অথচ সোবার্স বলেছিলেন, তাঁর রেকর্ড কোনো দিন ভাঙবে না

স্যার গারফিল্ড সোবার্স এবং ব্রায়ান লারাছবি: আইসিসি

১৮ এপ্রিল অ্যান্টিগার জনস্রোতে তিনিও ছিলেন। ১৯৯৪ সালের রৌদ্রস্নাত সে দিনে ব্রায়ান লারা যখন অবিশ্বাস্য সে কীর্তি গড়েছিলেন, তখন ত্রিনিদাদের রাজপুত্রকে অভিবাদন জানাতে নেমে এসেছিলেন স্বয়ং গ্যারি সোবার্স।

প্রায় চার দশক ধরে একের পর এক ব্যর্থ চেষ্টা দেখার পর যাঁর বদ্ধমূল ধারণাই হয়ে গিয়েছিল, স্যাবাইনা পার্কে মার্চের এক দুপুরে যা করেছেন, সেটা মর্ত্যের কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়।

আজ থেকে ৬৪ বছর আগে এই দিনে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৩৬৫ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংসের জন্ম দিয়েছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স। প্রথম শতকেই ভেঙে দিয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড, যা টিকে ছিল ৩৬ বছর।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘টোয়েন্টি ইয়ার্স অ্যাট দ্য টপ’-এ সেই ইনিংস নিয়ে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি। ব্রায়ান লারার আবির্ভাবের আগে সেটা সত্য হবে বলেই মনে হচ্ছিল। চলুন সোবার্সের মুখেই শোনা যাক নিজের রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কী ভেবেছিলেন—

‘টেস্টে এক ইনিংসে কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসে রেকর্ড যখন করলাম, তখন আমার বয়স ২১। ১৯৫৮ সালের ৩ মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে স্যাবাইনা পার্কে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৬৫ রানে অপরাজিত ছিলাম।

‘৩০ বছর পার হয়ে গেছে, এখনো কোনো ব্যাটসম্যান এ রেকর্ডের ৫০ রান দূরত্বেও আসতে পারেনি। ১৯৬৪ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১১ রান করে সবচেয়ে কাছে গিয়েছিল সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ববি সিম্পসন।

‘রেকর্ড ভাঙার জন্যই গড়া হয়, কিন্তু আমার মনে হয় না, আমারটা কখনো ভাঙবে। এটা বলার কারণ, খেলাটাই বদলে গেছে। আধুনিক সময়ে এখন এত বেশি কিছু পাওয়ার আছে যে অধিনায়কেরা খুব বেশি সময় ব্যাট করতে আগ্রহী নন। একদিনের ক্রিকেটের কারণে এমন ব্যাটসম্যানের জন্ম হচ্ছে, যারা বড় ইনিংস খেলতে খুব একটা দক্ষ নয়। ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওভালে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদের ২৭০ রান একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

১৯৯৪ সালে লারা নতুন রেকর্ড গড়ার পর তাঁকে মাঠেই অভিনন্দন জানান সোবার্স। ছবিটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে তোলার
ছবি: টুইটার

‘কিন্তু আমার রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার সত্যিকারের কোনো ঝুঁকি নেই। এখন খুব কম ব্যাটসম্যানই আছে, যাদের ১০ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি উইকেটে থেকে ৩০০-এর বেশি রান করার মতো একাগ্রতা আছে। জিওফ বয়কটের হয়তো সেটা আছে। কিন্তু সে বড্ড বেশি ধীরে রান করে। নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রোকে বর্তমানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তরুণ ব্যাটসম্যানদের একজন বলা হচ্ছে এবং হয়তো আমার রেকর্ডকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, কিন্তু ওর খেলা আমি খুব বেশি দেখিনি।

‘দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যারি রিচার্ডস আমার রেকর্ড ভাঙতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি যখন ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে নটিংহামশায়ারের অধিনায়ক ছিলাম, তখন ওর বিপক্ষে খেলেছিলাম। ও তখন খেলত হ্যাম্পশায়ারে। ‘গ্রেট’ এক খেলোয়াড়। ‘গ্রেট’ শব্দটা খুব যত্রতত্র ব্যবহার করা হয়। আমি এমন অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে এই শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি, যাদের সঙ্গে এই শব্দ যায় না। ক্যারিয়ারের শুরুতে ডেভিড গাওয়ার কিছু ভালো ইনিংস খেলেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেট বলা শুরু হলো।

দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি ব্যারি রিচার্ডস
ছবি: টুইটার

‘গ্রেটনেস’ একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে অর্জন করতে হয়—আমি বলব অন্তত ১০ বছর—এবং একজন খেলোয়াড় যদি এই সময়ে বিশ্বের সেরা বোলারদের বিপক্ষে টানা ভালো খেলতে পারে, তখন তাকে আসলেই গ্রেট বলা যায়।

ইংল্যান্ডের সাবেক ওপেনার ডেভিড গাওয়ার
ছবি: টুইটার

‘যতই কার্যকরী হোক না কেন, আমার মনে হয় না ডেভিড গাওয়ার এখনো সে মানে পৌঁছেছে। ব্যাটিংয়ে মাহাত্ম্য মানে সাবধানী খেলে অনেক রান করা নয়। এর মানে হলো বোলিংকে শাসন করা এবং সেটা শুধু ভালো উইকেটে নয়। একজন গ্রেট খেলোয়াড় নিজের প্রতিভা দিয়ে একজন বোলারকে নিজের ইচ্ছেমতো নাচাবে। সে নতুন কিছু করে এবং ফিল্ডিংকে অকার্যকর করতে অপ্রচলিত শট খেলে।

‘ডন ব্র্যাডম্যান তা করতেন এবং তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন। কিন্তু আমার মনে হয় না, ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার পর খুব বেশি গ্রেট ব্যাটসম্যান দেখেছি।
‘গ্রায়েম পোলক মাত্র যে কয়েকটা টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছে, তাতে ৬০ গড়ে রান করেছে। আমি তাকে ব্যারি রিচার্ডসের কাতারেই রাখব: একজন সম্ভাব্য দারুণ খেলোয়াড়, যে যথেষ্ট টেস্ট না খেলার কারণে নিজের স্থানটা নিশ্চিত করতে পারেনি। কে জানে? দক্ষিণ আফ্রিকাকে যদি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো থেকে বাদ দেওয়া না হতো, তাহলে এ দুজনের একজন হয়তো আমার রেকর্ড ভেঙে দিত।

ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার
ছবি: টুইটার

‘সুনীল গাভাস্কার টেস্ট ব্যাটিংয়ের অনেক রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ভারতের এই ব্যাটসম্যান প্রশ্নাতীতভাবে একজন গ্রেট খেলোয়াড়। ১৯৮৭ সালে ৩৮ বছর বয়সে যখন অবসরের ঘোষণা দিল, তখনো টেস্টে শতক পাচ্ছিল সে। ওর সর্বোচ্চ রানের ইনিংস অপরাজিত ২৩৬। আর সব গ্রেট ক্রিকেটারের মতোই, সানি বিশ্বের শীর্ষ বোলারদের বিপক্ষে খেলেছে এবং তাদের শাসন করেছে। সে সবচেয়ে কঠিনতম পরীক্ষাগুলোও লেটার মার্ক পেয়ে পাস করেছে। তার টেস্ট শতকের ১৩টিই এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ১৯৭০ সালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওর অভিষেক হলো, তখন আমি অধিনায়ক ছিলাম। সেবার সে চারটি শতকসহ ৭৭৪ রান করেছিল।

‘সানির মনঃসংযোগ খুব ভালো ছিল, টেকনিকও। আর নিজের সেরা রূপে সে খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করত। সে ভালো বলকে খারাপ মনে করাত এবং হুক করতে কখনো ভয় পেত না। অনেক ভালো ব্যাটসম্যানই ওর মতো ছোটখাটো শরীরের—হানিফ (মোহাম্মদ), রোহান কানহাই, লিন্ডসে হ্যাসেট, নিল হার্ভে, এভারটন উইকস এবং ইতিহাসের সেরা ডন ব্র্যাডম্যান।

সোবার্সের আত্মজীবনী ‘টোয়েন্টি ইয়ার্স অ্যাট দ্য টপ’
ছবি: সংগৃহীত

‘সানি বহুবার ২০০ পেরিয়েছে, কিন্তু কখনো ৩০০ করেনি। শুধু ১০ জন মানুষ এটা করতে পেরেছে: তিন অস্ট্রেলিয়ান (ব্র্যাডম্যান দুবার করেছেন ৩৩৪ ও ৩০৪), চার ইংলিশ, এক পাকিস্তানি ও দুই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান।

‘আমার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সঙ্গী লরেন্স রো ১৯৭৪ সালে একবার ভালোই সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, যখন ব্রিজটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০২ করেছিল। কিন্তু টনি ক্রেগ তাকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেছে। সে খুব ভালো খেলোয়াড় ছিল, যার আরও ভালো করা উচিত ছিল ক্যারিয়ারে।’