অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাবে

>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো :
তিরন্দাজ রোমান সানা। ফাইল ছবি
তিরন্দাজ রোমান সানা। ফাইল ছবি

এ এক অদ্ভূত সময়! দিনগুলো কাটছে অস্বস্তির মধ্যে। জীবনের আরেক নাম গতি। অথচ পৃথিবী থমকে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ধনুক থেকে যে তীরটা ছুঁড়েছি, সেটা আর 'বুলস আই'য়ে পৌঁছাতে পারছে না। আটকে গেছে অদৃশ্য কোনো বোর্ডে।

আমি খুলনায়। বাসাতেই সময় কাটছে। সাত বছরের ক্যারিয়ারে এত লম্বা সময় মা-বাবার সঙ্গে থাকিনি। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি। আমাদের কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ ঢাকায় আছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কোচের সঙ্গে কথা হয়। প্রতিদিন কি অনুশীলন করব, সেগুলো কোচ পাঠিয়ে দেন। নাস্তার পরপরই অনুশীলন শুরু করি। হালকা ওয়ার্মআপ করে ফিজিক্যাল ফিটনেসের কিছু থাকলে তা শেষ করি। না থাকলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাবার প্র্যাকটিস করি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে পারলে একটু ঘুমাই। না হলে ভাতিজার সঙ্গে খেলি। সারাদিনে যা যা করলাম এর ভিডিও কোচকে পাঠাই। কোনো পরামর্শ থাকলে কোচের কাছে জানতে চাই।

সবার কাছেই এখন জীবনটা আগে। বেঁচে থাকলে অনেক খেলতে পারব। আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারব। এখন নিজেকে নিরাপদ রাখাটাই জরুরী। নিজে সচেতন থাকব, অন্যদের সচেতন করতে হবে। অন্যদের সচেতন করতে ফেসবুক পেজে ভিডিও শেয়ার করি। আমি একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গ্রুপে যুক্ত আছি। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই কিছু কাজও করছি।

আমার সাধ আছে অনেক, কিন্তু সাধ্য অতটা নেই। চাইলেও সব সময় অসহায়দের সাহায্য করতে পারি না। তারপরও চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও আপলোড করে সাড়া পেয়েছি। এলাকার প্রায় ৫০০ পরিবারকে সহায়তা করেছি। সবচেয়ে কষ্ট লাগে যখন দেখি সরকারি ত্রাণ কেউ চুরি করে। মনে হয়, ওরা কি মানুষ?

বছর দুয়েক আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বৃত্তি নিয়ে সুইজারল্যান্ডে বিশেষ প্রশিক্ষণে যাই। সেখানে দেখেছি মানুষ কতটা মানবিক হতে পারে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এটা ওদের দেখেই বুঝেছি। আমার এই লেখায় লুজানে থাকার সময়ের অভিজ্ঞতা ভাগ করার লোভ সামলাতে পারছি না। কেউ কাউকে চেনেন না, অথচ দেখা হলেই হাসিমুখে খোঁজখবর নিচ্ছেন। যাওয়ার সময় অকারণেও ধন্যবাদ দিচ্ছেন। কোনো মহিলা হয়তো গাড়ি থেকে ব্যাগ নামাতে পারছেন না, অমনি একজন দৌড়ে এসে সাহায্য করছে। আমার এক পোলিশ বন্ধু একদিন ভুলে বাস স্ট্যান্ডে লাগেজ ফেলে এসেছিল। দুই ঘন্টা পর গিয়ে দেখে লাগেজটি পড়ে আছে সেখানেই। অথচ এই দেশে মহামারীর সময়েও অবলীলায় অসহায় লোকের ত্রাণ চুরি হচ্ছে!

করোনাভাইরাসের আগে এ বছরটা আমার জন্য ছিল বিশেষ কিছু। জুনে টোকিও অলিম্পিকে খেলব, দেশকে ভালো কিছু উপহার দিব, সেটাই স্বপ্ন দেখতাম। এখন তো করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অলিম্পিকই পিছিয়ে গেছে। তাই বলে অবশ্য আমার স্বপ্নে মোটেও ধাক্কা লাগেনি। বরং এখন আরও বেশি সময় পাব নিজেকে প্রস্তুত করতে।

হাতে অফুরন্ত অবসর। প্রায়ই নিজের খেলার ভিডিওগুলো দেখি। হল্যান্ডে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জয়ের ম্যাচটা তো বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। এটা দেখি আর ওই দিনগুলোর কথা কল্পনা করি। স্বপ্ন দেখি বিশ্বকাপে সোনা জিতব। দুদিন আগে বিশ্বের এক নম্বর আর্চার ব্রাডি এলিসনের প্রামাণ্যচিত্র দেখলাম। বিশ্বকাপে সোনা জিতেছেন, রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের তিরন্দাজ। ওর ভিডিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি।

জানি না এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে। সব ঠিক থাকলে লম্বা বিরতির পর খেলায় ফিরবো, বেশ তরতাজাই লাগবে হয়তো। একঘেয়েমি পেয়ে বসেছিল। যদিও স্বাভাবিক স্কোরে ফিরতে দুই মাসের মতো লাগতে পারে।

শেষের আগে বলতে চাই, কোনো বিপদই দীর্ঘস্থায়ী নয়। অনিশ্চয়তার মেঘ অচিরেই কেটে যাবে। শুধু আর একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে আমাদের।