‘প্লিজ, আপনারা মেয়েদের কণ্ঠস্বর হোন’

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনর্দখলের পর অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় নেন কয়েকজন নারী ক্রিকেটারছবি: ফিমেল ক্রিকেট

‘আফগানিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের বলছি, দয়া করে আপনারা মেয়েদের কণ্ঠস্বর হোন। আমাদের জন্য আরও কিছু করুন। আপনারাই আফগানিস্তানের কণ্ঠস্বর। আপনারাই এই মুহূর্তে (দেশের) সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ’—ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফোর পাওয়ারপ্লে পডকাস্টে রশিদ খান, মোহাম্মদ নবী, রহমানউল্লাহ গুরবাজদের উদ্দেশে কথাগুলো বলছিলেন ফিরোজা আমিরি।

রশিদ–নবীদের প্রতি আফগান নারী ক্রিকেটার আমিরির কেন এমন আকুতি, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। দুই দশক যুদ্ধের পর মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী নিজেদের সরিয়ে নিলে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনর্দখল করে তালেবান।

তালেবানের উত্থানের পর মেয়েদের খেলা, পড়াশোনা ও বাড়ির বাইরে কাজ করায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যার ছাপ পড়ে ক্রিকেটেও। এমন পরিস্থিতিতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন ফিরোজা আমিরি, বেনাফশা হাশিমিসহ অনেক নারী ক্রিকেটার। বর্তমানে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। কয়েকজন আছেন মেলবোর্নে, কয়েকজন ক্যানবেরায়।

আফগানিস্তানের নির্বাসিত নারী ক্রিকেটার ফিরোজা আমিরি
ছবি: ফিমেল ক্রিকেট

অথচ ২০২০ সালে করোনাকালেও ২৫ নারী ক্রিকেটারকে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে এনেছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)। কিন্তু এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তালেবান ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি বদলে যায়। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার ও তাঁদের পরিবার তালেবানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কয়েকজন নারী ক্রিকেটার ভয়ে ক্রিকেটসামগ্রী পুড়িয়ে ফেলেন, কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে যান। আমিরি ও হাশিমিও আছেন পালিয়ে যাওয়াদের তালিকায়।

আরও পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার পর আমিরি–হাশিমিরা ক্লাব ক্রিকেট খেলছেন। ৩০ জানুয়ারি মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) মেয়েদের অ্যাশেজের টেস্ট ম্যাচ শুরু হবে। একই দিন মেলবোর্নের জংশন ওভালে ক্রিকেট উইদাউট বর্ডারস একাদশের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলার কথা অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত আফগানিস্তান নারী একাদশের।

তবে আমিরি–হাশিমির বিশ্বাস, একদিন আফগান মেয়েদের ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে, তাঁরা আবারও আফগানিস্তান জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। কিন্তু তাঁদের দাবি, আইসিসির কাছ থেকে সহযোগিতা চাইলেও বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আফগান নারী ক্রিকেটারদের জন্য কিছুই করেনি। এ কারণে তাঁরা আফগানিস্তান ছেলেদের দলের দিকে তাকিয়ে।

আমিরি মনে করেন, রশিদ–নবীদের দলটা খুব দ্রুত উন্নতি করেছে। তাই তাঁদের কথায় নারী ক্রিকেটের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠেও যেতে পারে, ‘বিশ্ব ক্রিকেটে এই মুহূর্তে তাঁরা ভালো অবস্থানে আছেন। যদি তাঁরা আমাদের সমর্থন করতে শুরু করেন, তাহলে তাঁরা আমাদের দলে বড় প্রভাব ফেলবেন। তাঁরা আমাদের জন্য, সব নারীর জন্য খুবই, খুবই সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন। মেয়েরা যদি খেলাধুলা শুরু করতে পারে, তাহলে লেখাপড়াও করতে পারবে। এটি একটি উপায় হতে পারে।’

আফগান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা রশিদ খান
ছবি: আইসিসি

তবে রশিদ–নবীরা তালেবান সরকারকে মেয়েদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বললে তাঁরাও নিষিদ্ধ হওয়ার শঙ্কায় পড়তে পারেন, তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন আমিরি, ‘আমি জানি (এ নিয়ে কথা বললে) তাঁরাও কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারেন। তাঁদের কারও কারও পরিবার এখনো আফগানিস্তানে আছেন। আমরা চাই না (আমাদের কারণে) আপনারা বিপদে পড়ুন।’

আরও পড়ুন

ছেলেরা খেলতে পারলেও মেয়েরা পারছেন না—বিষয়টি ভেবে খারাপ লাগে বেনাফশা হাশিমির। তবে সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রশিদ–নবীদের সাফল্য নিয়ে গর্বিতও তিনি, ‘আমি বলতে পারি, ৫০–৫০ (সমান অনুভূতি)। আমি খুব খুশি ছিলাম কারণ, আফগানিস্তান (ছেলেদের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের) সেমিফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু আমরা সেই টুনার্মেন্টে খেলতে পারিনি। এটা ভেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি সুযোগ পাচ্ছে। এই অনুভূতি বর্ণনা করা কঠিন।’

আমিরি–হাশিমিরা যে দেশে আছেন, সেই অস্ট্রেলিয়া কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে অনীহা জানিয়ে আসছে। তালেবান সরকার নারীদের অধিকার ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আফগানদের বিপক্ষে খেলবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)।

মেয়েদের ক্রিকেট খেলাতেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তালেবান সরকার
ছবি: ফিমেল ক্রিকেট

সম্প্রতি প্রায় দুই শ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়ামন্ত্রীও আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

আমিরি মনে করেন, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট বোর্ডগুলো রশিদ–নবীদের সঙ্গে খেলা বন্ধ করে দিলে দলের ওপর যদি প্রভাব ফেলে, তবেই আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তথা তালেবান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন মেয়েরা। এভাবে যদি মেয়েদের খেলার পথ তৈরি হয়, কেবল তাহলেই তিনি খুশি হবেন।