আইপিএলের কলকাতাকে মনে করিয়ে জিতল পাকিস্তান

হাসান আলী আউট হওয়ার পর পাকিস্তানের হার নিয়ে শঙ্কা জেগেছিল।ছবি: এএফপি

রমিজ রাজা আজ নিশ্চয়ই পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ‘প্যান্ট খুলে ফেলবেন!’

সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বোলারদের বিপক্ষে ভাঙাচোরা এই দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ব্যাটসম্যানরা ২০০-র বেশি রান নেওয়ার পর রমিজ রাজার এমন অনুভূতি হয়েছিল। সেদিন অধিনায়ক বাবর আজমের ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান ম্যাচটা জেতে। এরপর রমিজ রাজা বলেছিলেন, বাবরের ইনিংসটা তাঁকে শান্ত করেছে, না হলে সেদিন রাতের বেলা ম্যাচের বিশ্লেষণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের বোলারদের ‘ছিঁড়েখুঁড়ে’ ফেলার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। বলেছিলেন, পাকিস্তানের বোলারদের ‘প্যান্ট খুলে ফেলতেন।’

সেঞ্চুরিয়নে সিরিজের চতুর্থ ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা সমালোচনায় ধুয়ে দেওয়ার মতো ব্যাটিংই করেছেন! দক্ষিণ আফ্রিকার ১৪৪ রানের জবাবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা পাকিস্তান ১ বল হাতে রেখে ৩ উইকেটে জিতেছে বটে। তবে তার আগে যা হয়েছে, সেটি মনে করিয়ে দিয়েছে দিন তিনেক আগে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হারের কথা!

গত মঙ্গলবার আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে সাকিব আল হাসান, এউইন মরগানদের কলকাতার একটা পর্যায়ে ৩১ বলে ৩১ রান দরকার ছিল, হাতে ছিল ৭ উইকেট। সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ১০ রানে ম্যাচটা হেরে যায় কলকাতা। আজ পাকিস্তানেরও তো প্রায় সেই দশাই হলো। তবে পাকিস্তান জিতেছে। অনেক নাটকের পর শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জিতে সিরিজও পাকিস্তান জিতেছে ৩-১ ব্যবধানে।

পাকিস্তানকে জিতিয়ে নওয়াজের উল্লাস।
ছবি: এএফপি

১৪৫ রানের জবাবে নামা পাকিস্তানের ইনিংসের নবম ওভার যখন শেষ হলো, তখন ৬৬ বলে পাকিস্তানের দরকার ছিল মাত্র ৫৩ রান। হাতে তখনো ৯ উইকেট! ক্রিজে দুই ব্যাটসম্যানও একেবারে বলতে গেলে ক্রিজে তাঁবু গেড়ে বসেছিলেন। ইনিংসের দ্বিতীয় বলে স্কোরবোর্ডে শূন্য রানে ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান আউট হলেও দ্বিতীয় উইকেটে অধিনায়ক বাবর আজমের সঙ্গে মিলে ততক্ষণে ৫২ বলে ৯২ রানের জুটি গড়ে ফেলেছেন ফখর জামান।

রিজওয়ানের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামা বাবর আজ তেমন আলো ছড়াতে পারেননি, কিন্তু অন্য প্রান্তে ফখর ঝড় তুলেছেন। ততক্ষণেই ৩২ বলে ৬০ রান হয়ে গেছে তিনে নামা ফখরের, বাবরের রান তখন ২২ বলে ২৪। তারওপর আইপিএলে মূল খেলোয়াড়দের অনেকে চলে যাওয়ায় ওয়ানডে সিরিজের মাঝপথ থেকেই ভাঙাচোরা দল গড়তে হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং এক তাবরেজ শামসি আর আন্দিলে ফিকোয়াও ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত নাম বলতে কেউ নেই। তখন মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানের অনায়াস জয়ের গল্পই লিখতে হবে।

কোথায় কী! ৯.২ থেকে ১৪.৩—এই ৩১ বলে সুমেরু থেকে পাকিস্তানকে কুমেরুতে ঘুরিয়ে আনল দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩১ বলের মধ্যে মাত্র ২৩ রানের মধ্যে ৫ উইকেট নেই! ১ উইকেটে ৯২ থেকে মুহূর্তেই পাকিস্তান ৬ উইকেটে ১১৫! লিজাড উইলিয়ামস দশম ওভারে তিন বলের মধ্যে ফেরালেন ফখর আর বাবরকে। এরপর ১৫তম ওভারের তৃতীয় বলের মধ্যে একে একে প্যাভিলিয়নে হায়দার আলী, মোহাম্মদ হাফিজ আর আসিফ আলী। একটি থেকে আরেকটি আউটের ধরনও কী! যেন দক্ষিণ আফ্রিকান অখ্যাত বোলারদের কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের, উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলেন একেকজন।

ফখর ফিরতেই পাকিস্তানের ধসের শুরু হয়।
ছবি: এএফপি

ফখর ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে, বাবর আপারকাট করতে গিয়ে ধরা পড়লেন থার্ডম্যানের হাতে। হায়দার ফ্লিক করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ডিপ স্কয়ার লেগে, হাফিজ স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন লং-অনে থাকা উইলিয়ামসের হাতে। এরপর আসিফ আলীর আউট তো দেখতে আরও কদর্য। হুক করতে গিয়ে টাইমিংয়ে এতই গড়বড় করলেন যে, ক্যাচ দিলেন বোলারের হাতে!

বল ইনিংসে যত পুরোনো হয়েছে, ততই উইকেটে পিচ করার উইকেট সেটিকে বেশি আঁকড়ে ধরেছে—ক্রিকেটের ভাষায় গ্রিপ পেয়েছেন বোলাররা, তাতেই কি একের পর এক পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের টাইমিংয়ে এত গড়বড় হলো? হয়তো।

সপ্তম উইকেটে মোহাম্মদ নওয়াজ আর ফাহিম আশরাফ মিলে ২৩ বলে ১৪ রানের জুটিতে কিছুক্ষণের ‘বাঁধ’ দিয়েছিলেন উইকেটের স্রোতে। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ফাহিমও ফিরে গেলেন। তারওপর যে পাকিস্তান জিততে পেরেছে, সে কৃতিত্ব ২১ বলে ২৫ রান করা নওয়াজের তো বটেই। পাশাপাশি কিছুটা ‘কৃতিত্ব’ পাকিস্তান দেবে দক্ষিণ আফ্রিকার সিসান্দা মাগালাকেও। এর আগে আসিফ আলীকে ফেরানো মাগালা ১৯তম ওভারে ফাহিমকেও ফিরিয়েছেন, কিন্তু এরপর তাঁর কী যেন হলো!

বাবর আজ তেমন কিছু করতে পারেননি।
ছবি: এএফপি

ওভারের পঞ্চম বলটিতে নো বল করলেন মাগালা, সেখান থেকে ফ্রি-হিট পেল পাকিস্তান। তখন ৮ বলে ১৫ রান দরকার পাকিস্তানের, হাতে ৩ উইকেট, স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে নন স্ট্রাইকে থাকা নওয়াজ। কিন্তু ফ্রি-হিটে পরের বলটাতেও আবার নো বল করলেন মাগালা! সে বল থেকে হাসান আলী এক রান নিয়েছেন, পাশাপাশি পাকিস্তান পেয়েছে আরেকটা ফ্রি-হিট। এবারের ফ্রি-হিটে একেবারে ‘বুলজ আই’ মারলেন নওয়াজ! মাগালার স্লোয়ার বলটাকে স্কয়ার লেগ দিয়ে করলেন সীমানা ছাড়া। বিশাল ওই ছক্কায় এক ধাক্কায় পাকিস্তানের জয়ের জন্য সমীকরণ দাঁড়াল ৭ বলে ৭! এক ধাক্কায় চাপের পারদ নিচে নেমে গেল।

পরের বলে এক রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রাখলেন নওয়াজ। ৬ বলে দরকার ৬ রান। ম্যাচে মোড় ঘোরানো দুই উইকেট নেওয়া উইলিয়ামসের ওভারের প্রথম দুই বলে এল দুই সিঙ্গেল, স্ট্রাইকে ফিরলেন নওয়াজ। তৃতীয় বলে ২ রান এল। চতুর্থ বলে রান পেলেন না নওয়াজ।

২ বলে ২ দরকার...শেষ মুহূর্তে কোনো রোমাঞ্চ ছড়ানো কিছু হবে? এমন প্রশ্ন যদি উঠে থাকেও-বা, পঞ্চম বলে বলটির সঙ্গে তা হাওয়ায় মিলিয়ে দিলেন নওয়াজ। শর্ট বল করেছিলেন উইলিয়ামস, কিন্তু বলটা ভালো হলো না। পুল করে স্কয়ার লেগে ছক্কা নওয়াজের!

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে যা রান করেছেন ফন ডার ডুসেন আর ম্যালানই।
ছবি: এএফপি

এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসেরও গল্পটা একইরকম। ১৬ রানে ওপেনিং জুটি ভাঙার পর তৃতীয় উইকেটে ইয়ানমান ম্যালান (২৮ বলে ৩৩) ও রাসি ফন ডার ডুসেন (৩৬ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৫২ রান) গড়েন ৩৯ বলে ৫৭ রানের জুটি। কিন্তু এরপর ধস। পুরোনো বল যে ‘গ্রিপ’ পাচ্ছে উইকেটে, সেটিরই প্রমাণ হয়তো। দক্ষিণ আফ্রিকার বাকি কোনো ব্যাটসম্যানেরই রান দুই অঙ্ক ছোঁয়নি! পাকিস্তানের হয়ে ফাহিম আশরাফ ৪ ওভারে ১৭ রানে ৩ উইকেট নিয়েছেন। ৩ উইকেট নিয়েছেন হাসান আলীও, তবে তিনি রান দিয়েছেন ৪ ওভারে ৪০।

দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে এমন ধস যেমন ফন ডার ডুসেন-ম্যালানরা ভাবতে পারেননি, পাকিস্তানের ইনিংসে ফখর-বাবরেরও নিশ্চয়ই এমন কিছু ধারণার বাইরে ছিল। ২৩ বলে বাবর ৩ চারে ২৪ রান করলেও ফখর বেশ ঝড় তুলেছিলেন। ৩৪ বলে ৬০ রানের ইনিংসে ৫ চারের পাশাপাশি ছক্কা মেরেছেন ৪টি!