জালাল আহমেদ চৌধুরীর প্রয়াণ
অলংকার হয়েই থাকবেন ‘জালাল ভাই’
না–ফেরার দেশে চলে যাওয়া জালাল আহমেদকে কখনোই হারিয়ে যেতে দেবে না এ দেশের ক্রিকেটাঙ্গন।
জালাল আহমেদ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘কঙ্কালে অলংকার দিয়ো’। ২০০৪ সালের জুনে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মারা যান ক্রিকেটার তামিম বশির। প্রথম আলোয় ওই শিরোনামে তাঁর জন্য শোকগাথা লিখেছিলেন জালাল আহেমদ চৌধুরী।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সে লেখার প্রতিটি শব্দে মিশেছিল অনন্তলোকে পাড়ি জমানো ছাত্রের জন্য একজন শোকার্ত শিক্ষকের হাহাকার। তামিম বশিরের অকালে চলে যাওয়া শোকস্তব্ধ করেছিল গোটা ক্রিকেটাঙ্গনকেই। কিন্তু জালাল আহমেদ চৌধুরী যে ভাষায় সেই শোকের অনুবাদ করেছিলেন, সে রকম শুধু তিনিই পারতেন।
‘সব্যসাচী’ বিশেষণটা দারুণভাবেই যায় তাঁর নামের সঙ্গে। ক্রিকেটার ছিলেন, কোচ হয়েছেন, করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতা। খেলাটাকে এরপর আর কীভাবে দেখা যায়, সেটা কারও জানা আছে কি না, কে জানে! ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণে তাঁর শব্দচয়নে যে মাধুর্য মিশে থাকত, বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যেই সেটি অনন্য। সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার পরও জালাল আহমেদ ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িয়ে থেকেছেন নানাভাবে। সর্বত্রই রেখে গেছেন খেলাটার প্রতি তাঁর আবেগ আর আন্তরিকতার চিহ্ন।
কাছে-দূরের সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে সেই জালাল আহমেদ চৌধুরী ৭৪ বছর বয়সে গতকাল পাড়ি জমালেন না-ফেরার দেশে, কয়েক দিন আগেই যেখানে চলে গেছেন আম্পায়ার নাদির শাহও। ধানমন্ডি ৪ নম্বর মাঠের ক্রিকেট-আড্ডায় সঙ্গী ছিলেন দুজন। পরলোকেও নিশ্চয়ই আড্ডা জমে উঠবে তাঁদের, সেখানেও থাকবে শুধুই ক্রিকেট।
জালাল আহমেদ তাঁর সর্বশেষ দুটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ১০ সেপ্টেম্বর। তার একটিতে ছিল নাদির শাহর আত্মার শান্তি কামনা। নিজে অসুস্থ থেকেও বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখতে দেখতে জালাল আহমেদ লিখেছিলেন, ‘রোগশয্যায় শুয়ে খেলা দেখছি। টিভির পর্দাজুড়ে আম্পায়ার সৈকতের (শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ) ছবি ভাসলেই মনে হয় অন্য প্রান্তে নাদির শাহ আছে। ওভার শেষ হলে মুখোমুখি দেখতে পাব। মুহূর্তকালের কল্পনা ভেসে যায় বাস্তবতার পাথুরে আঘাতে। নাদির শাহ তো আর আসবে না। তার সদাহাস্য মুখ, মন আর ক্রিকেটীয় মাধুর্য নিয়ে সে এখন প্রকৃতিতে একাকার...।’ এর মাত্র ১১ দিনের মাথায় জালাল আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রিয় ‘জালাল ভাই’ও সেই প্রকৃতিরই অংশ হয়ে গেলেন।
গতকাল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জালাল আহমেদ চৌধুরীর জানাজায় এসে তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন বললেন, ‘কোচ হিসেবে জালাল ভাই ছিলেন বন্ধুসমতুল্য।’ আসলেই তাই। খেলোয়াড়দের মনের কথা পড়তে পারতেন জালাল আহমেদ। বাংলাদেশ দলের সর্বশেষ জিম্বাবুয়ে সফরের একটা ঘটনা। মাহমুদউল্লাহ যেদিন টেস্ট ক্রিকেট থেকে আকস্মিক অবসর নিলেন, সে রাতে সিরিজ কাভার করতে যাওয়া এই প্রতিবেদককে ফোন করেন জালাল আহমেদ। কুশল বিনিময়ের পর তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আচ্ছা, রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) হুট করে এটা কী করল! কিছু জানো? ও তো ঠান্ডা মাথার ছেলে...।’
জালাল আহমেদ ক্রিকেটারদের কতটা আপন ছিলেন, সেটা আসলে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য যখন যে জায়গাতেই ছিলেন, সেখানেই তাঁর ভাবমূর্তি ছিল আপন মানুষের। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতাও তাই হারাল একজন অকৃত্রিম অভিভাবককে। ক্রিকেটের সুসময়-দুঃসময়—সব সময়ই তাঁর কথা, তাঁর বিশ্লেষণ শুনতে চেয়েছেন এ দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকেরা। জালাল আহমেদ কখনো বক্তা হয়ে, কখনো পরামর্শক হয়ে তাঁদের সঙ্গে থেকেছেন। তাঁর বর্ণনায় ক্রিকেটের জটিল সমীকরণও হয়ে উঠত সহজবোধ্য, সুললিত।
জালাল আহমেদের দুই সন্তানই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। ২০১১ সালে স্ত্রী বিয়োগের পর অনেকটাই নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন তিনি। একাকী জীবনে আশ্রয় খুঁজতেন ক্রিকেটে। কাল সেই ক্রিকেট থেকেও দূরে চলে গেলেন তিনি।
আসলেই কি গেলেন! না বোধ হয়। এ দেশের ক্রিকেটাঙ্গন তাঁকে হারিয়ে যেতে দেবে না কখনোই। তামিম বশিরের কঙ্কালে অলংকার পরানো জালাল আহমেদ চৌধুরীর নামটাও অলংকার হয়েই থাকবে এ দেশের ক্রিকেটে, ক্রীড়া সাহিত্যে। তিনি থেকে যাবেন সবার হৃদয়ে।