অস্ট্রেলিয়া কি ভয় পাচ্ছে ভারতকে?

স্মিথের চেহারায় এমন আগ্রাসন!ছবি : রয়টার্স

কয়েকটা দৃশ্যপট বিশ্লেষণ করা যাক।

প্রথম দৃশ্যের নায়ক স্টিভেন স্মিথ। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। টেস্টে ‘ব্র্যাডম্যানীয় গড়’ আর একের পর এক সেঞ্চুরি যাকে অতুলনীয় করে তুলেছে। কিন্তু সেই স্মিথই ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে কেমন যেন অচেনা হয়ে রইলেন। প্রথম টেস্টে সাকল্যে দুই রান করলেন, দ্বিতীয় টেস্টে আট। চার ইনিংস মিলিয়ে মোটে দশ রান তোলা স্মিথকে রীতিমতো নাকাল করে ছেড়েছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ঘূর্ণি। সেই স্মিথই সিডনিতে তৃতীয় টেস্টে যথেষ্ট সাবধানী। প্রথম দুই টেস্টে যেসব ভুল করেছিলেন, এই টেস্ট সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার একটা প্রত্যয় দেখা গেল তাঁর ব্যাট করা দেখে। ফলাফলটাও এল হাতেনাতে। নিজের প্রিয় প্রতিপক্ষ ভারতের বিপক্ষে আবারও সেঞ্চুরি করেই রানে ফিরেছেন তিনি। ১৩১ রানের রাজসিক এক ইনিংসে প্রত্যাবর্তন ঘটল স্মিথের।

সেঞ্চুরি করার এই অভিজ্ঞতা স্মিথের নতুন নয়। এক ভারতের বিপক্ষেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন আটটা। সব মিলিয়ে ২৭ বার শতরানের গণ্ডি ছাড়িয়েছেন। যে অনুভূতিটা এত দিনে ডালভাত হয়ে যাওয়ার কথা, সে স্মিথই এবার সেঞ্চুরি করে যেন একদম অচেনা মানুষ হয়ে গেলেন! স্মিথ ঠান্ডা মাথায় খেলতে অভ্যস্ত। সাধারণত তাঁর উদ্‌যাপনও হয় শীতল। কিন্তু এ যাত্রায় উপচে পড়া আনন্দ ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ব্যাটটা বাতাসে ছুড়ে মারার ভঙ্গি করলেন! যেন বোঝাতে চাইলেন, আগের দুই টেস্টে আমার বাজে ব্যাটিং নিয়ে যত কথা, কাটাছেঁড়া ও পরিসংখ্যান ঘাঁটা হয়েছে, তার জবাব এই ব্যাট, এই ইনিংস! চোখ–মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আগ্রাসন, উদ্‌যাপনটা ঠিক স্মিথসুলভ নয়। শেষ কবে একটা সেঞ্চুরি করে এভাবে পাগলের মতো উদ্‌যাপন করেছিলেন স্মিথ?

এবার আশা যাক দ্বিতীয় দৃশ্যপটে। ওয়ানডে সিরিজে কুঁচকির চোটে পড়ে মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। পরে শুরু হতে যাওয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে তো বটেই, টেস্ট সিরিজেও খেলতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংশয়। প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া যেমন দাপট দেখিয়ে জিতেছে, সেটার পর ওয়ার্নার না এলেও কোনো সমস্যা নেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে গেছে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়ের পর। ওপেনার জো বার্নসের ফর্মহীনতার কারণে তড়িঘড়ি করে ওয়ার্নারকে স্কোয়াডে ডেকেছে অস্ট্রেলিয়া। শুধু সেটাই নয়, মূল দলের জায়গা দিয়ে দিয়েছে এই ওপেনারকে। ওয়ার্নার নিজেও এই টেস্ট শুরুর আগে ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, টেস্ট খেলার মতো এখনো ফিট নন তিনি। এখনো দৌড়াতে সমস্যা হচ্ছে তাঁর। বিভিন্ন সময়ে পেশাদারিত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এত কিছুর পরও যখন ওয়ার্নারকে দলে রেখেছিল, এমন সিদ্ধান্ত চমকে দিয়েছিল অনেককেই। শেষ কবে একজন চোটে পড়া খেলোয়াড়কে এত তাড়াতাড়ি খেলানোর জন্য ব্যাকুল হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া?

ব্যাটিং করার সময় রীতিমতো খুঁড়িয়েছেন ওয়ার্নার। পিচের মধ্যে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে তো বটেই, ওয়ার্নারের সেই চিরায়ত ফুটওয়ার্ক কিংবা মুভমেন্ট, কিচ্ছু দেখা যায়নি। অভিষিক্ত মোহাম্মদ সিরাজের শরীরের বাইরে পিচ করা একটা বল ড্রাইভ করে স্লিপে চেতেশ্বর পূজারাকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন, আট বলে মাত্র পাঁচ রান করে।

দৌড়াতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওয়ার্নারের।
ছবি : টুইটার

এ তো গেল ব্যাটিংয়ের কথা। সিডনি টেস্ট শুরুর কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে ওয়ার্নার জানিয়েছিলেন, ‘দুই দিন ধরে আমি দৌড়াই না। আজ আর আগামীকাল দেখি, নিজের অনুশীলন দেখে বুঝতে পারব আমার অবস্থা কেমন, আমি শতভাগ ফিট কি না। আমি নিজেই সন্দিহান। কিন্তু আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু করছি ফিট হওয়ার জন্য। যদি আমি শতভাগ ফিটও না হই, তা-ও আমি চেষ্টা করব খেলতে।’

ফিল্ডিংয়ের সময় ওয়ার্নারের ওই কথাগুলোই যেন বারবার ফিরে আসছিল। ফিল্ডিংয়ে ক্ষিপ্রগতির ওয়ার্নার এই ম্যাচে যেন একদম অচেনা। রোহিত শর্মার চারগুলো দৌড়ে ধরার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাঁর, মাঠের মধ্যে যেন ‘জগিং’ করছিলেন। অধিনায়ক টিম পেইনও তাঁকে এমন এমন জায়গায় ফিল্ডিং করাচ্ছিলেন, যেখানে থাকলে তুলনামূলকভাবে কম খাটনি হয় ওয়ার্নারের। ফিল্ডিং করছেন শর্ট ফাইন লেগে, কিংবা স্লিপে। ক্রিকেট যিনি বোঝেন না, তিনিও ওয়ার্নারের অবস্থা দেখে একঝলকে বলে দিতে পারবেন, এই খেলোয়াড় ফিট নেই।

অস্ট্রেলিয়া কি তাহলে অ্যাশেজের মতো দিরিজের চেয়েও বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিকে গুরুত্ব দিচ্ছে? ফিট না থাকার পরেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মতো অতিপেশাদার বোর্ডের ওয়ার্নারকে তড়িঘড়ি করে ডেকে আনা কিংবা সেঞ্চুরির পর স্মিথের অচেনা উদ্‌যাপন—সবকিছু কি তাহলে একটা দিকেই ইঙ্গিত করছে? প্রথম টেস্টে ভারতকে নাকাল করে সাবেকদের মুখ খুলে দেওয়া অস্ট্রেলিয়া কি তাহলে এই টেস্ট সিরিজে ভারতকে ভয় পাচ্ছে?

দৃশ্যপটগুলো তো তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে!