বিসিবি, তুমি পারছ কি শুনতে

কার্টুন: এআই

‘১০-১২ বার রং নাম্বার পেরিয়ে তোমাকে পেয়েছি...হ্যালো, এটা কি ০১৭১...? বিসিবি তুমি পারছ কি শুনতে?’

আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী অঞ্জন দত্ত তাঁর বেলা বোস গানটিতে বেলার সঙ্গে কথা বলার আকুলতা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে—‘এটা কি ২৪৪১১৩৯, বেলা বোস তুমি পারছ কি শুনতে, ১০-১২ বার রং নাম্বার পেরিয়ে তোমাকে পেয়েছি, দেব না কিছুতেই আর হারাতে।’

গানটির প্রেমিক চরিত্রটি বেলা বোসের টেলিফোন নম্বরটা জানত। সেই নম্বরে ফোন করে নিজের কথা যে বলবে, সে সুযোগ অবশ্য তার হয়নি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোনো শব্দই যে ভেসে আসেনি। প্রেমিক বারবার অনুরোধ করেছিল, বেলাকে ডেকে দিতে। তার সেই অনুরোধ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছে নিজের কানে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা তো দেশের ক্রিকেট-অভিভাবকদের মোবাইল নম্বরই জানেন না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একটা ওয়েবসাইট আছে বটে, সেখানে নেই কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর; যে মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলাটির প্রেমিকেরা নিজেদের মনের কথা, আনন্দ ও কষ্টের গল্প, প্রাপ্তির হর্ষ বা অপ্রাপ্তির বিষাদ নিয়ে একটু প্রাণখোলা লেনদেন করতে পারবেন!

তা প্রেমিকার বাড়ির ঠিকানা বা ফোন নম্বর হয়তো প্রেমিকার অভিভাবকেরা (বোর্ড সভাপতি আর তাঁর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা) ইচ্ছা করেই গোপন করে রেখেছেন! ‘দুষ্টু প্রেমিক’কে কোন অভিভাবকই–বা ‘প্রেমিকার’ সঙ্গে সাক্ষাৎ বা যোগাযোগের সুযোগ দেন! তাকে যত দূরে রাখা যায়, ততই মঙ্গল।

টেস্ট নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার আগে যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাটটা শক্তভাবে রপ্ত করা দরকার, সেটাই তো পাওয়া হয় না বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের! এখানকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কাঠামো) যে বড্ড নড়বড়ে। এ শুধু থাকার জন্যই থাকা। নামমাত্র চলা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে যে বিদ্যা আমাদের ক্রিকেটাররা পান, তা আর যা–ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে (টেস্ট) পরীক্ষা দেওয়ার মতো শক্তি ও সাহস জোগাতে পারে না! এ কারণেই তো ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে গিয়ে এমন খাবি খায় আমাদের ক্রিকেট-সন্তানেরা!

কিন্তু দুষ্টু প্রেমিকের হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে গিয়ে কোনো অভিভাবক কি তাঁর সন্তানকে অশিক্ষিত বা বকলম বানিয়ে রাখবেন, রাখবেন অসুন্দর করে! রাখতেও পারেন, মেয়ে বেশি শিক্ষিত আর সুন্দরী হলে যদি কারও নজর লাগে! কেউ যদি ভালোবেসে পাগলপাড়া হয়ে যায়। তখন সেই ‘পাগল’ ঠেকাবেন কী করে অভিভাবক!

এ কারণেই কি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দেশের ক্রিকেটকে এত অবহেলা করছে, বেড়ে উঠতে দিচ্ছে না অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে! টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—সর্ববিদ্যায় বিদুষী হয়ে! আর না হলে বছরের পর বছর ধরে দেশের ক্রিকেট কাঠামো এতটা দুর্বল করে রাখবে কেন বিসিবি। সন্তানকে বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও মানে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ও বড় সংস্করণ টেস্ট খেল; অথচ এ বিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা সেভাবে দিল কোথায় তাকে!

কলম্বো টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আউট হয়ে ফিরছেন নাজমুল
এএফপি

টেস্ট নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার আগে যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠটা শক্তভাবে রপ্ত করা দরকার, সেটাই তো পাওয়া হয় না বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের! এখানকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কাঠামো) যে বড্ড নড়বড়ে। এ শুধু থাকার জন্যই থাকা। নামমাত্র চলা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে যে বিদ্যা আমাদের ক্রিকেটাররা পান, তা আর যা–ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে (টেস্ট) পরীক্ষা দেওয়ার মতো শক্তি ও সাহস জোগাতে পারে না! এ কারণেই তো ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে গিয়ে এমন খাবি খায় আমাদের ক্রিকেট-সন্তানেরা!

অথচ ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার পুরো দায়ই বর্তায় ওই সব ক্রিকেট-সন্তানদের ওপর। কারণ, মানুষ তো দেখে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মহাপরীক্ষায় ডাহা ফেল করেছেন তাঁরা। এই ফেলের পেছনের কারণটা যাঁরা উদ্‌ঘাটন করে পরামর্শ দিতে পারেন, তাঁরা এখানকার ক্রিকেট-গার্ডিয়ানদের নাগাল কোথায় পান! কেউ কেউ যদি নাগাল পানও বা দূর থেকে দু-একটা পরামর্শ দেনও, তাঁদের কথা শোনার ফুরসত কই ক্রিকেট-অভিভাবকদের। কখনো কখনো তাঁদের সেই পরামর্শকে হয়তো পাগলের প্রলাপ ভাবা হয়েছে, কখনো মনে করা হয়েছে স্পর্ধা, আর কাউকে কাউকে পাত্তাই দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ক্রিকেট নামের প্রেমিকার এ দেশের অভিভাবকেরা!

শিশুকালে না বুঝলেও বড় হয়ে অন্তত সন্তান তো বোঝেন—তাঁকে অযত্নে বড় করা হয়েছে। তাই পরীক্ষায় ফেল করলে বাইরের মানুষ যখন তাঁর দিকে আঙুল তোলেন, তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেন; অভিমান থেকেই হোক বা ক্ষোভ থেকে—আসল সত্যটা প্রকাশ করে দেন। গোটা পৃথিবীকে জানিয়ে দেন—‘দোষটা আমার নয়, আমাকে প্রাথমিক শিক্ষাটা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি বলেই আজ এমন ভরাডুবি।’

এডি বারলোর কথাই ধরুন। বাংলাদেশের সাবেক কোচ ছিলেন বারলো, টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শুরুর দিকের। বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টেস্ট নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে, সেই শিশু বয়সেই নাকি তিনি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটকে দাঁড় করাতে অসাধারণ একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। সেই কাঠামোকে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডে আসা কোনো অভিভাবকই কখনো আলোর মুখ দেখতে দেননি।

বাংলাদেশের সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজ
প্রথম আলো

বাংলাদেশের আরেক সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজ একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত নয়। সেটাকে স্পর্ধা হিসেবে দেখে তাঁকে কোচের পদ থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছিল! আর ওই যে বলা হলো, ‘কাউকে কাউকে’ পাত্তাই দেওয়া হয় না, সেটা বাংলাদেশের মিডিয়া। অনেক কিছু লেখার পরও তা নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!

কিন্তু শিশুকালে না বুঝলেও বড় হয়ে অন্তত সন্তান তো বোঝেন—তাঁকে অযত্নে বড় করা হয়েছে। তাই পরীক্ষায় ফেল করলে বাইরের মানুষ যখন তাঁর দিকে আঙুল তোলেন, তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেন; অভিমান থেকেই হোক বা ক্ষোভ থেকে—আসল সত্যটা প্রকাশ করে দেন। গোটা পৃথিবীকে জানিয়ে দেন—‘দোষটা আমার নয়, আমাকে প্রাথমিক শিক্ষাটা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি বলেই আজ এমন ভরাডুবি।’

কখনো কখনো সন্তান অভিভাবকের দিকেই আঙুল তোলে, অভিভাবককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়! শ্রীলঙ্কায় কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সব বিভাগের মিলিত ব্যর্থতায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনের সকালবেলাতেই হেরে যাওয়ার পর দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে নাজমুল-তাইজুলদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে আবার হাসাহাসিও করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল হোসেন
প্রথম আলো

বিষয়গুলো হয়তো সহ্য করতে পারেননি কলম্বো টেস্ট শেষে এই সংস্করণের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া নাজমুল। তিনি দায়টা অভিভাবকদের ওপরই চাপালেন। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ খুব বেশি থাকে না। ওদের ফিল্ড প্লেসমেন্ট, ডিসিপ্লিন বোলিং এবং ব্যাটসম্যানরা যেভাবে ব্যাটিং করেছে—এ রকম চ্যালেঞ্জ আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে কখনোই থাকে না। লম্বা সময় ধরে ভালো জায়গায় বল করার অভ্যাসও খুব বেশি বোলারের নেই।’ নাজমুল এরপর যোগ করেন, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট একদমই মেলে না। এটা তাই খুব কঠিন। আমি মনে করি, খেলোয়াড়দেরও বড় দায়িত্ব আছে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আমরা কী চাই, সেটা ঠিক করতে।’

এর আগে এই কলম্বো টেস্টের তৃতীয় দিনে শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া স্পিনার তাইজুল ইসলামও একই রকম কথা বলেছেন, ‘আপনারাও ভালো করে জানেন, আমাদের ক্রিকেটের অবকাঠামো কেমন ছিল বা কেমন আছে। শুধু ক্রিকেটারদের দোষ দিলে সেটা আমি মানতে নারাজ। যখন একটা দল খারাপ করে, তার সঙ্গে অনেক কিছুই সম্পৃক্ত থাকে। খেলোয়াড়েরা অনেক চেষ্টা করছে। আমাদের অবকাঠামো ভালো হলে দিনে দিনে আমরাও ভালো অবস্থানে আসব।’ তাইজুল এখানেই থামেননি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কাঠামোর পার্থক্যটাও তুলে ধরেছেন তিনি, ‘এখানকার কী সুযোগ-সুবিধা, এখানে ওরা কী ধরনের উইকেটে অনুশীলন করে আপনারা দেখেছেন। আমরাও এ রকম সুযোগ-সুবিধা চাই, যেখান থেকে অনেক ক্রিকেটার উঠে আসবে এবং প্রতিযোগিতা অনেক বাড়বে।’

দেশের ক্রিকেটের প্রিয় অভিভাবকেরা—অন্য কারও কথায় না হয় কান না দিলেন, দেশের ক্রিকেটের প্রেমিকদের উপেক্ষা করলেন, সমালোচকদের সমালোচনাকে স্পর্ধা ভাবলেন; কিন্তু নিজের সন্তানদের কথাগুলো পারছেন কি শুনতে! তাঁদের কিন্তু কষ্ট করে আপনাদের নম্বর সংগ্রহ করে ডায়াল করতে হয়নি!