অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত ঘরোয়া ক্রিকেটে

>অনিয়মই নিয়ম ঘরোয়া ক্রিকেটে। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, কোনো দলকে পয়েন্ট-বঞ্চিত করতে ম্যাচ না খেলানো, পাতানো ম্যাচ—কী হয়নি এবার প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে!

পাতানো ম্যাচ, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, উইকেট খেলার অনুপযোগী বলে খেলা হতে না দেওয়া—এবারের প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের গায়ে লেগেছে সব ধরনের বিতর্কই। কিন্তু কাল বিসিবি কার্যালয়ে ক্লাব প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিসিডিএম-প্রধানের সভায় এসব প্রসঙ্গ কেউ তুললেন না, প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের অনিয়ম নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও হলো না।

কেন এসব নিয়ে আলোচনা হলো না, সেই প্রশ্নে এক ক্লাব প্রতিনিধির উত্তর, ‘কিছু বললেই তো ওনাদের বিরাগভাজন হয়ে যাব! সে জন্য বলিনি।’ সভা থেকে এই ‘মূক’ ক্লাব প্রতিনিধিদের প্রাপ্তি শুধু দুটি তারিখ। আজ থেকে শুরু হবে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের রেলিগেশন লিগ ও কাল থেকে সুপার লিগ। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিভাগ লিগের চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ দলের কর্মকর্তাদের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার দৃশ্যও তাঁরা সেখান থেকে অবলোকন করে এসেছেন।

কয়েক মৌসুম ধরে নানা অনিয়মে বিতর্কিত হয়ে পড়া প্রিমিয়ার লিগ এবার শেষ দিকে আসার আগ পর্যন্ত মোটামুটি বিতর্কহীন ছিল। কিন্তু প্রথম বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটের আকাশ থেকে সরেনি অশুভ মেঘ। বেশ কিছু ঘটনায় এবারও কলঙ্কিত ঘরোয়া ক্রিকেটের এই দুই আসর। বিসিবির প্রভাবশালী দু-একজন পরিচালক ও তাঁদের ছায়াতলে থাকাদের দলগুলোকে সুবিধা দিতে সব রকম অন্যায়েরই আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এসব অন্যায়ের সুবিধাভোগী দলগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাব, ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্র, ওল্ড ডিওএইচএস স্পোর্টস ক্লাব, উদয়াচল ক্লাব, কালিন্দী ক্রীড়া চক্র ও শেখ জামাল ক্রিকেটার্স। এদের পথ মসৃণ করতে বাকি ক্লাবগুলোর যখন যাদের ওপর জুলুম করা দরকার করা হয়েছে। সে জন্য প্রভাবিত করা হয়েছে ম্যাচ রেফারি, আম্পায়ার, স্কোরার, কিউরেটর ও মাঠকর্মীদেরও।

অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম, পয়েন্টের হিসাব-নিকাশ ঠিক রাখতে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে এবার অন্তত তিনটি পাতানো ম্যাচ হয়েছে। উত্তরা স্পোর্টিং ও ওল্ড ডিওএইচএস স্পোর্টস ক্লাবের মধ্যে লিগের প্রথম ম্যাচটাই নাকি ছিল ও রকম! উত্তরা স্পোর্টিং-শেখ জামাল এবং ওল্ড ডিওএইচএস-শেখ জামালের ম্যাচের দিকেও আছে একই অভিযোগের আঙুল। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দল হিসেবে উত্তরা এবং ষষ্ঠ দল হিসেবে ওল্ড ডিওএইচএস সুপার লিগে উঠলেও শেখ জামালকে তবু রেলিগেশন লিগেই খেলতে হচ্ছে।

তারা অবশ্য এর জন্য বৃষ্টিকেও দোষারোপ করতে পারে। আসলে ঢাকার ক্রিকেটের নিচের দিকের লিগগুলোর পয়েন্টের হিসাব খেলার মাঠে যতটা না হয়, অনেক সময় তার চেয়ে বেশি হয় টেবিলে বসে।
বৃষ্টির কারণে এবার সেই টেবিলের সিদ্ধান্তও অনেক সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ৯ ম্যাচে ৬ পয়েন্ট নিয়ে রেলিগেশন লিগের দল শেখ জামালকে
বৃষ্টির বাগড়ায় পয়েন্ট ভাগ করতে হয়েছে দুই
ম্যাচে। ইন্দিরা রোড, ওল্ড ডিওএইচএসেরও একই অবস্থা।
উল্টো অভিযোগও আছে। বৃষ্টি নেই, অথবা আগের রাতে বৃষ্টি হলেও বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে মাঠ শুকিয়ে খেলার উপযোগী হয়ে গেছে, এ রকম ক্ষেত্রেও মাঠ বা উইকেট ‘অনুপযুক্ত’ বলে খেলানো হয়নি অন্তত দুটি ম্যাচ। জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ওরিয়েন্ট ও বাংলাদেশ বয়েজের মধ্যে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে বেলা ১১টার পর থেকে মাঠ খেলার উপযোগী থাকলেও বল মাঠে গড়ায়নি। কারণ এর কোনোটিই বিসিবির প্রভাবশালীদের নিজেদের দল নয়। কাজেই তাদের কেউ যেন ম্যাচ জিতে পূর্ণ পয়েন্ট না পায়। লিগের শুরুর দিকে একই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ বয়েজ-পারটেক্সের ম্যাচেও। ওই খেলায় ম্যাচ কর্মকর্তাদের মাঠই বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি, সেটি খেলার অনুপযুক্ত বলে।

আগের রাতে পাশের উইকেটে পানি ঢেলে ম্যাচের উইকেটকে অনুপযুক্ত করে দেওয়ার ঘটনা আছে। আবার কালো মেঘের কারণে সকালবেলাতেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পরও ম্যাচ খেলানোর ঘটনাও আছে, যদিও আলোকস্বল্পতায় ঠিক পাশের মাঠেই হতে পারেনি খেলা। গত শুক্রবার বিকেএসপিতে ঘটেছে অদ্ভুত এক ঘটনা। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে রূপগঞ্জের ৮১ রানে ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর জুমার নামাজের বিরতি দেওয়া হয়। ম্যাচ কর্মকর্তারা চলে যান নামাজ পড়তে। কিন্তু নামাজের সেই বিরতি আর শেষ হলো না! শুরু হলো না খেলা। কেন হলো না, তা নিয়ে আছে দুই রকম বক্তব্য। কেউ বলছেন, রূপগঞ্জের এক খেলোয়াড় নাকি কুলি করে উইকেট ভিজিয়ে দিয়েছিলেন। আর ম্যাচ রেফারি আক্তার আহমেদের বক্তব্য, ‘কুলির ঘটনা আমিও শুনেছি। তবে মাঝে বৃষ্টিও হয়েছিল। কিন্তু পিচ কাভার ফুটো থাকায় বৃষ্টির পানিতে উইকেট ভিজে যায়। অনেক অপেক্ষা করেও উইকেট না শুকানোয় ম্যাচ আবার শুরু করা যায়নি।’
এসবের সঙ্গে নির্দিষ্ট দলের ম্যাচে চিহ্নিত আম্পায়ারদেরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া এবং পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগও আছে। তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটের একটি ঘটনা। খেলা শুরুর আগেই দুই ব্যাটসম্যানকে আম্পায়াররা বলে দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন ২০-৩০ এর বেশি রান না করেন। আউট হয়ে যান ২০-৩০ করেই। নইলে আম্পায়াররা বাধ্য হবেন তাঁদের আউট দিতে। পরে দুই ব্যাটসম্যানের একজন অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন অন্তত ফিফটি করতে দেওয়া হয়। আম্পায়ার ‘সদয়’ হয়ে অনুরোধটি রেখেছেন। ওই ব্যাটসম্যান পরে ৮০-এর ওপরে রান করে আউট হন।

বাংলাদেশের নিচের দিকের ক্রিকেটের এই চিত্র ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবারই জানা। কিন্তু ভয়েই হোক বা ভবিষ্যতে সুবিধা লাভের আশায়, এসব নিয়ে কথা কেউই বলে না। সিসিডিএমের প্রধান কাজী ইনাম আহমেদ তবু কাল মুঠোফোনে আশা দিলেন, ‘কোনো ক্লাব যদি এ রকম অভিযোগ আমাদের লিখিতভাবে জানায়, সিসিডিএম থেকে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে বোর্ডকেও অবহিত করব, যেন ভবিষ্যতে ক্রিকেটকে এসব সমস্যামুক্ত করা যায়।’

ঘরোয়া ক্রিকেটের এসব ঘটনা যে শুধু পয়েন্ট তালিকাটাকেই প্রভাবশালীদের মনের মতো করে সাজিয়ে দিচ্ছে, তা নয়। এর সবচেয়ে বিষাক্ত প্রভাব পড়ছে নবীন ক্রিকেটারদের ওপর। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, পেশিশক্তি প্রদর্শন এবং হীন ক্লাব রাজনীতি তাঁদের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার আবহাওয়াকে করে তুলেছে দূষিত। ভুলকেই ‘ঠিক’ জেনে বেড়ে উঠছে তরুণদের ক্রিকেটার সত্তা। খেলতে নামার আগেই তাঁরা জানেন আজ হারতে হবে, অথবা তাঁদের জয় ঠেকাতে পারবে না কেউ।

ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে পাওয়া এই ‘শিক্ষা’র কারণেই কিছুদিন আগে তৃতীয় বিভাগের একটি দলের তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে ‘হাসির পাত্র’ হয়ে পড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে ম্যাচে আম্পায়ার ‘নো’ বল না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ সাকিব হাতের ইশারায় মাহমুদউল্লাহ ও রুবেল হোসেনকে মাঠ ছেড়ে উঠে আসতে বলেছিলেন, সেই ম্যাচটি একসঙ্গে বসে দেখছিলেন ওই ক্রিকেটাররা। মাঠে সাকিবের ক্ষুব্ধ আচরণ দেখে তাঁরা হেসে খুন। একজন তো বলেই ফেললেন, ‘এক-দুইটা নো বল না দেওয়াতেই এত রাগ! সাকিব ভাইয়ের উচিত আমাদের থার্ড ডিভিশন ক্রিকেট খেলা। তাহলে যদি কিছু শিখত।’