তিন ‘অভিষেকের’ ম্যাচে টিকে থাকার লড়াই

টিকে থাকার লড়াইয়ে আজ মাঠে নামবে বাংলাদেশছবি: শামসুল হক

সংবাদ সম্মেলনকক্ষের দেয়ালে ঝুলে আছে একটা ছবি। ছবি না বলে একখণ্ড ইতিহাস বলা ভালো। ১৯৬০ সালের কোনো একদিন। সুটেড-বুটেড স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে বসে কথা বলছেন টেস্টের সাদা পোশাক পরা রিচি বেনো।

উল্টো দিকের দেয়ালে ঝোলানো আরেকটি ফ্রেম। দেয়াল ঘুরে গ্যাবার আরও অনেক টুকরো টুকরো ইতিহাস পেরিয়ে যেতে হবে সেদিকে। সেই ফ্রেমে অবশ্য কোনো ছবি নেই, আছে বাস্তবতা এবং সেই এক টুকরো বাস্তবতাকে গ্যাবার শুরুর সময় থেকে বর্তমান সময়েরও প্রতিনিধি বলতে পারেন।

ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে গ্যাবার উইকেটের এক টুকরো মাটি। উইকেটের ওই অংশটুকু যদিও ২০০০ সালের ১০ জানুয়ারি তুলে আনা, গ্যাবার মাটি যে পেস বোলারদের ঘাঁটি, সেটি তো সেই ১৮৮৫ সাল থেকে আজও সত্যি!

কাল উইকেট দেখে এসেছেন ইয়াসির আলী
ছবি: শামসুল হক

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে আজ প্রথমবারের মতো সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। গ্যাবার মাঠে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম কোনো ম্যাচ, আর তাতে সাকিব আল হাসানের দল দাঁড়াবে দুই রকম অভিষেকের সামনে। একটি তো গ্যাবায় ম্যাচ খেলার অভিষেক, দ্বিতীয় অভিষেক প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। যেকোনো বিশ্বকাপেই এই প্রথম বাংলাদেশ আফ্রিকার দলটির মুখোমুখি হচ্ছে।

মঞ্চ নতুন, দুই দলের লড়াইয়ের আবহসংগীতেও প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সুর। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই জিম্বাবুয়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে নিয়মিত প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশ দল এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে তাদের বিপক্ষেই, সর্বোচ্চ ১২টি জয়ও এসেছে জিম্বাবুয়েরই সঙ্গে। সেদিক থেকে বিশ্বকাপে দলটার বিপক্ষে ‘অভিষেক’ ম্যাচে বাংলাদেশ দলেরই পরিষ্কার ফেবারিট থাকার কথা। আবার এটি বিশ্বকাপের ম্যাচ বলেই থেকে যায় কিছু ‘যদি-কিন্তু’।

বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বেশি ম্যাচ জিতলেও তার আজ মাঠে নামবে সিডনির আগের ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের বৃহত্তম পরাজয়ের হতাশা মনে নিয়ে।

অন্যদিকে জিম্বাবুয়ে তাদের সর্বশেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে ১ রানে। বিশ্বকাপে দুই দলের প্রথম লড়াইয়ের আগে তাই কাউকে বেশি এগিয়ে না রাখাই ভালো। বরং আলোচনায় এই বলে উপসংহার টেনে দেওয়া যায় যে এটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। জিততে পারে যেকোনো দলই।

আরও পড়ুন

তবে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এবারের টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই যে আশার বেলুন উড়িয়ে রেখেছেন, সেটিকে বিশ্বকাপের আকাশে ভাসিয়ে রাখতে আজকের ম্যাচটি জেতা ভীষণ জরুরি তাঁর দলের জন্য। সাকিব বলেছেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কখনো যা করেনি, এবার নাকি তাঁরা তাই করবেন।

তা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আগে কী কী করেনি? প্রথমত, তারা কখনো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়নি, কখনো ফাইনালে ওঠেনি, কখনো সেমিফাইনালেরও দেখা পায়নি এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল কখনো মূল পর্বে একটির বেশি ম্যাচও জেতেনি। কাজেই আজ যদি তারা জিম্বাবুয়েকে হারাতে পারে, তাহলেই সত্যি হয়ে যায় সাকিবের কথা-টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পাবে মূলপর্বে দ্বিতীয় জয়ের দেখা।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কখনো যা করেনি, এবার তাই করতে চেয়েছিলেন সাকিব
ছবি: শামসুল হক

তবে আজ হেরে গেলে সাকিবের প্রতিশ্রুতি পূরণ অসমাপ্তও থেকে যেতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপটাই শেষ হয়ে যেতে পারে আজ। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ মূলত যে দুটি ম্যাচ জয়ের আশা নিয়ে এসেছে, তার একটি ছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। দ্বিতীয়টি আজ। অ্যাডিলেডে ভারত, পাকিস্তানের বিপক্ষ পরের দুই ম্যাচে বাংলাদেশ কোনো জয় পেলে সেটা তো চমকই হবে।

বাংলাদেশ দলের টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট শ্রীধরন শ্রীরাম অবশ্য এখনই অ্যাডিলেডের দিকে তাকাচ্ছেন না। এ মুহূর্তে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া আর কোনো দিকেই তাঁর দৃষ্টি নেই। কাল ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে শ্রীরাম বলছিলেন, ‘আমরা একটা একটা ম্যাচ ধরে এগোতে চাই। এখনই তাই অনেক দূরের বিষয় নিয়ে ভাবছি না। আমাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ জিম্বাবুয়ে।’

পাকিস্তানকে হারানোর আত্মবিশ্বাস আছে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন

পার্থে পাকিস্তানকে হারিয়ে এলেও জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের জন্য অনেকটা নিজেদের মধ্যে খেলা প্রস্তুতি ম্যাচের প্রতিপক্ষের মতোই। দুই দলের মধ্যে এত বেশি খেলা হয়েছে যে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা সম্ভবত এত ভালো করে আর কোনো দলকেই চেনেন না। শ্রীরাম অবশ্য এই প্রসঙ্গে সোজা কথা না বলে জানালেন আজকের ম্যাচে আরেকটি অভিষেকের কথা, ‘আমারও এ রকমই ধারণা। তবে আমি কখনো জিম্বাবুয়ে-বাংলাদেশ লড়াইয়ের অংশ ছিলাম না। এ নিয়ে মন্তব্যও করব না। ছেলেরা প্রস্তুত আছে। তারা তাদের প্রতিপক্ষকে চেনে।’

আউটফিল্ড থাকবে গতিময়। ভালো শট খেলা গেলে এবং ঠিক জায়গায় বল পাঠাতে পারলে এখানে ১৬০-১৭০ রানের ম্যাচই হবে।
শ্রীধরন শ্রীরাম, টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট, বাংলাদেশ দল

বাংলাদেশ দল যেটা চেনে না, সেটা হলো গ্যাবার উইকেট। অন্যের খেলা দেখে এবং অন্যের কথা শুনেই গ্যাবা সম্পর্কে তাদের যা কিছু ধারণা। সেই ধারণার অন্যতম, গ্যাবার উইকেট পেসবান্ধব। উইকেটের পাশাপাশি এ মাঠের আকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারও ব্যাপার আছে।

গতকাল নুরুল হাসান ও ইয়াসির আলীকে নিয়ে ঐচ্ছিক অনুশীলনে এসে উইকেট দেখেছেন শ্রীরাম। দেখে তাঁর মনে হয়েছে, বিশ্বকাপের ম্যাচেও গ্যাবার উইকেট পেসসহায়কই থাকবে, ‘গ্যাবার উইকেটের চরিত্রটা বরাবরের মতোই মনে হচ্ছে। ভালো পেস, বাউন্স থাকবে, বল উঠবে। শুরুর দিকে কিছু মুভমেন্টও থাকতে পারে। আমার মনে হয়, সব মিলিয়ে খুব ভালো ব্যাটিং উইকেটই হবে এটা। আউটফিল্ড থাকবে গতিময়। ভালো শট খেলা গেলে এবং ঠিক জায়গায় বল পাঠাতে পারলে এখানে ১৬০-১৭০ রানের ম্যাচই হবে।’

পেসবান্ধব গ্যাবায় সফলতার হার স্পিনারদেই বেশি। টেস্টে এখানে সর্বোচ্চ উইকেট একজন লেগ স্পিনারের, শেন ওয়ার্ন (১১ টেস্টে ৬৮ উইকেট)। টি-টোয়েন্টিতেও সেখানেও সবচেয়ে বেশি উইকেট (৫টি) অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার।

এমন উইকেটে বাংলাদেশ দল আজ চার পেসার নিয়ে খেলতে নামলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মেহেদী হাসান মিরাজের জায়গায় চতুর্থ পেসার হিসেবে দলে আসতে পারেন ইবাদত হোসেন বা শরীফুল ইসলামের একজন। আবার এমনও হতে পারে, ব্যাটিং গভীরতা বাড়াতে দলে থাকতে পারেন ইয়াসির আলী। একাদশ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা অবশ্য হওয়ার কথা আজ ম্যাচের আগে টিম মিটিংয়ে।

শ্রীরামের কাছে উইকেটটা যে রকমই মনে হোক, পেসবান্ধব গ্যাবায় সফলতার হার স্পিনারদেই বেশি। টেস্টে এখানে সর্বোচ্চ উইকেট একজন লেগ স্পিনারের, শেন ওয়ার্ন (১১ টেস্টে ৬৮ উইকেট)। ব্রিসবেনের এ মাঠে এখন পর্যন্ত যে ছয়টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হয়েছে, সেখানেও সবচেয়ে বেশি উইকেট (৫টি) অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার।

তিন ‘অভিষেকের’ ম্যাচে তাই গ্যাবা কিছুটা রহস্য রেখেই দিচ্ছে বাংলাদেশের জন্য।