ব্যাটিং ব্যর্থতায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বড় পরাজয়

ওপেনার তানজিদ হাসান রান পাননি কিউইদের বিপক্ষেওছবি: এএফপি

শুরুতেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে বাংলাদেশের একটা আশ্রয় আছে। ওয়ানডেতে কবে কোথায় এমন বিপর্যয়ের পরও জিতেছিল দল, সেই স্মৃতিচারণায় আশ্রয়। উদাহরণ একাধিক আছে। দুই বছর আগে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আফিফ ও মিরাজের অবিশ্বাস্য ওই জুটিতে আসা জয় মনে পড়বে। মনে পড়বে কার্ডিফ-ও। প্রতিপক্ষ আর উপলক্ষ বিবেচনায় যেটি হয়তো আরও বেশি স্মরণীয়। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জয়টা আবার এই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই।

সেদিন সাকিব আর মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত এক জুটি শুধু ম্যাচই জেতায়নি, বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছিল চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে। পুরোনো ইতিহাস মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ? চেন্নাইয়ে কার্ডিফ ফিরিয়ে আনার সুযোগটা হেলায় হারানো। সাকিব এখানেও কমন ছিলেন। তবে সঙ্গী বদল হয়েছে। মাহমুদউল্লাহর বদলে মুশফিক। বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই টপ অর্ডারের ধসে পড়া এখন প্রায় নিয়মই বলতে পারেন। আজকের ম্যাচ ধরলে সর্বশেষ ১২ ম্যাচের ৯টিতেই রান তিন অঙ্ক ছোঁয়ার আগেই ৪ উইকেট হাওয়া।

আরও পড়ুন

এদিন পড়ল ৫৬ রানে। তৃতীয় আর চতুর্থ উইকেট আবার ৪ বলের মধ্যে, একই স্কোরে। এরপরই সাকিব আর মুশফিকের ব্যাটে পাল্টা প্রতিরোধ। চেন্নাইয়ে প্রেসবক্স বলতে গেলে পুরোটাই বাংলাদেশি অধ্যুষিত। সেখানে তাই কার্ডিফের স্মৃতিচারণা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তা চেন্নাইয়ে কেন ফিরল না কার্ডিফ? উত্তর খুবই সহজ। কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদউল্লাহ দুজনই সেঞ্চুরি করেছিলেন। আর এখানে ৪০ করেই দায়িত্ব শেষ মনে করলেন সাকিব। ম্যাট হেনরির স্লোয়ারে বোল্ড হওয়ার আগে মুশফিক করতে পারলেন ৬৬ রান।

কোনো ব্যাটসম্যানই ইচ্ছা করে আউট হন না। তবে আউট হওয়ার ধরন বা সময় কখনো কখনো কাঠগড়ায় দাঁড় করায় তাঁদেরকে। এখানেও যেমন দাঁড়াতে হচ্ছে ওই দুজনকে। ‌‘অপরাধ’ সেট হয়ে যাওয়ার পর ইনিংসটাকে আরও টেনে নিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা। পঞ্চম উইকেটে ৯৬ রানের জুটিটা ১৯৬ হলেও যে বাংলাদেশ জিতে যেত, এটা তো গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। তবে ম্যাচটা এমন একপেশে তো অবশ্যই হতো না।

আরও পড়ুন

এই ম্যাচের আগে এমন স্পিন-স্পিন রব উঠেছিল যে, যেন এটি দুই দলের স্পিনারদের লড়াই। টসের সময় দুই দলের একাদশ দেখার পরই সেই ধারণায় প্রথম ধাক্কা। কদিন আগেই বাংলাদেশের বিপক্ষে ৬ উইকেট নেওয়া লেগ স্পিনার ইশ সোধি নিউজিল্যান্ড দলে নেই। বাংলাদেশও আগের ম্যাচের একাদশ থেকে উল্টো একজন স্পিনার কমিয়ে ফেলেছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেদারসে রান বিলালেও ৪ উইকেট নিয়েছিলেন অফ স্পিনার মেহেদী হাসান। সেই মেহেদীর বদলে আবার দলে ফেরানো হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে।

বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা মাঠ ছেড়েছেন এভাবেই।
ছবি: এএফপি

চেন্নাইয়ের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের উইকেটের স্পিনপ্রীতির ইতিহাস এই মাঠের সমান বয়সীই। পাঁচ দিন আগে এখানে এই বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচের উইকেটও মনে করিয়ে দিয়েছে সেই ঐতিহ্যকে। এখন বোঝা যাচ্ছে, তা বানানো হয়েছিল ভারতীয় স্পিনারদের অর্ডার অনুযায়ী। বিশ্বকাপ আইসিসির টুর্নামেন্ট হতে পারে, তবে স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা নিতে কেন ছাড়বে ভারত! ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তো ভারতের বেশির ভাগ ম্যাচ হয়েছে এক রকম উইকেটে। অন্যরকম উইকেটে বাকি টুর্নামেন্ট।

আরও পড়ুন

ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের উইকেট যে এটি নয়, দুই দলই তা বুঝে গিয়েছিল। বাংলাদেশকে বোঝাতে ছিলেন এখানকারই মানুষ শ্রীধরন শ্রীরাম। আর নিউজিল্যান্ডকে বোঝাতে দলে চেন্নাই সুপার কিংসের দুই খেলোয়াড়। ডেভন কনওয়ে ও মিচেল স্যান্টনার তো ভালোই জানেন, এই মাঠে টি-টোয়েন্টিতে দুই শর বেশি রান করার মতো উইকেটও হয়। এই ম্যাচের উইকেটও অনেকটা সেরকমই। যে কারণে বাংলাদেশের ইনিংসের পরই বোঝা হয়ে গিয়েছিল, এই রান মোটেই নিউজিল্যান্ডকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো নয়।

টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ফিফটি পেয়েছেন মুশফিকুর রহিম
ছবি: এএফপি

সেই ২৪৫-ও তো হয় না। ৮ নম্বরে নেমে মাহমুদউল্লাহর অপরাজিত ৪১-ই না বাংলাদেশের স্কোরটাকে একটু ভদ্রস্থ করেছে। নইলে ১৮০ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দুই শ পেরোনো নিয়েও যথেষ্টই শঙ্কা ছিল। তাসকিনের সঙ্গে নবম উইকেটে মাহমুদউল্লাহর ৩৪ রানই ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দুর্দশার কথা বোঝাতে এটাই মনে হয় যথেষ্ট। সাকিব যখন আউট হলেন, ইনিংসের তখনো ২০ ওভারেরও বেশি বাকি। মুশফিকের বিদায় ৩৬তম ওভারে। একটু বেশি আগেই তাঁরা খাপ খুলে নেমে গেছেন কি না, এই প্রশ্ন তাই উঠবেই।

লিটন কুমার দাসের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। মানে প্রশ্ন-ট্রশ্নের কোনো ব্যাপার নেই আর কি! আগের ম্যাচে ৭৬ করে ফর্মে ফেরায় একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন মনে হয়। নইলে ম্যাচের প্রথম বলেই ওভাবে চালিয়ে দেবেন কেন! মারার মতো বল পেলে প্রথম বলে মারা যাবে না, এমন কোনো নিয়ম নেই। আধুনিক ক্রিকেটে তো আরও নয়। তবে প্রথম বলেই ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে ট্রেন্ট বোল্টের মতো বোলারকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে একটু সমালোচনা তো হবেই।

অধিনায়ক সাকিব ৪০ রান করলেও স্বস্তির সঙ্গে ব্যাট করতে পারেননি
ছবি: এএফপি

আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে নাজমুল হোসেন বলে গেছেন, ওপেনিং জুটি নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। চিন্তা করা উচিত, শুরুতেই ২/৩ উইকেট পড়ে গেলে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে, তা নিয়ে। তা সেই ঘুরে দাঁড়ানোর অনুশীলন নিয়মিতই হচ্ছে। গত বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে নির্ভরতার অন্য নাম নাজমুল নিজেও তাতে ভালোই অবদান রাখছেন। তা না হলে ৪ উইকেটে ৫৬ হয় নাকি!

আরও পড়ুন

নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে বাংলাদেশের আনন্দ বলতে ২ উইকেট। আর আক্ষেপ বলতে দুই/তিনটি হাফ চান্স। আর উপলব্ধি বলতে 'কীভাবে ইনিংস গড়তে হয়' শীর্ষক কেন উইলিয়ামসনের মাস্টারক্লাস। চোটের কারণে ছয় মাসেরও বেশি ক্রিকেটের বাইরে। গুয়াহাটিতে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছেন নিজের অবস্থা বুঝতে। এই ম্যাচ দিয়েই প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফেরা। উইলিয়ামসনকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিল নাকি! কখন রান করে ফেলেন, অনেক সময় তা বোঝাই যায় না। হাতে চোট পেয়ে বেরিয়ে যেতে না হলে হয়তো ফেরাটা হতো সেঞ্চুরি দিয়েই।

এই নিউজিল্যান্ড দলে অনেক ম্যাচ উইনার। যাঁদের একজন, ড্যারিল মিচেল ম্যাচ শেষ করে দিলেন ছক্কা মেরে। ৬৭ বলে অপরাজিত ৮৯ রানের ইনিংসের পরও অবশ্য ম্যাচসেরা মিচেল নন। সেই স্বীকৃতি লকি ফার্গুসনের। ৪৯ রানে ৩ উইকেট নিয়েই এক বোলারের ম্যাচসেরা হয়ে যাওয়া থেকেও এই ম্যাচের উইকেটটা বুঝে নেওয়া যায়।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৪৫/৯ (মুশফিক ৬৬, মাহমুদউল্লাহ ৪১*, সাকিব ৪০; ফার্গুসন ৩/৪৯, বোল্ট ২/৪৫)

নিউজিল্যান্ড: ৪২.৫ ওভারে ২৪৮/২ (মিচেল ৮৯*, উইলিয়ামসন ৭৮; মোস্তাফিজ ১/৩৬)

ফল: নিউজিল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী

ম্যাচসেরা: লকি ফার্গুসন