অন্য ধাতে গড়া তারকা পেল ভারত

ভারতকে ঐতিহাসিক সিরিজ জেতানোর পর সতীর্থদের সঙ্গে ঋষভ পন্তছবি: টুইটার

জশ হ্যাজেলউডের ফুল লেংথ ডেলিভারি। ড্রাইভটা ছিল লং অনে। মিড অফে ফিল্ডার নেই, আশপাশে বলতে এক্সট্রা কাভারে একজন। বলটা বাউন্ডারি হবে তা একজন বাদে জানতেন গ্যাবার সবাই।

ঋষভ পন্ত সেই একজন। সে জন্য পন্তকে সাক্ষী মানার প্রয়োজন নেই। ড্রাইভ খেলার পর তাঁর জীবনবাজি রাখা দৌড় সব বুঝিয়ে দেয়। মাথায় বাউন্ডারি নয়, ঘুরপাক খাচ্ছিল জয়ের সমীকরণ মেলানো, ৩ রান!

তার আগে ১৩৭টি বল, উইকেটে থাকা ১৮০ মিনিট ধরে স্রোতের বিপরীতমুখী লড়াই করা পন্ত শেষ মুহূর্তেও দলের প্রয়োজনটা মাথায় রেখে দৌড়েছেন। ভীষণ রোমাঞ্চকর ও ঐতিহাসিক এক টেস্ট সিরিজে এই শেষ দৃশ্যটাও তো ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো। খেলাটা শুধু দলের জন্য!

অজিঙ্কা রাহানে না হয় ভারতের অধিনায়ক। কিন্তু বাইশ গজে এমন কিছু সময় আসে যখন অধিনায়ক ড্রেসিং রুমে আর ময়দানে নেতৃত্ব দিতে হয় অন্য কাউকে। তাও এমন এক সিরিজে যার ফয়সালা হচ্ছে শেষ দিনের শেষ সেশনে।

এই চাপ মাথায় নিয়ে পন্তের নেতৃত্ব দেওয়ার নমুনাটা একবার দেখুন, পাঁচে নেমে চেতেশ্বর পূজারার সঙ্গে ১৪১ বলে ৬১, যেখানে পন্তের অবদান ৩৪। মায়াঙ্ক আগারওয়ালের সঙ্গে ৩৭, যেখানে তাঁর ২৩, ওয়াশিংটন সুন্দরের সঙ্গে ৫৩, এখানেও পন্তের ২৩। এরপর চোস্ত বোলার শার্দুলের সঙ্গে ৭ রানের জুটিতে ৫ ও সাইনির সঙ্গে ৪।

২৩ বছর বয়সী পন্ত টি-টোয়েন্টি যুগের ব্যাটসম্যান। গ্যাবায় ন্যূনতম ২৫০ তাড়া করেও কেউ জিততে পারেনি, সেখানে ৩২৮ শেষ দিনে ফাটল ধরা উইকেটে। ভাবা যায়!

আশি কিংবা নব্বুই নয়, এই যুগেও বেশির ভাগ ব্যাটসম্যান ঠুকঠুক করে টেস্টটা ড্র করতে পারলে বর্তে যাবেন। সেখানে পন্তের ৮৯ রানের ইনিংসে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক রান (৪২) চার-ছক্কা থেকে।

পন্তের এই ইনিংসের দারুণ ব্যাখ্যা হতে পারে হর্শা ভোগলের টুইট, 'ঋষভ পন্ত, সুপারস্টার, একটু অন্য ধাতে গড়া।'

যে ধাতেরই হোক, পন্তের সঙ্গে অন্তত একটি জায়গায় দারুণ মিল মহেন্দ্র সিং ধোনির। ২০ ওভারে ১০০, সেখান থেকে ১০ ওভারে ৫৩ ; হাতে ৫ উইকেট।

এমন লক্ষ্যে ধোনি থাকলেও ব্যাটিংটা তো পন্তের মতোই, দলকে জেতাতে ভয়ডরহীন ব্যাটিং। সে ধারায় পূর্বসুরিকে (উইকেটরক্ষণ) আজ একটি জায়গায় পেছনেও ফেলেছেন পন্ত।

দলকে সিরিজ জেতানোর সঙ্গে পন্ত নিজেও টেস্টে দেখা পেয়েছেন হাজার রানের। ভারতীয় উইকেটরক্ষকদের মধ্যে তিনি দ্রুততম। ধোনির ৩২ ইনিংসের রেকর্ডটা তিনি ভাঙলেন ২৭তম ইনিংসে। চার বছর আগেও কথা উঠেছে, ভারতীয় দলে ধোনির বিকল্প কেউ থাকলে, কিংবা ধোনিকে কেউ বসিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখলে তিনি পন্ত।

ধোনি আগেই অবসর নেওয়ায় তুলনাটা আর উঠছে না। তবে একটি বিষয় প্রমাণিত, এই ভারতীয় দলের গভীরতা অনন্য। বিরাট কোহলি নেই তো কী হয়েছে, হর্শার ভাষায়, আছে 'ক্লাস অব ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ ঋষভ পন্ত ও ওয়াশিংটন সুন্দর। আছে ক্লাস অব ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ শুবমান গিল।'

তিনজনই ভারতের নতুনের কেতন উড়িয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে শত্রুভাবাপন্ন দেশের মাটিতে। পন্ত সম্ভবত ছাপিয়ে গেছেন সবাইকে। শেষ ইনিংসে ঐতিহাসিক জয় এনে দেওয়ার পরও ‘সম্ভবত’ কথাটা রাখতে হচ্ছে।

কারণ ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে শুবমানের ৯১ যেমন অমূল্য, তেমনি প্রথম ইনিংসে সুন্দরের ফিফটি, দ্বিতীয় ইনিংসে ২২ ও ৪টি উইকেটও টাকায় নয়, দলের জন্য নিংড়ে দেওয়ার মানসিকতায় মেলে।

কিন্তু পন্তু তবু কাগজে-কলমে সবাইকে ছাপিয়ে! চার টেস্টের এই সিরিজে ভারতের হয়ে তিনি সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক (২৭৪)। গড়ও সর্বোচ্চ ৬৮.৫০। ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাটিং গড়ে দ্বিতীয় সেরা শুবমান (৫১.৮০)।

কোহলিবিহীন ব্যাটিং অর্ডারে পূজারা-রাহানেরা থাকতেও নতুনের কেতন ওড়ার কায়দাটা তাহলে বোঝা গেল! আরও একটু খোলাসা করে বলা যায়, ব্রিসবেনের এই গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়া সর্বশেষ হেরেছিল ১৯৮৮ সালে। পন্ত জন্মছেন এর ৮ বছর পর।

মেলবোর্নের পর সিরিজ সমতায় ছিল ১-১ ব্যবধানে। সিডনিতে ভারতের বুক চিতিয়ে ড্র করায় দারুণ ভূমিকা ছিল পন্তের ৯৭ রানের ইনিংসের। আর গ্যাবায় সিরিজজয়ে ভূমিকা রাখল প্রায় একই সুর-তাল-লয়ে খেলা এই ইনিংসটি।

অর্থাৎ সিরিজে ভারতের ভাগ্য নির্ধারনে পন্তের অবদান তাঁর ব্যাকরণের বাইরে ব্যাটিং নিয়ে নিন্দুকেরাও অস্বীকার করতে পারবেন না। সত্যিকারের ম্যাচ উইনাররা যেমন হয়ে থাকেন আর কি!

পন্তের নিজের মুখেই শুনুন, 'আমার জন্য স্বপ্নের সিরিজ। টিম ম্যানেজমেন্ট সব সময় বলেছে, তুমি ম্যাচ উইনার। সব সময় দল জেতাতে মাঠে নামবে। প্রতিদিন এটাই মাথায় ছিল--আমি ভারতকে অনেক ম্যাচ জেতাতে চাই। তাই আজ ভালো লাগছে।'

রবি শাস্ত্রী যেহেতু প্রধান কোচ তাই শিষ্যের প্রশংসার সঙ্গে ভুলটাও স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, 'সে ম্যাচ উইনার বলেই বিদেশের মাটিতে সিরিজে খেলানো হয়। এই সিরিজে কিন্তু সেটাই করে দেখাল। এমনকি সিডনিতে সে যেভাবে ব্যাট করেছে, আর ঘন্টাখানিক থাকলেই জিততাম।'