অ্যান্ডারসন যা করেছেন তা কেউ করেনি আগে

ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ফাস্ট বোলার হিসেবে ৬০০ উইকেটের মালিক জেমস অ্যান্ডারসনছবি: রয়টার্স

গল্পটা শান মাসুদের কাছ থেকে শুনলে হয়তো খুব তরতাজা মনে হবে। জিমি অ্যান্ডারসনের বলে ৮ বার আউট হয়েছেন এই পাকিস্তানি ওপেনার। ২০১৬ ও ২০১৮ সাল। দুইবার ইংল্যান্ড সফরে এসে ছয়বার অ্যান্ডারসনের বলে আউট হন। নতুন ডিউক বল হাতে অ্যান্ডারসন মাসুদকে দেখলেই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বলটা সাপের মত সুইং করিয়ে বের করিয়ে নিতেন। বল গুলো সুইং করে যাওয়ার আগে মাসুদের ব্যাটের কোনা ঘেঁষে যেত, স্লিপ ফিল্ডাররা ক্যাচ লুফে নিত। এবার ইংল্যান্ডে আসার আগে ওই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা অ্যান্ডারসন নামের যমকে শায়েস্তা করা শিখে এসেছিলেন মাসুদ। প্রথম টেস্টেই অ্যান্ডারসনের 'বাড়ি' ওল্ড ট্রাফোর্ডে মাসুদ খেললেন ১৫৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা অ্যান্ডারসনের সুইং ছেড়ে খেলেছেন, পেয়েছেন সাফল্য। মনে মনে হয়তো ভাবছিলেন, 'অ্যান্ডারসন নামের পাহাড় জয় করেছি! ইয়েস!'

কিন্তু পরের টেস্টের অ্যান্ডারসন বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তিনি আধুনিক ক্রিকেটের কিংবদন্তি। প্রথম টেস্টে মাসুদের ছেড়ে খেলা বন্ধ করতে পরের টেস্টেই ওভার দ্য উইকেট থেকে বোলিং করা শুরু করেন। এক-দুই ওভার যেতে না যেতেই ইনসুইংয়ে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন মাসুদকে। পরের টেস্টেও একইভাবে লেগ বিফোর। প্রথম টেস্টে অ্যান্ডারসন দেখেছেন মাসুদ কী করছে, পরের দুই টেস্টে অ্যান্ডারসন দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কী করতে পারেন।

এক টেস্টে মাসুদের মতো ব্যাটসম্যানদের কাছে পরাস্ত হচ্ছেন তো পরের টেস্টে নতুন কিছু নিয়ে হাজির হচ্ছেন। বয়সটা ভুলবেন না। অ্যান্ডারসন কদিন আগে ৩৮-এ পা দিয়েছেন। এই বয়সেও উইকেট নেওয়ার ঘোর নেশা কাটছে না। সে জন্যই হয়তো এখনো শিখছেন। নিজেকে প্রতিদিন ঘষছেন। আরও শাণিত করছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পেসার, ৬০০ উইকেটের মালিকের গুণ এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক!

২০ বছর আগে অবশ্য গল্পটা ভিন্ন ছিল। ল্যাঙ্কাশায়ারের বার্নলি ক্রিকেট ক্লাবের কিশোর অ্যান্ডারসনের ছিল না সুইং, নিয়ন্ত্রণ কিছুই। শুধু সিমটা সোজা রাখার চেষ্টা করতেন। অ্যাকশনের কারণে মাঝে মধ্যে কিছু লেগ কাটার হয়ে যেত। ১৭-তে পা দিতেই শরীর বাড়তে থাকে। এক-দুই বছরের মাথায় সিম বোলিং ভুলে বসেন। গতির নেশা পেয়ে বসে অ্যান্ডারসনের। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে স্টাম্প ওড়াতেন প্রায়ই। দৌড়ে এসে সুন্দর ঝাঁপ দিয়ে বারবার পুনরাবৃত্তি করার মতো অ্যাকশন দিয়ে শুধু জোরের ওপর বল করতেন। সতীর্থরাও উৎসাহ দিত। গতি দিয়েই নজরে আসে ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টি ক্লাবের স্কাউটদের। ১৮ বছর বয়সেই ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে চুক্তি করেন। আজকের ‘সুইং মাস্টার’ অ্যান্ডারসনের সুইং শেখা শুরু ল্যাঙ্কাশায়ারেই।

কাউন্টি দলের হয়ে প্রথম মৌসুমে ১৩ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেই ৫০ উইকেট নেন অ্যান্ডারসন। নামটা এক মৌসুমেই ছড়িয়ে পড়ে ইংলিশ ক্রিকেটের অলিগলিতে। বোলিংয়ের সহজাত প্রতিভা তো আছেই, সঙ্গে ছিল অদ্ভুত স্টাইল। একবার দেখলে চোখে আটকে থাকবেই। মাথায় চুল থাকত উঁচু স্পাইক করা। কত রঙের মিশেল যে থাকত অ্যান্ডারসনের চুলে! তখন ইংল্যান্ডে ফুটবলার ডেভিড বেকহামের তুমুল জনপ্রিয়তা। চুলটা তাঁর মতো করেই রাখতেন সদ্য ১৮ পার করা অ্যান্ডারসন।

কথায় আছে, বড় ক্রিকেটাররা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়েন। অল্প বয়সী অ্যান্ডারসনও হয়তো নিজের ভাগ্য নিজে গড়েছেন। ল্যাঙ্কাশায়ারে তখন আউট সুইংটা রপ্ত করতে প্রচুর খাটছিলেন অ্যান্ডারসন। এমন সময় ২০০২ অ্যাশেজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল ইংল্যান্ড। প্রথমে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, এরপর ড্যারেন গফ— দুজনই চোটে পড়েন অস্ট্রেলিয়া গিয়ে। অধিনায়ক নাসের হুসেইনের মাথায় বাজ পড়ার মতো হাল। দুই বিশেষজ্ঞ বোলার ছাড়া খেলতে হবে স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তখনই কে যেন এসে অ্যান্ডারসনের নামটা নাসেরের কানে দিয়ে যায়। উপায় না দেখে অ্যান্ডারসনকেই অস্ট্রেলিয়ায় উড়িয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন নাসের।

অল্প বয়সে সুযোগ পেয়ে যাওয়ার আবার কাউন্টি ক্রিকেটের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি অ্যান্ডারসনকে। অধিকাংশ ইংলিশ বোলারের ক্যারিয়ারের বসন্ত কেটে যায় কাউন্টিতে ঘাম ঝরিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসতে আসতে অনেক ফাস্ট বোলার মিডিয়াম ফাস্ট বোলারে পরিণত হন। অনেকে ভেঙে পড়েন চোটের ধাক্কায়। ২০ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায় সেদিক থেকে সুবিধাই হলো অ্যান্ডারসনের।

কদিন আগে স্কাই স্পোর্টসের পডকাস্টে নাসের বলছিলেন, ‘আমাদের অ্যাশেজ সিরিজ ছিল সামনে। আমরা প্রধানমন্ত্রী একাদশের বিপক্ষে খেলছিলাম। আর আমাদের সব বোলার একে একে চোটে পড়ে বাদ যাচ্ছিল। গফ ছিল না, ফ্লিনটফের চোট, সবাই একে একে ছিটকে পড়ছিল। তখন কে জানি এসে বলেছিল, ল্যাঙ্কাশায়ারের একটা ছেলে আছে, নাম জিমি অ্যান্ডারসন। নাম শুনে আমি গুগল করছিলাম 'জিমি অ্যান্ডারসন'। সে কিছু ম্যাচ খেলেছে, ল্যাঙ্কাশায়ার দ্বিতীয় সারির দলের হয়ে। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমি অ্যান্ডারসনকে নিয়ে আসতে বলি। ভেবেছিলাম যেই অবস্থায় আছি, এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে।’

কতটা খারাপ হতে পারে সেটা অ্যান্ডারসনের অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচেই টের পেয়েছিলেন নাসের। মেলবোর্নে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিংয়ের সামনে তিনি লেলিয়ে দেন ২০ বছর বয়সী অ্যান্ডারসনকে। ৬ ওভারে বল করে বেধড়ক পিটুনি খেয়ে খরচা করেন ৪৬ রান, নিয়েছেন ১ উইকেট। তবে ভুল থেকে দ্রুত শেখার সহজাত প্রতিভা যে আছে অ্যান্ডারসনের, পরের ম্যাচেই সেটা দেখিয়েছেন। ১০ ওভার বল করে ৪৮ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। অ্যান্ডারসনকে অভিষেক ক্যাপ পরিয়ে দেওয়া নাসের বলেছেন, ‘আমি এখনো বলি, প্রথমবার যখন তাঁকে দেখেছিলাম, জানতাম যে সে একজন বিশেষ প্রতিভা। ইংল্যান্ডে এমন বোলার কখনই দেখা যায় না।

প্রকৃতিগতভাবেই সমৃদ্ধ বোলার সে। পাকিস্তানে দেখা যায় ধুলোবালিতে কেউ না কেউ অসাধারণ বোলিং করছে। ইংল্যান্ডে না। অ্যান্ডারসন ঠিক সেরকমই।' অ্যান্ডারসনও জানতেন কেন তিনি সুযোগ পেয়েছেন। 'যা আছে কপালে' - এমন মনোভাব নিয়েই নাকি বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন তিনি, 'আমিও জানতাম আমি সুযোগ পেয়েছি বাকিরা চোট পাওয়ায়। তাই আর চাপ নিইনি। শুধু উপভোগ করেছি।’

পরের বছরই ঘরের মাঠে টেস্ট অভিষেক হয়। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু লাইন-লেংথের অধারাবাহিকতা ছিল বেশ। অথচ ২০২০ সালের অ্যান্ডারসনের সঙ্গে ‘লাইন-লেংথের অধারাবাহিকতা’ শব্দ তিনটি একদমই বেমানান লাগে। অথচ ক্যারিয়ারের শুরুতে ইংল্যান্ডের কোচ ডানকান ফ্লেচার অ্যান্ডারসনের সুইং নয়, গতি চেয়েছিলেন। সে জন্য অ্যান্ডারসনের সহজাত অ্যাকশনও বদলে ফেলেন এই জিম্বাবুইয়ান কোচ। নিজেকে হারিয়ে ফেলার শুরু হয় সেখান থেকেই, ‘অধারাবাহিকতা আসে যখন আমি অ্যাকশনের খুঁটিনাটি পরিবর্তন করা শুরু করি। ডানকান ফ্লেচার আমাকে জোরে বল করতে বলত। আমি ৮৮-৯০ মাইলে বল করতাম। কিন্তু আমরা সবাই ৯০ এর মাঝামাঝি বল করতে চাই। ওই অতিরিক্ত ৩-৪ মাইল গতির জন্য আমি অনেক অধারাবাহিক হয়ে পড়ি। এরপর ২০০৬ সালে পায়ে চোট পাই। সার্জারি হয়।’

নিজেকে ইতিহাসের অধ্যায় করতে অ্যান্ডারসনের আছে অনেক পরিশ্রম, অনেক ত্যাগ।
ছবি: রয়টার্স

অ্যান্ডারসনের আজকের কিংবদন্তি হওয়ার শুরুটা তখন থেকেই। চোটের কারণে প্রায় ১ বছর খেলার বাইরে ছিলেন তিনি। সুস্থ হয়ে পুরোনো অ্যাকশনে ফিরে যান। সেই ঝাঁপ, পুনরাবৃত্তি করার মতো অ্যাকশন— সব যেন আগের মতো। কিন্তু বোলার ভিন্ন।

ক্যারিয়ারের শুরুতে শুধু আউট সুইং ছিল অ্যান্ডারসনের অস্ত্রাগারে। ২০০৭-০৮ সালের দিকে যোগ হয় ইনসুইং। একই অ্যাকশন, একই কবজির অবস্থান কিন্তু বলটা কীভাবে যেন শাঁই করে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ধেয়ে আসত। দীর্ঘদিনের সতীর্থ কেভিন পিটারসন অ্যান্ডারসনের দুই দিকে বল নাচানোর দক্ষতা নিয়ে বলছিলেন, ‘নেটে জিমিকে খেলা দুঃস্বপ্নের মতো। আপনি বুঝতেই পারবেন না কোনটা আউটসুইং, কোনটা ইনসুইং।’ বেশির ভাগ পেসার বল সুইং করান মধ্যমা দিয়ে। অ্যান্ডারসন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তর্জনী দিয়ে বল ভেতর-বাহির করেন তিনি। ব্যাটসম্যান বল ছোড়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সতর্ক চোখে চেয়ে থাকেন, কিন্তু অ্যান্ডারসন শেষ মুহূর্তে তর্জনীর চাপে বল ইচ্ছে মতো সুইং করান।

২০০৭-০৮ সাল থেকেই ইংল্যান্ডের মাটিতে ডিউক বলে অবিশ্বাস্য বোলিং করা শুরু করেন অ্যান্ডারসন। অ্যান্ডারসন সুস্থ এবং ম্যাচ খেলার জন্য তৈরি থাকলে নাকি তখনকার অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের রাতের ঘুম ভালো হতো, ‘আপনি টেস্টের প্রথম সকালে অ্যান্ডারসনের হাতে বল তুলে দেবেন। আর আপনি নিশ্চিত থাকবেন যে মধ্যাহ্ন বিরতির মধ্যে প্রতিপক্ষের ১-২ উইকেট থাকবে না। মনে হতো ম্যাচ শুরুর আগেই আমরা দুই উইকেট নিয়ে নিয়েছি।’

বিদেশের মাটিতে আবার সম্পূর্ণ উল্টো দৃশ্য দেখা যেত। কুকাবুরা বল খুব বেশি সুইং করত না। ভারতে এসজি বল নতুন অবস্থায় কিছুটা সুইং করত। সুইং ছাড়া অ্যান্ডারসনকে বেশ নির্বিষ মনে হতো। গতি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো অবস্থাও ছিলেন না ৩০ ছুঁই ছুঁই অ্যান্ডারসন। কিন্তু থেমে যাওয়া অ্যান্ডারসনের অভিধানের বাইরে। নতুন বলে সুইং শেষ হলে পুরোনো বলে যেন উইকেট মিলতে পারে, সে জন্য হাত পাকিয়েছেন রিভার্স সুইংয়ে। নতুন মাত্রা যোগ করেছেন পাকিস্তানিদের আবিষ্কার রিভার্স সুইংয়ে। নিজের অবিশ্বাস্য কবজির অবস্থান দিয়ে অ্যান্ডারসন করা শুরু করেন 'রিভার্স-রিভার্স সুইং'। শচীন টেন্ডুলকার পর্যন্ত বোকা বনেছেন অ্যান্ডারসনের এই ডেলিভারিতে। রিভার্স সুইংয়ের জন্য তৈরি বলটি মনে হতো ব্যাটসম্যানের স্টাম্প ধেয়ে আসবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে অ্যান্ডারসন তর্জনী ও কবজি দিয়ে ঘুরিয়ে বের করে ফেলতেন! ব্যাটসম্যান খেলত ইনসুইংয়ের জন্য। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়া বলটি হয় ব্যাটের কোনা ছুঁয়ে যেত, না হয় এলবিডব্লু ও স্টাম্পে আঘাত!

২০১০ নাগাদ অ্যান্ডারসনের হাতে অস্ত্রের শেষ নেই। নতুন বলে দুই দিকে সুইং, পুরোনো বলে দুই দিকে সুইং। অ্যান্ডারসনকে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে দক্ষতা সম্পন্ন বোলার আখ্যা দেওয়া শুরু তখন থেকেই। কিন্তু তাঁর নামের পাশে 'ঘরের মাঠের বোলার' তকমা লেগেই থাকত। ইংল্যান্ডের মাটিতে অবিশ্বাস্য রেকর্ড, কিন্তু ইংল্যান্ডের বাইরে গিয়ে প্রিয় ডিউক বল ছাড়লেই অ্যান্ডারসন যেন গড়পড়তা কেউ হয়ে যান।

২০১১ সাল। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ। যেখানে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকান বোলার ছাড়া কেউই ভালো করেন না, সেখানে ৫ টেস্টে ২৪ উইকেট শিকার করেন অ্যান্ডারসন। তিনি বিশাল ৫ উইকেট পাননি। কিন্তু রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কদের প্রতি ইনিংসের শুরুতে আউট করে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলীয় ব্যাটিং লাইন আপ। ইংল্যান্ড সেইবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে অ্যাশেজ জিতে টেস্টের এক নম্বর দলের মুকুট পরে। এক বছর পর ভারতে টেস্ট সিরিজ জিতে ইংল্যান্ড, যেখানে টেস্ট সিরিজ জেতা অনেকটা বিশ্বকাপ জেতার সমান। দুই ইংলিশ স্পিনার মন্টি পানেসার ও গ্রায়েম সোয়ান মিলে সিংহভাগ উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু রান আটকে রাখার কাজটা নিরলস ভাবে করে গেছেন অ্যান্ডারসন। সিরিজ শেষে ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছিলেন, ‘দুই দলের মধ্যে পার্থক্য ছিল অ্যান্ডারসন।’ অথচ সিরিজ জুড়ে সেঞ্চুরি, ডাবল করে রান বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন অ্যালিস্টার কুক ও কেভিন পিটারসন।

ক্যারিয়ার যত গড়িয়েছে, অ্যান্ডারসন দেশের বাইরে ততই ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন। শিখেছেন ভিন্ন কন্ডিশনে উইকেট আদায় করার নতুন নতুন কৌশল। নতুন বলে সুইং ও পুরোনো বলে সুইংয়ের সঙ্গে যোগ করেছেন লেগ কাটার, অফ কাটার। শ্রীলঙ্কা ও আরব আমিরাতের মরা উইকেটে কাটার দিয়েই আউট করেছেন অ্যান্ডারসন। ২০১৬-১৭ সালের দিকে ওয়াবল বল ব্যবহার শুরু করেন অ্যান্ডারসন। পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ আসিফের কাছ থেকে শিখেছিলেন এই শিল্প। বলের সিমের দুই পাশে ধরে ছোড়া বলটি কাঁপতে কাঁপতে উইকেটে আঘাত করে। সেখান থেকে বল কোনদিকে যাবে অ্যান্ডারসনও জানেন না, ব্যাটসম্যানও না। গত কয়েক মৌসুম ইংল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বাইর অনেক উইকেট নিয়েছেন ওয়াবল বলে।

এতো বৈচিত্র্য থাকার পরও যদি দলের জন্য গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো রান আটকে রাখার বোলিং করতে হতো, সেটাই করতেন অ্যান্ডারসন। ম্যাচ ঘুরিয়ে ফেলতে জাদুকরী কিছু করতে হবে। অ্যান্ডারসন তখন ওয়াসিম-ওয়াকারদের মতো অবিশ্বাস্য ইনসুইং বা আউটসুইং নিয়ে হাজির হবেন। দরকার হলে শরীর তাক করা বাউন্সারও মারতে পারেন। এতটাই সমৃদ্ধ আজকের জিমি অ্যান্ডারসন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিজের বোলিংয়ে এত বৈচিত্র্য যোগ করতে অ্যান্ডারসনের যতটা না কষ্ট করতে হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়েছে বলটা ঠিক জায়গায় ফেলা রপ্ত করতে, ‘আমার মনে পড়ে না আমি ঠিক জায়গায় বল করার অনুশীলনে যতটা না সময় দিয়েছি, অন্য কিছুতে এতটা সময় দিয়েছি। কোনো জাদুকরী কিছু না। কঠোর পরিশ্রমই আসল কথা।’

কঠোর পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন বুড়ো বয়সে এসেছে। দেশের বাইরের বড় সাফল্যগুলো অ্যান্ডারসন পেয়েছেন ৩০ পার করে। শ্রীলঙ্কায় পাঁচ উইকেট, নিউজিল্যান্ডে পাঁচ উইকেট, দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাঁচ উইকেট আছে অ্যান্ডারসনের। ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বড় পাঁচ উইকেট নেই। তবে টেস্ট সিরিজ জেতাতে বড় অবদান রেখেছেন তিনি। দেশের বাইরে ৬৭ টেস্টে ২১৬ উইকেটের মালিক অ্যান্ডারসন। পেসারদের মধ্যে ৩০ বছরের পর সবচেয়ে বেশি ৮৫ টেস্ট খেলেছেন অ্যান্ডারসন। উইকেট নিয়েছেন ২৩.৮৪ গড়ে ৩৩২টি! দেশের বাইরে নিজের রেকর্ড নিয়ে অ্যান্ডারসন বলছিলেন, 'আমার জন্য সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ছিল অনুশীলনে যেই বল সুইং করবে না সেই বল দিয়ে অনুশীলন করা। অনুশীলনে গিয়ে চকচকে নতুন বল নিয়ে অনুশীলন করা খুবই সহজ। কিন্তু যখন সুইং হবে না জেনেও ঠিক অফ স্টাম্পের মাথায় বল লাগানোর চেষ্টা করে যাওয়া, লেগ কাটার, অফ কাটার করার চেষ্টা করা, ভিন্ন কিছু চেষ্টা করা—আমি এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালোবাসি। আর আমি মনে করি আমি ভালোই করেছি।’

চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন অ্যান্ডারসন। ২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অ্যান্ডারসনের গড় ছিল ৩৪.৮৫। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে কমে আসে ২৭.৩৪ এ। ২০১৪ সালের পর অ্যান্ডারসনের রেকর্ড চোখ কপালে তোলার মতো। গত ছয় বছরে টেস্ট খেলেছেন ৬৫টি। মাত্র ২১.৭১ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২৬০টি। গত ছয় বছরে গড়ের দিক থেকে হালের তরুণ পেসার প্যাট কামিন্স, কাগিসো রাবাদা, নিল ওয়েগনার, মিচেল স্টার্কদের থেকে এগিয়ে অ্যান্ডারসন।

এমন সময় থেমে যাওয়া কী সাধে? বয়স ৩৮ হয়েছে তো কী হয়েছে? এই ইংলিশ গ্রীষ্মে ২০১৪ সালের পর গড়ে সবচেয়ে বেশি জোরে বল করেছেন এই বুড়ো অ্যান্ডারসন। থেমে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তাই তো কাল ৬০০'র চূড়ায় পৌঁছে ইঙ্গিত দিলেন ৭০০ উইকেট স্পর্শ করার, 'আমি জো রুটের সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে আমাকে আগামী অ্যাশেজে চায়। আমিও না থাকার কোনো কারণ দেখি না। আমি মনে করি ইংল্যান্ড ক্রিকেটার হিসেবে শেষ ম্যাচ জিতে ফেলেছি আমি। আমি কী ৭০০ উইকেটে পৌঁছাতে পারব? কেন নয়?'

৭০০! ৬০০ উইকেটে আধুনিক ক্রিকেটের কোনো পেসারের পৌঁছানো সম্ভব না। সেখানে এই ইংলিশ কিংবদন্তির চোখ ৭০০ উইকেট। পেসার হিসেবে এর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলে ফেলেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন সংস্করণে টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু অ্যান্ডারসন নিজে খুব বেশি কৃতিত্ব নিতে চান না। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে টিকে থাকার পেছনে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নাকি তাঁর ভাগ্য, 'কিছুটা ভাগ্য কাজ করেছে। আমার শারীরিক গড়ন অনেকটা হালকা। সব সময় এমনই ছিলাম। আমার ডায়েট নিয়ে খুব ভাবতে হয় না। ৩৫ পার করার পর কিছুটা ভাবতে হচ্ছে। এ ছাড়া শুরুতে ভাবতে হতো না। জিমে যতটুকু করা দরকার সেটা করি। আর আমার অ্যাকশন পুনরাবৃত্তি করার মতো। আমার শরীরে খুব বেশি টান পড়ে না এই অ্যাকশনে।'

শুধু কী তাই। ২০১৫ সালের পর থেকে সাদা বলের ক্রিকেট খেলেন না অ্যান্ডারসন। টেস্টের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে চলেন তিনি। টি-টোয়েন্টির কাঁচা টাকার যুগে কে ছাড়তে চায় সাদা বলের ক্রিকেট! অ্যান্ডারসন বলেই হয়তো সম্ভব! কারণ যা তিনি করেছেন তা কেউ করেনি আগে।