অ্যান্ডারসন দেখালেন স্পিনিং উইকেটেও পেস বোলিং সম্ভব

আজ অ্যান্ডারসনের প্রথম ওভার বহুদিন মনে থাকবে সবার।ছবি: বিসিসিআই

আম্পায়ার নিতিন মেননকে চাইলে ধন্যবাদ দেওয়া যায় দুটি কারণে। এক, ইনিংসের ২৭তম ওভারটি যে ছন্দে হচ্ছিল সেটা চললে টানা অমন দুটি বল হয়তো দেখা যেত না। আর দুই, তাঁর ওই সিদ্ধান্তের কারণেই তো নাটকটা এত পূর্ণতা পেল।

দিনের ১৪তম ওভারে এসে প্রথম বল হাতে পেলেন জিমি অ্যান্ডারসন। স্ট্রাইকে আগের বলেই ফিফটি করা শুবমান গিল। সাধারণ এক বল। বেশ অনায়াসে খেললেন দারুণ ছন্দে ব্যাট করা গিল। গত মাসেই ব্রিসবেনে এমন এক পঞ্চম দিনে গিলের ইনিংসটিই জয়ের আশা দেখিয়েছিল ভারতকে। বিশ্ব রেকর্ড গড়ে জয়ের লক্ষ্যে নামা ভারতকে আজও সে পথে রেখেছিলেন গিল।

পরের বলটাই ভারতকে থমকে দিল। অনেক কিছুই ঘটল। আগের চেয়ে আরেকটু সামনে বল ফেললেন অ্যান্ডারসন। ওদিকে গিলও সে লেংথ দেখে পা ফেললেন। উইকেটের অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করছিলেন বলে এ বলটা এমনিতেও একটু ভেতরে ঢুকত। কিন্তু অ্যান্ডারসনের বলটা যেন স্পিনারের বাক নিল। রিভার্স সুইং! গিলের স্বাভাবিক স্টান্স হঠাৎ বেশ ভঙ্গুর ঠেকল। গিলের ব্যাট ও প্যাডের মাঝে ফাঁকা জায়গা খুঁজে নিয়ে উপড়ে নিয়ে গেল স্টাম্প।

শুধু স্পিনকে ভরসা মানেনি ইংল্যান্ড।
ছবি: টুইটার

দুর্দান্ত এক বলের পর বিরতি। অজিঙ্কা রাহানেকে করা প্রথম বলটা গেল অনেক বাইরে দিয়ে। কিন্তু চতুর্থ বল দেখে চোখ কচলানোর দশা। আবারও ফুল লেংথের এক বল। আরেকটা রিভার্স সুইং। যদিও যেভাবে ভেতরে ঢুকেছে তাতে একজন অফ স্পিনারও গর্ব করতেন ওই বল নিয়ে। নিচু হওয়া বলটা ভেতরে ঢুকে আঘাত হানল রাহানের প্যাডে। জোরালো আবেদনেও মন গলল না মেননের, নট আউট।

রিভিউ নিল ইংল্যান্ড। রিভিউতে দেখা গেল সবকিছুই ঠিক, শুধু বলটা যখন প্যাডে আঘাত হেনেছে তখন বলের অর্ধেক বাইরে ছিল, অর্থাৎ ‘আম্পায়ারস কল’। মেনন যদি আউট দিতেন, তাহলে ভুল হতো না। আবার আউট না দেওয়াতেও দোষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে যাত্রা বেঁচে গেলেন রাহানে।

একটা সাধারণ বল, একটি রিভার্স সুইং-এ ছন্দে লাভ হলো না! তাই অ্যান্ডারসন সিদ্ধান্ত নিলেন ছন্দে ব্যতিক্রম টানতে। পরের বলটা করতে আবার ক্রিজ ব্যবহার করলেন। আরেকটু কোণ সৃষ্টি করে বল ছাড়লেন। আবারও ফুল লেংথ ডেলিভারি। ড্রাইভ করতে পছন্দ করা যেকোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাট একটু হলেও নড়বে, পা একটু সরবে। রাহানেরও তা-ই হলো। ব্যস, ওটুকুই। এতেই যে সূক্ষ্ম ফাঁক সৃষ্টি হলো, সেটাই যথেষ্ট হলো অ্যান্ডারসনের জন্য। আবার সেই রিভার্স সুইং। রাহানেকে জায়গায় আটকে রেখে ব্যাট-প্যাডের মাঝখান দিয়ে বল চলে গেল। রাহানে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখেন তাঁর অফ স্টাম্প নেই। ইংলিশদের বুনো উল্লাস আর হতাশা নিয়ে বিরাট কোহলির মাথা নাড়ানো।

ওভারের শেষ বলে নিজের ছন্দে ফিরলেন অ্যান্ডারসন। দুর্দান্ত এক রিভার্স সুইং শেষে আবারও একটা সাধারণ বল। সে বল খেলতে ঋষভ পন্তের কোনো কষ্ট হলো না। চেন্নাইয়ের স্পিন-বান্ধব উইকেটের পঞ্চম দিনে পেস বোলিং পাঠ শেষে আবার ফিল্ডিংয়ে অ্যান্ডারসন।

রিভার্স সুইংয়ের ব্যবহার শেষ করে এবার অন্য দীক্ষা দিতে নামলেন অ্যান্ডারসন। পন্তের বিপক্ষে রিভার্স সুইং কাজে দেবে না। ওদিকে কোহলিও ব্যাট-প্যাডের মাঝে ফাঁকা রেখে অফসাইডে খেলার মতো ভুল করছেন না। এর মধ্যেই একটু বেশি বাইরে বল ফেলায় পন্তের হাতে চার খেয়েছেন। পন্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন, ৪ উইকেট পড়লেও আগ্রাসী হতে আপত্তি নেই তাঁর। সে চারের পরই শর্ট কভারে জো রুট এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখের সামনে একজন ফিল্ডার রেখে দেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন পন্ত। ওদিকে টানা অফ স্টাম্পকে লক্ষ্য করে বল করে গেলেন অ্যান্ডারসন।

পন্তের মতো ব্যাটসম্যান বেশিক্ষণ রান না করে থাকতে পারেন না, এটাকেই অস্ত্র বানিয়েছেন অ্যান্ডারসন। চোখের সামনে দুজন ফিল্ডার, তাই অফসাইডে শট খেলতে পারছিলেন না। আবার অফ স্টাপ ও এর বাইরে বল করায় লেগ সাইডেও খেলা হচ্ছিল না পন্তের। বেশ কয়েকবার ব্যাটের পাশ দিয়ে বলও চলে গেল। স্পেলের চতুর্থ ওভারেই অ্যান্ডারসন পুরস্কার বুঝে নিলেন। প্রথম বলটি স্টাম্পের বাইরে ফেললেন, পন্ত ছেড়ে দিলেন।

টানা দুই বলে রাহানেকে নাস্তানাবুদ করেছেন অ্যান্ডারসন।
ছবি: টুইটার

দ্বিতীয় বলটা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকল। কোনাকুনি ব্যাটে খেলতে গিয়েও হলো না। একটুর জন্য ব্যাটের স্পর্শ পেল না বল। পরের বলটাতেই অ্যান্ডারসন দেখালেন কেন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি পেস বোলার তিনি। আবারও সেই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে অফ স্টাম্পের ওপর বল ফেললেন। এবারও লেগ সাইডে খেলতে চাইলেন পন্ত। কিন্তু কাটারের ব্যবহারও ভালো জানা অ্যান্ডারসনের। এ বলটায় গতি একটু কমিয়ে দিয়েছিলেন। উইকেটের এই সাইডে ফিল্ডার রেখে পাতা ফাঁদটা দেরিতে টের পেয়ে শটটা বদলাতে চেয়েছিলেন পন্ত। কিন্তু ততক্ষণে বল ব্যাটে চলে এসেছে। ব্যাটের ছোঁয়া লেগে গেল শর্ট কভারে! যে ফিল্ডারকে ঘিরে এতক্ষণ পরিকল্পনা করে বল করছিলেন অ্যান্ডারসন। রুট এত সহজ ক্যাচ ফেলার লোক তো নন।

৪ ওভার, ৫ রান আর ৩ উইকেট। চেন্নাইয়ের পঞ্চম দিনে বল করতে এসে অ্যান্ডারসনের স্পেল তখন এমন দেখাচ্ছে। অথচ গতকালই রবিচন্দ্রন অশ্বিন দেখিয়েছেন চেন্নাইয়ে স্পিনাররা রাজত্ব করবেন। আজ সকালেও চেতেশ্বর পূজারাকে জ্যাক লিচ যে বলে আউট করেছেন, সেটা ওই উইকেটের সুবাদেই। চরম ধৈর্য নিয়ে ব্যাট করতে থাকা পূজারাকে বাড়তি স্পিন ও বাউন্সে চমকে দেওয়ার কাজটা চেন্নাইয়ের উইকেটের কারণেই করতে পেরেছিলেন লিচ। সে কারণেই সকাল থেকে লিচের সঙ্গে বল করতে থাকা জফরা আর্চারকে সরিয়ে নিয়ে ডম বেসকে বোলিংয়ে এনেছিলেন রুট। কিন্তু কোহলি-গিল ঠিকই সামলে নিচ্ছিলেন দুই স্পিনারকে।

বল একটু পুরোনো হতেই তাই অ্যান্ডারসনকে ডেকে পাঠানো। উইকেট যে স্পিন-বান্ধব, সেটা লিচ ও বেসের পাওয়া উইকেটগুলো দেখেই বোঝা গেছে। বাড়তি বাঁক ছিল, অনাকাঙ্ক্ষিত বাউন্স ছিল। গড়পড়তা স্পিনারকেও ভয়ংকর মনে করানোর সব উপকরণ ছিল। এর মধ্যেই অ্যান্ডারসন দেখিয়ে দিলেন দক্ষতা থাকলে আর চিন্তাশক্তি ব্যবহার করলে যেকোনো কন্ডিশনেই উইকেট পাওয়া সম্ভব। গতকাল রাওয়ালপিন্ডিতে যেমন শেষ দিনে স্পিনার নয়, পাকিস্তানের দুই পেসারই ধস নামিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে।

চট্টগ্রামে বাংলাদেশের একমাত্র পেসার ছিলেন মোস্তাফিজ।
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ ইদানীং প্রায় সময় ঘরের মাঠে একজন পেসার নিয়ে টেস্ট খেলতে নামছে। অজুহাত, স্পিন-বান্ধব উইকেট। এ নিয়ে চট্টগ্রাম টেস্টের মাঝপথে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, ‘আমি সব সময় দলে পেসারদের চেষ্টা করার পক্ষে। কিন্তু এমন উইকেটে এটা করা কঠিন। এটাই চ্যালেঞ্জ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভিজ্ঞ কেমার রোচ ও শ্যানন গ্যাব্রিয়েল সম্ভবত ২৩০ রানে ৩ উইকেট পেয়েছে। এ উইকেট ফাস্ট বোলারদের জন্য কঠিন উইকেট। গতি নেই, বাউন্স নেই। বাংলাদেশে টেস্ট খেলার ক্ষেত্রে এসব মাথায় রাখতে হয়।’

কঠিন উইকেটে বল করতে শেখাও তো টেস্ট খেলারই অংশ। ঘরের মাঠে চেনা কন্ডিশনেই যদি পেসারদের পরীক্ষা করা না যায়, তবে তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে শিখবেন কবে? অ্যান্ডারসন আজ যে স্পেল করেছেন, সেটা এমন হাজারো পরীক্ষা থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা বলেই পেরেছেন। স্পিন-বান্ধব উইকেটেও যে পেসাররা কিছু করতে পারেন, এ বিশ্বাস রাখায় সেটা সম্ভব হয়েছে। কোহলির স্টাম্প ওপড়ানো স্টোকসের বলটাও সে বিশ্বাসের কথা বলে। শেষ দিনের উইকেটে ইংলিশ পেসাররা নিয়েছেন ৫ উইকেট।

বাংলাদেশের কন্ডিশনেও একসময় দুজন পেসার নিয়মিত খেলেছেন। ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ভয়ংকর স্পিন-বান্ধব উইকেট বানানো ও স্পিনার লেলিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হওয়ার পর থেকে একটু ব্রাত্য হয়ে উঠেছেন পেসাররা। কন্ডিশন ব্যবহার করে জিততে চাওয়ায় ক্ষতি নেই। কিন্তু পেসারদের ওপর বিশ্বাস রাখার অভ্যাস গড়ার চেষ্টাটাও তো দরকার!