হলুদ জার্সি পরে ওটা অস্ট্রেলিয়াই খেলছে তো এই বিশ্বকাপে! নাকি অন্য কোনো দল। বিশ্বকাপে এমনই অবিশ্বাস্য রেকর্ড যে প্রথম দুই ম্যাচে হেরে যাওয়াই এই সংশয় জাগাতে পারত। সর্বশেষ এমন কিছু খুঁজে পেতে যে পিছিয়ে যেতে হয় প্রায় ৩১ বছর।
এখানে তো শুধু হারা নয়। গোহারা বলে যে একটা শব্দ আছে, ব্যবহার করতে হচ্ছে সেটাই। ৬ উইকেট আর ১৩৪ রান যথেষ্টই বড় ব্যবধান। দ্বিতীয়টি তো বিশ্বকাপ ইতিহাসেই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় পরাজয়। তারপরও কেউ বলতেই পারেন, না, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দশা এতেও ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না।
ব্যাটিংয়ে দুই ম্যাচেই ২০০ পেরোতে ব্যর্থ। বোলিংয়েও সেই ঝাঁজ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ১০ ওভারে বোলাররা তা-ও একটু ফিরে এসেছিলেন বলে রেকর্ড পরাজয়টা আরও বড় হয়নি। আর ফিল্ডিং? অস্ট্রেলিয়াকে আরও বেশি অচেনা লাগছে ওখানেই। এক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই পড়েছে ৬টি ক্যাচ। এর আগে কোন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ৬টি ক্যাচ ফেলেছে, তা খুঁজে বের করুন তো দেখি!
কী দরকার! সহজেই যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেটিই তো যথেষ্ট ওই সংশয়টা আরও জোরালো করে তুলতে। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম ব্যাটিং গড় (১৮.৮০)। ক্যাচ ধরায় সাফল্যের হারেও সবার নিচে। আহা, কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে। এটা অস্ট্রেলিয়া কীভাবে হয়!
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার যে আধিপত্য, অন্য কোনো খেলাতেও তার কোনো তুলনা নেই। ক্যাবিনেটে পাঁচটি ট্রফি। সেই পাঁচটি ট্রফি এসেছে ভিন্ন পাঁচ মহাদেশে। গায়ে চিমটি কেটে সত্য-মিথ্যা পরীক্ষা করে দেখার মতো টানা ৩৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড, টানা ২৫ ম্যাচে জয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট তো অস্ট্রেলিয়ারই টুর্নামেন্ট।
সেই অস্ট্রেলিয়াই আজ লক্ষ্ণৌতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে থরহরি কম্পমান। অথচ ১৯৯৬ ফাইনালে হারার পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপে কখনো হারতে হয়নি। বৃষ্টিতে একটা ম্যাচ পরিত্যক্ত না হলে হয়তো টানা সাত জয়ই হয়ে যেত। সেই শ্রীলঙ্কার ম্যাচের আগেই কিনা অস্ট্রেলীয় অধিনায়ককে বলতে হচ্ছে, ‘এখন থেকে প্রতিটি ম্যাচই আমাদের ফাইনাল।’
শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গেলেই যে সব শেষ, এমন কিন্তু নয়। এরপরও বাকি থাকবে আরও ছয়টি ম্যাচ। এর আগে রাউন্ড রবিন লিগের দুটি বিশ্বকাপে তিনটি দল পাঁচ ম্যাচ জিতেও সেমিফাইনালে খেলেছে। একবার একটি দল তো চার ম্যাচ জিতেই। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচ শেষে ৩-০ হয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তো মরাকান্না শুরু হয়ে যাবে। ২-০ হওয়ার পরই তো তা শুরু হয়ে গেছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের অলরাউন্ডার টম মুডি পরিষ্কারই বলে দিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার এই দল মোটেই অতীতে বিশ্বকাপে রাজত্ব করা অস্ট্রেলিয়া দলগুলোর মতো নয়।
সর্বশেষ বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক এত মোলায়েম করে বলেননি। রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন প্যাট কামিন্সের দলকে। চাঁছাছোলা কথার মধ্যেও একটা একটু বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষেও যদি এভাবে হারতে হয়...।’
এটুকু পড়ে কথাটাকে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অপমানকর মনে হতে পারে। তবে এরপর দেওয়া ব্যাখ্যায় বোঝা গেছে, ক্লার্ক আসলে কী বলতে চেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষেও যদি এভাবে হারতে হয়, তাহলে এশিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে কী হবে? এশিয়ান দল বলতে এই বিশ্বকাপের চারটি দলকে বোঝায়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ তো শেষই, বাংলাদেশ নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা চিন্তিত নন ক্লার্ক। তাঁর দুশ্চিন্তা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে নিয়ে। এই দুই দলের স্পিন আক্রমণের সামনে অস্ট্রেলিয়া না হাস্যস্পদ হয়ে যায়, সেই শঙ্কাও প্রকাশ করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের কথা না বলার আরেকটা কারণও অবশ্য থাকতে পারে। ১১ নভেম্বর পুনেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার শেষ গ্রুপ ম্যাচ। এভাবে খেলতে থাকলে সেই ম্যাচের আগেই তো শেষ অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনালের আশা।
অস্ট্রেলিয়ানরা হাল ছেড়ে দেওয়ার জাতি নয়। লড়াই তাদের রক্তে। মাইকেল ক্লার্কের কথায় যদিও মনে হচ্ছে, এই দল ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লিখবে, এই আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। ফ্রান্সে অনুষ্ঠানরত বিশ্বকাপ রাগবির উদাহরণ টেনে বলেছেন, ‘গত তিন সপ্তাহ ওয়ালাবিদের (অস্ট্রেলিয়ার রাগবি দল) নিয়ে যে ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, দুই সপ্তাহ পর ক্রিকেট দল নিয়েও তা-ই হবে।’
রাগবি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফিজির কাছে হেরেছে অস্ট্রেলিয়া, পুল পর্ব পেরোতে না পারাও এই প্রথম। তা নিয়েই সমালোচনার ঝড়। অথচ অস্ট্রেলিয়া রাগবি বিশ্বকাপের সফলতম দলও নয়। তাদের চেয়ে বেশিবার শিরোপা জিতেছে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। যেখানে বিশ্বকাপ ক্রিকেট হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রিয় মৃগয়া। এখানে সেমিফাইনালে উঠতে না পারলে এই ব্যর্থতার কোনো ক্ষমা নেই।
দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে প্রস্তুতি নিয়ে। এমন অবস্থা থেকেও অস্ট্রেলিয়ার ফিরে আসার উদাহরণ আছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচের দুটি হেরে যাওয়ার পর অবস্থাটা অনেকটা এ রকমই দাঁড়িয়েছিল। আসলে এর চেয়েও কঠিন। সেমিফাইনালে উঠতে অস্ট্রেলিয়াকে বাকি সব ম্যাচেই জিততে হতো। স্টিভ ওয়াহর অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-রাজের শুরুও সেখান থেকেই।
অস্ট্রেলিয়ার সমস্যা এটাও যে প্যাট কামিন্সকে স্টিভ ওয়াহ দূরে থাক, স্টিভ ওয়াহর ছায়াও মনে হচ্ছে না। নইলে অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ার মতো লাগছে না, এ মন্তব্যের জবাবে কীভাবে বলেন, এত বছর খেলেও নাকি তিনি অস্ট্রেলিয়ার মতো মনে হওয়া বলতে কী বোঝায়, তা বুঝতে পারছেন না!