসা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিলেটের ক্লাব ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় দলে আসা ক্রিকেটার নেই বললেই চলে।

শুধু জাতীয় দলই নয়, জাতীয় ক্রিকেট লিগেও সিলেট বিভাগীয় দল ভুগছে খেলোয়াড়–সংকটে। ব্যাটসম্যানের জন্য হাহাকার কয়েক বছর ধরেই। রাজিন সালেহ, অলক কাপালিদের অবসরের পর কয়েক দিন আগে টেস্ট অভিষেক হওয়া জাকির হাসানই এখন ভরসা। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান জাকের আলীর নামও আসতে পারে এখানে। সঙ্গে জাতীয় দলের একঝাঁক ফাস্ট বোলার মিলেই দলটাকে জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে টিকিয়ে রেখেছেন। ব্যাটসম্যানের সংকট দূর করতে নারায়ণগঞ্জের অমিত হাসানকে কয়েক বছর ধরে সিলেট বিভাগে খেলানো হচ্ছে। স্থানীয় লিগ থেকে এমন কেউ উঠে আসছেন না, যিনি হবেন সিলেট বিভাগের ব্যাটিং–ভরসা।

কারণটা সবারই জানা—স্থানীয় লিগ থেকে ক্রিকেটার উঠে আসার পথ যে বন্ধ! স্থানীয় লিগের নিয়ন্ত্রণ এখন ব্যক্তিবিশেষের হাতে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এখন যেমন সব ক্লাব একই ছাতার নিচে, সিলেটও তাই। লিগে তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, অবনমনও নেই। সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার লিগ খেলে তাই নতুন ক্রিকেটার উঠে আসছে না। অবশ্য লিগের এমন দৈন্যদশা হলেও ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার লোকজনের একাডেমি ব্যবসা ভালোই হচ্ছে।

গ্রিন সিলেট ক্রিকেট একাডেমির কথাই ধরুন। সিলেটের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট একাডেমি, এর মালিক সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহিউদ্দিন আহমেদ। বিসিবির নিয়োগপ্রাপ্ত সিলেট জেলার কোচ রানা মিয়া প্রায় ৮০০ ক্রিকেটারের এই একাডেমিরও কোচের দায়িত্বে। অভিযোগ আছে, গ্রিন সিলেট ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হলে সিলেট লিগে দল পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। রেলিগেশন লিগ যেহেতু নেই, ক্লাবগুলোর দায়িত্ব নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়া হচ্ছে একাডেমিগুলোর হাতে। এই সুযোগে ১৩–১৪ বছর বয়সী খুদে ক্রিকেটাররাও খেলে ফেলছে জেলার ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ১৫ জনের স্কোয়াডে ৭–৮ জন, কোনো কোনো ক্লাবে নাকি ১০–১২ জনও থাকে অনূর্ধ্ব–১৪ বা অনূর্ধ্ব–১৫ পর্যায়ের ক্রিকেটার!

সিলেট কোয়াব ও সিলেট ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক জুনিয়রের প্রশ্ন—বিসিবির কোচ হয়েও তিনি কীভাবে এই অনৈতিক কাজ করেন? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক, ‘এটা উনি কীভাবে করেন? যদি উনি একটু শক্ত হতেন, তাহলে আমাদের ক্লাব ক্রিকেটের এই অবস্থা হয় না।’ রানা মিয়া অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমি তিনটা ক্লাব চালাই। আমার একাডেমির ক্রিকেটার সব ক্লাবেই খেলে। লিগে ১০টা ক্লাব আছে। তাই বলে কি ১০টা ক্লাবই আমি চালাই?’

সেই ক্লাবগুলোতে কারা খেলছে, তা তো বলাই হলো। যে লিগে একসময় খেলে গেছেন দেশি-বিদেশি তারকা ক্রিকেটাররা, সেখানেই এখন বসে কচিকাঁচার মেলা।