বিসিবিতে নতুন ‘সংকট’, কে হবেন দ্বিতীয় সহসভাপতি
বিসিবি নির্বাচন চলছে। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ভোট গ্রহণ, চলবে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এরই মধ্যে ভোট দিয়ে ফেলেছেন বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই।
বিএনপিপন্থীরা সরে দাঁড়ানোয় নির্বাচন নিয়ে বাহ্যত কোনো উত্তাপ এখন পর্যন্ত নেই। জেলা–বিভাগ থেকে ১০ পরিচালকের ৮ জনই বলতে গেলে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে কারা আসবেন, সেটিও ভোট গ্রহণের আগেই মোটামুটি ঠিকঠাক।
শুধু ক্যাটাগরি–৩–এর নির্বাচনে মুখোমুখি জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ ও কোয়াবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল। তবে মাসুদের প্রতিও যেহেতু সরকার পক্ষের বিশেষ ‘স্নেহ’ আছে, তাঁর জয় ঠেকানো কঠিন হতে পারে দেবব্রতর জন্য।
পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন শেষ হবে আজ সন্ধ্যায়। এরপর বোর্ড সভায় যে বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলামই পরবর্তী সভাপতি নির্বাচিত হবেন, তা নিয়েও কোনো সংশয় নেই। বিসিবির এবারের একপেশে ভোটে এ মুহূর্তে সব অনিশ্চয়তা ও সংকট শুধু সহসভাপতির একটি পদ নিয়ে।
সহসভাপতি হবেন দুজন, সভাপতি আমিনুলের মতো যার একজন এরই মধ্যে অনেকটা নিশ্চিত। তিনি ঢাকা জেলার কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নাজমূল আবেদীন। বর্তমান বোর্ডেও সহসভাপতি হিসেবে আছেন নাজমূল। কিন্তু নতুন বোর্ডে তাঁর সঙ্গে আরেকজন সহসভাপতি কে হবেন?
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই প্রশ্নেই এ মুহূর্তে গভীর সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন ‘নীতিনির্ধারকেরা’। ভাবছেন, সহসভাপতি তো হবেন পরিচালকদের ভোটে। এখানে নীতিনির্ধারকদের ভাবার কী আছে? প্রশ্নটি অবান্তর, কারণ এবারের পুরো নির্বাচনটাই হচ্ছে ‘নীতিনির্ধারক’দের ছকে। তার মধ্যেও একটা ভালো দিক উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো, ‘নীতিনির্ধারক’দের পছন্দের লোক হিসেবে যাঁরা কাউন্সিলর হয়েছেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের বেশির ভাগই ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ।
দ্বিতীয় সহসভাপতি পদেও নীতিনির্ধারকেরা সে রকমই কাউকে খুঁজছেন, যিনি খেলার লোক তো বটেই, সঙ্গে বিতর্কমুক্তও হবেন। কিন্তু যাঁর নামেই তাঁরা হাত দিচ্ছেন, সেখানেই নাকি কোনো না কোনো সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে!
জানা গেছে, গতকাল শীর্ষ পর্যায়ের এক আলোচনায় আমিনুল ইসলামের সর্বশেষ বোর্ডেও ছিলেন—এ রকম অন্তত তিনজন পরিচালকের নাম দ্বিতীয় সম্ভাব্য সহসভাপতি হিসেবে এসেছে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেককেই মনে করা হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠ বা আওয়ামী লিগ সরকারের সুবিধাভোগী।
এর আগে সহসভাপতি হিসেবে আরেকজনের নামও শোনা গিয়েছিল, যিনি এখন নির্বাচনেই নেই। তাঁর আবার বিশেষ আবদার ছিল, তাঁকে একটি বিশেষ কমিটির প্রধান করতে হবে। যেটি করাটা উচিত হবে না বলে তখনই মনে হয়েছে নীতিনির্ধারকদের।
বিসিবির সভাপতি আমিনুল ও একজন সহসভাপতি নাজমূল; দুজনই আসছেন জেলা–বিভাগের ক্যাটাগরি–১ থেকে। ভারসাম্য রক্ষায় আরেকজন সহসভাপতি তাই ক্যাটাগরি–২ বা ক্লাব থেকে নিতে চাচ্ছেন নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু সেখানে নির্ঝঞ্ঝাট কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের একটি বিশ্বস্ত সূত্র।
যে কারণে এমন ব্যক্তির নামও সম্ভাব্য সহসভাপতি হিসেবে চলে আসছে, যাঁকে নিয়ে আছে অন্য আলোচনা। সর্বশেষ বিপিএলের ফিক্সিং তদন্তে গঠিত বিসিবির তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বিপিএলসংশ্লিষ্ট যাঁদের নিয়ে সন্দেহ ও বিসিবির জন্য সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, ওই পরিচালক প্রার্থীও সে রকমই একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিবির সঙ্গে ব্যবসায় নিয়মিত অন্যায্য ছাড় পেয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান এবং সেই ছাড় তারা এখনো চেয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অনেকের শঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি বিপিএল ফিক্সিংয়ের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয় অথবা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ফিক্সিং নিয়ে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এমন কোনো খবর আসে, যেখানে জানা যাবে বিসিবির শীর্ষ পর্যায়ের কেউ সন্দেহভাজনদের তালিকায় আছেন; তাহলে দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি কোথায় যাবে? অন্তর্বর্তী সরকারের যাঁরা ‘নির্বাচনী ম্যাকানিজমে’র সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই–বা তখন কী জবাব দেবেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক ক্রিকেটার বলেছেন, ‘এ রকম কেউ বোর্ডে এলে তদন্ত রিপোর্ট আদৌ প্রকাশ হয় কি না কে জানে! তা ছাড়া যেহেতু তারা বিসিবির সঙ্গে ব্যবসা করছে এবং ছাড় পাচ্ছে, তারা পরিচালক হলেই দেশের ক্রিকেট আর্থিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সহসভাপতি হলে তো সে ভয় আরও বেশি। আমাদের ক্রিকেট বোর্ড তখন নৈতিকভাবেই পিছিয়ে থাকবে।’
ক্রিকেটের আরেক অভিজ্ঞ সংগঠক মনে করেন, পরিচালক যেহেতু হচ্ছেনই, সহসভাপতি করা উচিত দুই সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ অথবা খালেদ মাসুদের মতো একজনকে। কিন্তু ফারুক বিসিবির সাবেক সভাপতি, তাঁর জন্য এক ধাপ নিচে নামাটা ভালো দেখাবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি নিজেও দায়িত্বটা নিতে ইচ্ছুক নন বলে জানা গেছে। আর মাসুদ আসবেন ক্যাটাগরি–৩ থেকে, ক্লাব থেকে নয়। সহসভাপতির ক্ষেত্রে ক্লাবকেই প্রাধান্য দিতে চান নীতি নির্ধারকেরা।
ওই সংগঠক অবশ্য মনে করেন, যে কারণে অন্যদের সহসভাপতি করার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকেরা মনস্তাত্ত্বিক বাধায় ভুগছেন, তার চেয়ে ফিক্সিংয়ের সন্দেহের বলয়ে থাকারা ক্রিকেটের জন্য বেশি ক্ষতিকর হবেন। তিনি বলেন, ‘অন্য কারণগুলোকে ইগনোর করা যায়, এটাকে নয়।’
যোগ্য কাউকে পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে আপাতত সহসভাপতি নির্বাচন না করা ভালো বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অথবা সভাপতির সঙ্গে একজন সহসভাপতি রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘বিসিবিতে এবার অনেক নতুন পরিচালক আসছেন। এ মুহূর্তে হয়তো তাঁদের সবার সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণিত নয়, তবে বোর্ড পরিচালক হিসেবে তাঁরা তো ভালো কাজ করতেও পারেন। তখন তাঁদের মধ্যে থেকেও দ্বিতীয় সভাপতি নির্বাচন করা যেতে পারে। আপাতত পদটি খালি রাখা যেতে পারে।’