অ্যান্ডারসন-ব্রডের ‘দ্য লাস্ট ড্যান্স’

টেস্ট ক্যারিয়ারে একসঙ্গে এটিই শেষ ছবি হয়ে থাকবে জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রডের?ছবি: এএফপি

১.

মাইকেল জর্ডানের আক্ষেপটা হয়তো এখনো আছে।

১৯৯৮ সালের মৌসুম শুরুর আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, শিকাগো বুলসের কোচ হিসেবে থাকছেন না ফিল জ্যাকসন। দলটা এগোতে চায় নতুন পথে, জ্যাকসন এবং কয়েকজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়—স্কটি পিপেন, ডেনিস রডম্যানরা সে পরিকল্পনায় নেই। জর্ডানও নতুন ‘সেট-আপে’ থাকতে চাননি আর। সে মৌসুমে দ্বিতীয়বারের মতো টানা তৃতীয় এনবিএর চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে বুলস, যে মৌসুমটাকে জ্যাকসন বলেছিলেন ‘দ্য লাস্ট ড্যান্স’। দলটার কাহিনি নিয়ে ২০২০ সালে এসেছে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র। সেখানে নিজের আক্ষেপটা সরাসরিই জানিয়েছিলেন জর্ডান। অন্তত আরেকবার দলটাকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার চেষ্টা করার সুযোগটা করতে না পারার আক্ষেপ।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে বাস্কেটবল থেকে অবসর নেন জর্ডান। ওই আক্ষেপটাকে সঙ্গী করেই। ১৯৯৮ সালের পর শিকাগো বুলস আর চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে পারেনি।

২.

জেমস অ্যান্ডারসনের মুখে হাসি। ডান হাতের গ্লাভসটা খুলে নিয়ে হেলমেটে রেখেছেন, বাঁ হাতেরটি খুলতে উদ্যত। স্টুয়ার্ড ব্রড হাসছেন না, ডান হাত দিয়ে চুল ঠিক করছেন, চোখেমুখে স্বস্তির ভাবটা স্পষ্ট। শেষ উইকেট জুটিতে দুজন মিলে দুই ওভার নিরাপদে পার করে দিয়েছেন, সিডনিতে রোমাঞ্চকর ড্র নিশ্চিত হয়েছে তাতেই। দুঃস্বপ্নসম গত অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের একমাত্র সুখস্মৃতি ওই সিডনি টেস্টই।

অ্যান্ডারসন ও ব্রড—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের একসঙ্গে শেষ ছবি কি হয়ে থাকবে সেটিই? অস্ট্রেলিয়ার ওই সফরই কি তাঁদের ‘দ্য লাস্ট ড্যান্স’?

টেস্টে তাঁরা দুজন 

হোবার্টে সিরিজের শেষ টেস্টে অ্যান্ডারসন ছিলেন না, দুই ইনিংস মিলিয়ে ব্রড নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ২০২৩ সালের অ্যাশেজ পর্যন্ত অন্তত খেলতে চান, ৩৯ বছর বয়সী অ্যান্ডারসন এর আগে জানিয়েছিলেন এমন। ৩৫ বছর বয়সী ব্রড অবসরের ভাবনা জানাননি সেভাবে।

কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজের ইংল্যান্ড দল থেকে দুজন বাদ পড়ার পর ওপরের প্রশ্নটা আসছে জোরালোভাবেই। ৩২১ টেস্ট, ১১৭৭ উইকেট, সর্বশেষ সিরিজে সেরা ও তৃতীয় সেরা বোলিং গড়, ৯ বছর ধরে ইংল্যান্ডের হয়ে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার কীর্তিটাকে নিজেদের করে নেওয়া, ২০২১ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় শীর্ষ পাঁচে (অ্যান্ডারসন শীর্ষে, ব্রড পাঁচে) থাকা—দলে জায়গা ধরে রাখতে এসবও যথেষ্ট হয়নি ইংল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসের সফলতম দুই বোলারের।

৩.

২০১৫ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর নতুন করে সাজানো ইংল্যান্ডের ওয়ানডে দলে জায়গা হয়নি এই দুজনের। ব্রড তা–ও পরের বছর এরপর দুটি ওয়ানডে খেলেছেন, অ্যান্ডারসনের সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে সেখানেই। যদিও ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বদলের শুরুটা হয়েছিল বিশ্বকাপের আগেই, অ্যালিস্টার কুককে সরিয়ে এউইন মরগানকে অধিনায়ক করার মাধ্যমে। তবে আসল পরিবর্তনটা বিশ্বকাপের পরই, যখন অ্যান্ডারসন-ব্রডের সঙ্গে বাদ পড়েছিলেন ইয়ান বেল, গ্যারি ব্যালান্স, রবি বোপারারা।

নিজেদের ইতিহাসের সফলতম দুই বোলারকে বাদ দিয়েছে ইংল্যান্ড
ফাইল ছবি

‘নতুন ইংল্যান্ড’ শুধু নিজেদের বদলে ফেলেনি, বদলে দিয়েছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটই। ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে, টি–টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়েও এখন ১ নম্বর দল তারাই। তবে সাদা বলের আলোর নিচে লাল বল ডুবেছে অন্ধকারে। সর্বশেষ অ্যাশেজে যে অন্ধকার নিয়েছে সবচেয়ে নিকষ কালো রূপ। দলটার নাম যখন ইংল্যান্ড, তখন টেস্টে তাদের সাফল্যের অন্যতম মানদণ্ড যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাফল্য—সেটা হয়তো না বললেও চলছে।

অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের শোচনীয় ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে গেলে অবশ্যই প্রথমে আসবে ব্যাটিং—১০ ইনিংসে একবারও যেখানে ৩০০ পেরোনোর ঘটনা নেই। দল নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যেন বর্তমানে না থেকে ভবিষ্যতের দিকেই বেশি নজর—অ্যাডিলেডে গোলাপি বলের টেস্টের কথা ভেবে ব্রিসবেনে খেলানো হয়নি অ্যান্ডারসন-ব্রডের কাউকেই।

অ্যাশেজে ৪-০ ব্যবধানে হারের পর ইংলিশ ক্রিকেটে তাই বদলের গান। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান কোচ, সহকারী কোচের চাকরি গেছে, দলেও একটা রদবদল প্রত্যাশিতই ছিল। তবে চমক হয়ে এসেছে বাদ পড়া আটজন খেলোয়াড়ের তালিকায় অ্যান্ডারসন-ব্রডের নাম। সাদা বলের মতো লাল বলেও নতুন শুরুর খাঁড়াটা পড়েছে টেস্ট ইতিহাসে সফলতম পেস জুটির ওপর।

প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যান্ডারসন-ব্রডকে বাদ দিয়ে সামনে তাকানোর উপযুক্ত সময় এটাই কি না।

অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের শোচনীয় ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে গেলে অবশ্যই প্রথমে আসবে ব্যাটিং—১০ ইনিংসে একবারও যেখানে ৩০০ পেরোনোর ঘটনা নেই। দল নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যেন বর্তমানে না থেকে ভবিষ্যতের দিকেই বেশি নজর—অ্যাডিলেডে গোলাপি বলের টেস্টের কথা ভেবে ব্রিসবেনে খেলানো হয়নি অ্যান্ডারসন-ব্রডের কাউকেই। অথচ গ্যাবার উইকেট ছিল দুজনের জন্যই আদর্শ। সে ম্যাচে খেললে সিরিজের দৃশ্যপটও অন্য রকম হতেই পারত।

টেস্টের সফলতম পেসার জেমস অ্যান্ডারসন
ফাইল ছবি

অবশ্য অ্যাশেজের ভরাডুবি টেস্টে ইংল্যান্ডের সাম্প্রতিক ব্যর্থতার ছবির একটা অংশই মাত্র। বৃহত্তর ছবিতে আছে করোনাভাইরাস আসার পর থেকে জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকার ধকল (অস্ট্রেলিয়া করোনাকালে দেশের বাইরে খেলেনি কোনো ম্যাচ), ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজের কথা ভেবে বছরজুড়েই ‘রেস্ট অ্যান্ড রোটেশন’ (বিশ্রাম দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো) নীতি মেনে চলা।

পরেরটির কারণে ইংল্যান্ড বেশ কয়েকবারই নামায়নি তাদের সম্ভাব্য সেরা একাদশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দেশের বাইরে সিরিজ জিতলেও ভারতের কাছে হেরেছে, হেরেছে দেশের মাটিতেও। আছে চোটের আঘাতও। ফিরে ফিরে আসা চোটে জফরা আর্চারের টেস্ট ক্যারিয়ারই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, ইংল্যান্ড অ্যাশেজে পায়নি ওলি স্টোনকেও।

কাউন্টি ক্রিকেটের কাঠামো টেস্ট পর্যায়ে দাপুটে দল হয়ে ওঠার পক্ষে ইংল্যান্ডের সহায়ক কি না, প্রশ্ন উঠেছে সেটি নিয়েও।

৪.

অ্যান্ডারসন-ব্রডকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে নির্বাচক কমিটি, তাতে আছেন অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচ পল কলিংউড ও প্রধান স্কাউট জেমস টেলর। অ্যান্ডারসনের টেস্ট অভিষেক হয়েছিল সাবেক এই তিন ক্রিকেটারের অভিষেকের আগেই!

অ্যান্ডারসনের এমন বিস্ময়জাগানিয়া লম্বা ক্যারিয়ারের পেছনে ২০১৫ সালের পর থেকে সীমিত ওভারে না খেলার প্রভাব না থেকেই পারে না। আধুনিক যুগে ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে তিন সংস্করণে যাঁরা খেলেন—অন্যতম ভাবনার ব্যাপার ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট’। সেদিক থেকে অ্যান্ডারসন বা ব্রড—দুজনের প্রতিপক্ষের নাম বয়স। তবে সেটিকে মোটামুটি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খেলছিলেন দুজনই।

সামনের ইংলিশ গ্রীষ্মে ৩৬ পূর্ণ করবেন ব্রড
ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালের অ্যাশেজের আগে থেকেই চোট ‘ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার হুমকি’ দিচ্ছে অ্যান্ডারসনকে। তবে এরপরও ২০২১ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ১৭টি টেস্টের ১৩টিই খেলেছেন। ২০২০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দেশের মাটিতে বাদ দেওয়া হয়েছিল ব্রডকে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন। এরপর ফিরেছিলেন, এখনো ফুরিয়ে যাননি, প্রমাণও করেছিলেন তা। গত বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ দুজনকেই বাদ দিয়ে ইংল্যান্ড খেলেছে মাত্র একটি টেস্ট।

৫.

তবে ইংল্যান্ড এখন সামনে তাকাতে চায়, সে বার্তা পরিষ্কার। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস বলেছেন, অ্যান্ডারসন-ব্রডের বাদ পড়া মানে এই নয় যে চিরদিনের জন্যই তারা বাদ। মনে করিয়ে দিই, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর দুজনকে ওয়ানডে দল থেকে বাদ দেওয়ার সময়ও এমনই বলা হয়েছিল, এরপর কী হয়েছে, তা তো বলাই হয়েছে আগে।

২০১৫ সালে বিশ্বকাপের পর সীমিত ওভার থেকে বাদ পড়েছিলেন ব্রড ও অ্যান্ডারসন
ফাইল ছবি

যেকোনো দলের ‘ট্রানজিশন’ বা নতুন পথে হাঁটা—বিশেষ করে খেলাধুলায় সব সময়ই জটিল একটা ব্যাপার। এর বড় একটা কারণ, যে পথে হাঁটতে চাওয়া হচ্ছে, সেটির সাফল্যের নিশ্চয়তা নেই স্বাভাবিকভাবেই এবং ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ। অস্ট্রেলিয়ার দিকেও তাকান, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজ জেতার পরও চলে যেতে হলো প্রধান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের জন্য দীর্ঘমেয়াদে এটি ভালো হলো না বুমেরাং—সেটির উত্তর তো এখনোই দেওয়ার উপায় নেই!

আপাতদৃষ্টে অ্যান্ডারসন বা ব্রড, দুজনেরই হয়তো ‘রূপকথার মতো বিদায়’ প্রাপ্য। যেমনটা পেয়েছিলেন তাঁদের সতীর্থ ও ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রানের মালিক অ্যালিস্টার কুক। তবে কুক বিদায় বলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সেই। এরও আগেই ছেড়েছিলেন অধিনায়কত্ব। অ্যান্ডারসন-ব্রডরা থামেননি, খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছেন বরাবরই। আপাতত এ দুজনকে থামানোর সিদ্ধান্ত তাই আসতে হতো বাইরে থেকেই। এ বছরের ১ অক্টোবর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় চুক্তির মেয়াদও আছে দুজনের।

কিন্তু আসল বাস্তবতা তো অন্যখানে। অ্যান্ডারসন সামনের ইংলিশ গ্রীষ্মে ৪০ পূর্ণ করবেন, ব্রডের হবে ৩৬। সেই গ্রীষ্মে দেখা যাবে তাঁদের বা ২০২৩ সালের অ্যাশেজে?

নাকি তাঁদের ‘লাস্ট ড্যান্স’টা হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়াতেই!